বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপের পরিচয় ও বিষাক্ত সাপ কামড়ালে করণীয়

বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপের পরিচয় ও বিষাক্ত সাপ কামড়ালে করণীয়

বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ বেশি দেখা যায় বন্যার সময়ে। কেনোনা বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষের মতো সাপও বাস্তুহীন হয়ে পড়ে। যার কারণে বিষাক্ত সাপ যেখানে সুযোগ পায়, সেখানেই আশ্রয় নেওয়ার চেষ্ট করে।  সধারণত বর্ষার সময় অর্থাৎ মে, জুন, এবং জুলাই এই তিন মাস সাপের কামড় এবং তার কারণে মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৯ সালের অক্টোবরে বিবিসি বাংলার প্রকাশিত সর্বশেষ রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে,  বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছর অন্তত পাঁচ লাখ আশি হাজার মানুষ সাপের দংশনের শিকার হন, এবং অন্তত ছয় হাজার মানুষ মারা যান। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাপের কামড়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর মূল কারণ সচেতনতার অভাব।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ

বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ

বাংলাদেশে প্রায় ৮০ প্রজাতির বিষাক্ত সাপ রয়েছে। সাপ ও সাপের বিষ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির প্রধান অধ্যাপক এমএ ফায়েজ বিবিসিকে বলেছেন, দেশে যেসব সাপ রয়েছে, তার মধ্যে সাত থেকে আট প্রজাতির সাপ অত্যান্ত বিষাক্ত। এদের কামড়ে বেশি মানুষ মারা যায়।সাপে কাটার ঘটনা সাধারণত কৃষি ও গ্রামাঞ্চলে বেশি ঘটে থাকে। মাটিতে থাকা সাপ বেশির ভাগ সময় পায়ে দংশন করে এবং পানিতে থাকা সাপ শরীরের যে কোন জায়গায় দংশন করতে পারে।

বাংলাদেশে নদীমাতৃক দেশ হওয়াই নদীর ও সমুদ্রের পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ রয়েছে । এর মধ্যে প্রায় ২৩ প্রজাতির বিষাক্ত সাপ, সেগুলো মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের দংশন করে থাকে। তবে সমুদ্রের গভীরে বিষাক্ত সাপের অবস্থান হওয়াই কামড়ের ঘটনা তেমন না ঘটলেও নদীতে সাপের কামড়ের ঘটনা প্রায় প্রায় ঘটে থাকে।

বিষাক্ত সাপের কামড় সম্পর্কে অধ্যাপক এমএ ফায়েজ বলেছেন, বাংলাদেশে যত মানুষ সাপের দংশনে মারা যায়, তার চারগুণ মানুষের নানা রকম অঙ্গহানি ঘটে, কেউ শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান এবং কেউ দীর্ঘদিন মানসিক ট্রমা ভোগ করেন। বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির হিসেব অনুযায়ী যে সাত প্রজাতির বিষাক্ত সাপের কামড়ে মানুষ বেশি মারা যায় সেগুলো নিচে দেয়া হল-

রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া

রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া

রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া আরেক নাম উলুবোড়া। বাংলাদেশে যতগুলো বিষাক্ত সাপ রয়েছে তার মধ্য এটি সবচেয়ে বিষাক্ত। রাসেলস ভাইপার সাপটি প্রায় একশ’ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত ১০/১২ বছর আগে থেকে আবার এই সাপে দংশনের ঘটনা ঘটার প্রমাণ দেখা যায়। কিন্তু এই সাপ হঠাৎ করে কেন আর কিভাবে ফেরত এসেছে, তা নিয়ে এখন বাংলাদেশে গবেষণা চলছে।

চন্দ্রবোড়া দেখতে বাদামি রঙের ও মোটা হয়ে থাকে। অনেকটা অজগরের মতো দেখতে। উত্তেজিত হলে উচ্চস্বরে হিসহিস করতে থাকে ও শরীর উপরের দিকে উঁচু করে ধরে। এদের বিষ রক্তে কাজ করে শরীরের টিস্যু গলিয়ে ফেলে। এরা অসম্ভব ধীর গতির হয়ে থাকে। আর এরা জঙ্গলের সাপ বলে এরা সহজে মানুষের সংস্পর্শে আসে না।  এই সাপ কাটলে স্নায়ু অবশ হয়ে আসে, রক্ত জমাট বেধে যায়।

