জরায়ু ক্যান্সার কি? জরায়ু ক্যান্সারের কারণ, প্রাথমিক লক্ষণ এবং চিকিৎসা

জরায়ু ক্যান্সার কি? জরায়ু ক্যান্সারের কারণ, প্রাথমিক লক্ষণ এবং চিকিৎসা

স্তন ক্যান্সারের মতো জরায়ু ক্যান্সার মেয়েদের কাছে একটি আতঙ্কের নাম। এই ক্যান্সার এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার নামেও পরিচিত, এটি এমন এক ধরনের ক্যান্সার যা জরায়ুকে প্রভাবিত করে। এই ধরনের ক্যান্সারকে সাইলেন্ট কিলার বা নীরবঘাতক বলা হয়ে থাকে। সারাবিশ্বে নারীরা যেসব ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হন তার মধ্যে জরায়ু ক্যান্সার অন্যতম।

২০১৮ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর ১২ হাজারের বেশি নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। শুধু তাই নয় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার নারী এই ক্যান্সারে অক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্য বলছে, জরায়ুমুখ রোগে প্রায় ৯০ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনাই ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। অনেকেরই এই ক্যান্সার হলে আগাম কোনো লক্ষণগুলি বুঝতে পারেন না। তাই আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যেমে আমি জানাবো জরায়ু ক্যান্সারের কারণ, লক্ষণ এবং এর চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে। চলুন শুরু করা যাক-

জরায়ু ক্যান্সার কি

জরায়ু ক্যান্সার কি?

জরায়ু ক্যান্সার যা গর্ভাশয় ক্যান্সার নামেও পরিচিত। জরায়ুর ক্যান্সার যা গর্ভাশয় ক্যান্সার বলতে জরায়ু কলা থেকে উদ্ভূত সকল ধরনের ক্যান্সারকেই বোঝায়। অর্থাৎ এই ক্যান্সার বলতে বোঝায়  জরায়ুর আস্তরণে অস্বাভাবিক কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি। জরায়ু হল মহিলার প্রজনন প্রণালীর অংশ এবং এটি গর্ভের নীচের অংশে অবস্থিত, যা গর্ভ থেকে যোনি পর্যন্ত খোলা।

নির্দিষ্ট কিছু উপাদান জরাযুর ক্যান্সারের কারণ হলেও, স্থূলতা, বৃদ্ধ বয়স, এবং মানব প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি-১৬, ১৮) সংক্রমণ জরায়ুর ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ফলে প্রথম দিকে এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে কোন লক্ষণ বা উপসর্গ নাও দেখা দিতে পারে, কিন্তু অনিয়মিত মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্তপাত, গ্যাস, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা হালকা খাবারের পর পেট ভর্তি লাগা, পেটে অস্বস্তি লাগা, ইত্যাদি খুব বেশি হলে তা জরায়ু ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে।

জরায়ু ক্যান্সারের কারণ

জরায়ু ক্যান্সারের কারণ

জরায়ুমুখ ক্যান্সার হয় এক ধরনের ভাইরাসের আক্রমণে, যার নাম “হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস”। ওই ভাইরাস আছে এমন কারো সাথে যৌনমিলন হলে। অর্থাৎ যৌনমিলনের সময় পুরুষের কাছ থেকে নারীদেহে এই ভাইরাস ঢুকে যায়। এই ভাইরাসটি যখন প্রথম দেহে ঢুকে তখনি এটি ক্যান্সার হয় না, এটি ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়।

আবার ধারণা করা হচ্ছে, জরায়ু ক্যান্সারের অন্যতম একটি কারণ হতে পারে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা। এই ক্যান্সারের কোষগুলোয় এস্ট্রোজেন রিসেপ্টর রয়েছে বলে জানা যায়, যা হরমোনের সাথে বিক্রিয়া ঘটিয়ে কোষের বৃদ্ধি ঘটায়, যা পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয়। তবে এই বিক্রিয়া ঠিক কি ভাবে তা এখনও জানা যায় নি।

জরায়ু ক্যান্সারের প্রকারভেদ

জরায়ু ক্যান্সারের মধ্যে দুই ধরনের ক্যান্সার রয়েছে, একটি হলো এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার এবং অপরটি হলো জরায়ু সারকোমা। যখন কোনো জরায়ুতে একটি ক্যান্সারের বৃদ্ধি ঘটে, তখন ক্যান্সারটি এই দুটি প্রাথমিক জরায়ু ক্যান্সারের মধ্যে যে কোনো একটিতে বিকশিত হতে পারে। নিচে জরায়ু ক্যান্সারের দুইটি প্রকারভেদ সম্পর্কে লেখা হলো-

এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারঃ এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার হলো সবচেয়ে সাধারণ ধরণের জরায়ু ক্যান্সার। এটি প্রায় ৯৫% এরও বেশি জরায়ু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে দায়ী। এই ধরনের ক্যান্সার সাধারণত জরায়ুর আস্তরণে বিকশিত হয়।

জরায়ু সারকোমাঃ জরায়ু সারকোমা একটি বিরল ধরণের জরায়ু ক্যান্সার, এটি সাধারণত পেশী বা জরায়ুর টিস্যুতে বিকাশ লাভ করে।

জরায়ু ক্যান্সারের পর্যায়

জরায়ু ক্যান্সারের পর্যায়

জরায়ু ক্যান্সারের মূল অসুবিধা হলো এটি শেষ পর্যায়ে গেলেই শুধুমাত্র ব্যথা দেখা দেয়। এর আগপর্যন্ত এর লক্ষণগুলোকে অনেকেই মাসিকের মেয়েলি সমস্যা বলে মনে করেন। তাই এই ক্যান্সারের পর্যায় নির্ণয় করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি একজন ব্যক্তিকে সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আর যদি একবার জরায়ু ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়, তাহলে এই রোগের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। নিম্নে এই ক্যান্সারের পর্যায়গুলো লেখা হলো। যথা-