সবুজ বোড়া সাপ

সবুজ বোড়া সাপ

মাথার অংশ মোটা বলে এই সাপের নামকরন করা হয়েছে সবুজ বোড়া। স্থানীয় ভাবে এই সবুজ বোড়া সাপ কে গাল টাউয়া সাপও বলে। সাপটির দৈর্ঘ্য সচরাচর ৬৫-৮০ সেন্টিমিটার এবং সর্বোচ্চ ১.০৪ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। জন্মের পরপর যার দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ১০-১৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত।

এই সাপটির গায়ের ওপরের অংশের রঙ ঘন সবুজ। মাথার পাশে এবং চোখের নিচের অংশে থাকে হলুদ, সাদা অথবা ফ্যাকাশে সবুজ। এই জাতের মোট ছয়টি প্রজাতির সাপ বাংলাদেশে দেখা যায়। এই সাপ সুন্দরবন এবং পাহাড়ি এলাকার জঙ্গলে থাকে বলে এটি মানুষের মুখে মাথায় এবং গায়ে দংশন করে।

ব্ল্যাক নাইজার সাপ

ব্ল্যাক নাইজার সাপ

ব্ল্যাক নাইজার শঙ্খিনী প্রজাতির একটি বিষাক্ত সাপ। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে এই প্রজাতির বিষধর সাপ দেখা যায়। এটি মূলত শঙ্খিনী জাতের সাপ। কালো নাইজার সাপ চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল, নোয়াখালী এবং সুন্দরবন অঞ্চলে দেখা যায় বেশি। এরা সাধারণত ৬ থেকে ৮ ফুট লম্বা হয়ে থাকে।

কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়

কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়

বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ হল কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়। কিং কোবরা কে রাজ গোখরা বা পদ্ম গোখরা বলে। এদেরকে বলা হয় সাপেদের রাজা। ভয়ানক এই বিষাক্ত সাপ অন্য গোখরার তুলনায় আকৃতিতে বেশ লম্বা হয়। এর ফণায় অন্য গোখরার মতো চশমার মত বলয় থাকে না। শঙ্খচূড় বাংলাদেশ, ভুটান, বার্মা, কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এসব দেশে বেশি দেখা যায়। এই সাপ ঘন জঙ্গল ও পাহাড়ি এলাকায় থাকতে পছন্দ করে।

বিষাক্ত নায়া সাপ

বিষাক্ত নায়া সাপ

বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ এর মধ্য নায়া অন্যতম। এটি কোবরা বা গোখরা প্রজাতির সাপ, এর বৈজ্ঞানিক নাম নায়া নায়া। এটি স্থলভূমির সাপ, এটি ফণা তোলে এবং এর ফণায় চশমার মত দুইটি বলয় থাকে। দেশের পশ্চিম অংশেই অর্থাৎ রাজশাহী অঞ্চলের দিকে প্রধানত এ সাপের বসবাস।

নায়া কাউচিয়া সাপ

নায়া কাউচিয়া সাপ

এটিও গোখরা প্রজাতির সাপ, স্থানীয়ভাবে একে জাতি সাপ বা জাত সাপও বলে থাকে। এই সাপটিকে জউরা নামেও ডাকা হয়। এ সাপ ফণা তোলে। এটি মূলত দেশের পূর্ব অংশ অর্থাৎ সিলেট, নোয়াখালী এলাকায় বেশি থাকে। দেশে যত সর্প দংশনের ঘটনা ঘটে, এর কামড়ে ঘটে সর্বোচ্চ।

ক্রেইট, কেউটে

ক্রেইট, কেউটে

এই সাপকে শঙ্খিনী বা শাঁকিনী সাপ নামেও ডাকা হয়। শ্রীমঙ্গলে দেখা মেলে এই সাপের। পৃথিবীতে ক্রেইট বা শঙ্খিনী জাতের সাপের মোট ৮টি প্রজাতি রয়েছে, এর মধ্যে ৫টি প্রজাতি বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এই ক্রেইট জাতের সাপকে স্থানীয়ভাবে কেউটেও বলা হয়।

এ সাপ বাড়ির আশপাশে বা লাকড়ির মধ্যে শুকনো জায়গায় থাকে। এর শরীরে ছোপ ছোপ দাগ হওয়ায় একে অনেকে ডোরা কাটা কেউটে বলে ডাকে। এদের নিউরোটক্সিন বিষ মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। তবে আশ্চর্যজনক মনে হলেও এই সাপের কামড়ে বাংলাদেশে মৃত্যুর কেস নগণ্য বা একেবারেই নেই। কেননা মানুষ দেখলেই পালিয়ে যায় ভীতু প্রকৃতির এই সাপটি।

বিষাক্ত সাপ কামড়ালে করণীয়

বিষাক্ত সাপ কামড়ালে করণীয়

সাপে কামড়ালে সবার আগে কামড় খাওয়া ব্যক্তিকে আশ্বস্ত করতে হবে। সাপের কামড় মানেই মৃত্যু এ কথা সঠিক নয়, তা বোঝাতে হবে। কামড় খাওয়া ব্যক্তির শরীরের বাকি স্থানে যাতে বিষ ছড়াতে না পারে, তার জন্য ক্ষতস্থানের উপরের অংশ বেঁধে দিতে হবে। রোগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাছের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সম্ভব হলে কোন প্রজাতির সাপ কামড়েছে তা জানার চেষ্টা করবেন। বিষাক্ত সাপে কামড়ালে করনীয় কি তা নিচে দেওয়া হলো-

  • প্রথমেই সাপটিকে ধরা বা ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবেন না এতে করে বার বার সাপের কামড় খাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
  • সাপের কামড়ের স্থান কাটাকাটি করবেন না।
  • মুখ দিয়ে কখনো সাপের বিষ চুসে বের করার চেষ্টা করা যাবে না।
  • কামড়ের স্থান সাবান বা ডেটোলের সাথে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
  • একটি পরিষ্কার, শুকনো কাপড় দিয়ে কামড়ের স্থান ঢেকে রাখুন।
  • অ্যাসিড জাতীয় কিছু জিনিস দিয়ে ক্ষতস্থান পোড়ানোর চেষ্টা করবেন না।
  • ক্ষতস্থানে চুন বা গাছ-গাছড়ার রসও দেবেন না।
  • জোর করে বমি করানোর চেষ্টা করানোও উচিত নয়।
  • রোগীকে নিথর এবং নিশ্চল হয়ে শুয়ে যেতে হবে, যাতে আক্রান্ত অঙ্গ নড়াচড়া না হয়। কপালে দংশন হলে বসে যেতে হবে, হাঁটা যাবে না। হাতে দংশনে হাত নড়াচড়া করা যাবে না।
  • ক্যাফেইন বা অ্যালকোহল পান করবেন না।
  • ব্যথা নাশক ওষুধ গ্রহন করা যাবে না, এতে করে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • কামড়ের স্থান ফুলে গেলে সমস্থ আংটি, ঘড়ি, এবং টাইট পোশাক খুলে আরাম দায়ক পোশাক পরিধান করুন।
  • সম্ভব হলে নিরাপদ দূরত্ব থেকে সাপের ছবি নিয়ে রাখুন। সাপ শনাক্ত করা গেলে সাপের কামড়ের চিকিৎসায় সাহায্য হয়।
  • বিশ্রাম নিশ্চিত করুন ও শান্ত থাকুন।
  • প্রথাগত প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতি, ভেষজ ওষুধ এবং অন্যান্য অপ্রমাণিত ও অনিরাপদ প্রাথমিক চিকিৎসা এড়িয়ে চলুন।
  • যত দ্রুত সম্ভব সাপে কাটা ব্যক্তিকে হাস্পাতালে নিতে হবে।

বিষাক্ত সাপ কামড়ালে করণীয়

শেষ কথা

সাপ যতই বিষাক্ত হোক না কেন মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা পৃথিবীতে কোন কিছুই অহেতুক সৃষ্টি করেননি। সাপ নানা ভাবে আমাদের উপকার করে থাকে। এদের বিষ থেকে যেমন তৈরি হয় জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তেমনি এরা ব্যাঙ, ইঁদুরসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষা করে।

সাপের উপদ্রব বেশি হয় বর্ষাকালে, বিশেষ করে কৃষি প্রধান গ্রামগঞ্জ এলাকায়। কারন এই সময় বৃষ্টিতে সাপের গর্ত পানিতে ডুবে যায়। যার ফলে সাপ শুকনো জায়গার খোঁজে মানুষের বাড়িতে আসে। তাই এই সময় আমাদের সকলের সতর্ক থাকা উচিত।

বিষাক্ত সাপ সম্পর্কে আরও জানতেঃ- wikipedia.org

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রাসেল ভাইপার সাপ কিভাবে চিনবেন । রাসেল ভাইপার নিয়ে যত অজানা তথ্য

বিষহীন সাপ কামড়ালে কি হয় । বিষহীন সাপের কামড়ের লক্ষণ

জরায়ু ক্যান্সার কি? জরায়ু ক্যান্সারের কারণ, প্রাথমিক লক্ষণ এবং চিকিৎসা