১ম পর্যায়ঃ ক্যান্সারের বৃদ্ধি শুধুমাত্র জরায়ুতে পাওয়া যায়, জরায়ুর গ্রন্থিগুলিতে সম্ভাব্য বৃদ্ধির সাথে।

২য় পর্যায়ঃ ক্যান্সারের বৃদ্ধি জরায়ুর শরীর থেকে জরায়ুর সমর্থনকারী সংযোজক টিস্যুতে ছড়িয়ে পড়েছে যা সার্ভিকাল স্ট্রোমা নামেও পরিচিত।

৩য় পর্যায়ঃ ক্যান্সার এখন জরায়ু এবং জরায়ুর বাইরে বেড়েছে, কিন্তু পেলভিক দেয়াল বা যোনির নিচের অংশে পৌঁছায়নি। এটি কাছাকাছি লিম্ফ নোডগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে বা নাও করতে পারে।

৪র্থ পর্যায়ঃ ক্যান্সারের বৃদ্ধি পেলভিক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মূত্রাশয় এবং মলদ্বারকে প্রভাবিত করেছে। এমনকি এটি হাড়, ওমেন্টাম বা ফুসফুসকেও প্রভাবিত করতে পারে।

জরায়ু ক্যান্সারের লক্ষণ

জরায়ু ক্যান্সারের লক্ষণ

জরায়ু ক্যান্সারকে সাইলেন্ট কিলার বা নীরব ঘাতক বলা হয়ে থাকে। কারণ, প্রথমদিকে এই রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না। অর্থাৎ এই অসুখ দেখা দিলে অনেক নারীরাই এর প্রাথমিক লক্ষণগুলি বুঝতে পারেন না বা লক্ষণ দেখা দিলেও বিশেষ গুরুত্ব দেন না। এই রোগ ধরা পড়ার পরে তখন এর বেশ কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। নিম্নে এই ক্যান্সারের লক্ষণগুলি লেখা হলো-

  • পেটে অতিরিক্ত ব্যথা অনুভব হয় কিংবা পেট ফুলে থাকে।
  • আচমকা ক্ষুধা কমে যায়।
  • পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে রক্তপাত হয়।
  • সহবাসের সময় অস্বস্তিবোধ বা রক্তপাত হয়।
  • রক্তের সাথে যোনি স্রাব হয়।
  • অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ হয়।
  • সবসময় বমি বমি ভাব কিংবা বার বার বমি হয়।
  • সহবাসের পর রক্তপাত হয়।
  • মেনোপজের পরে রক্তপাত হয়।
  • অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি পায় কিংবা হঠাৎ করে ওজন অনেক কমে যায়।
  • তীব্র গন্ধযুক্ত যোনি স্রাব হয়।
  • প্রস্রাব করার সময় ব্যথা অনুভূত হয়।

কারা জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছেন

কারা জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছেন

আমরা অনেকেই মনে করি, জরায়ু ক্যান্সার হয়তো প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরে হয়ে থাকে। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। যে কোন বয়সেই নারীদের জরায়ু ক্যান্সার হতে পারে। তবে বিশেষ করে ৫০ বছর বয়স্ক বা এর চেয়েও বেশি বয়সের নারীরা জরায়ু ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। কিন্তু যারা এই ক্যান্সারের ঝুকিতে বেশি আছেন নিচে তাদের সম্পর্কে লেখা হলো-

  • যাদের বয়স ১৬ বছর হয়নি অর্থাৎ ১৬ বছর বয়স হওয়ার আগেই যৌনসংগমের অভিজ্ঞতা থাকলে কিংবা পিরিয়ড শুরুর ১ বছরের মধ্যেই যৌন সঙ্গম শুরু করে থাকলে।
  • শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতি থাকলে।
  • স্বামী বা যৌন সঙ্গীর শরীরে ভাইরাসটি থাকলে।
  • অনেকজন যৌনসঙ্গী থাকলে।
  • যাদের ধূমপানের অভ্যাস আছে।
  • জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য দীর্ঘদিন, বিশেষত ৫ বছরের বেশি সময় ধরে বড়ি সেবন করে থাকলে।
  • এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া ইত্যাদি রোগ থাকলে। এইগুলো রোগ যৌনসংগমের মাধ্যমে ছড়ায়।

জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা

জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা

ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণত রোগটির স্টেজের ওপর ভিত্তি করে একেক স্টেজে একেক চিকিৎসা দেয়া হয়। যেমনঃ সার্জারি, রেডিও এবং কেমোথেরাপি- এই তিন ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়। জরায়ু ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও তাই। এই ক্যান্সারের প্রাথমিক চিকিৎসাগুলির মধ্যে রয়েছে সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি, হরমোনাল থেরাপি ইত্যাদি। নিম্নে এই ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্পর্কে লেখা হলো-

সার্জারিঃ এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের আক্রমনাত্মক ক্ষেত্রে বা এটিকে আরও ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করার জন্য প্রায়শই অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেওয়া হয়। আর অস্ত্রোপচারের লক্ষ্য হল যতটা সম্ভব ক্যান্সার অপসারণ করা। সবচেয়ে সাধারণ অস্ত্রোপচার পদ্ধতি হল টোটাল অ্যাবডোমিনাল হিস্টেরেক্টমি, যার মধ্যে জরায়ু, সার্ভিক্স এবং কখনোও কখনোও ফ্যালোপিয়ান টিউব এবং ডিম্বাশয় অপসারণ করা হয়।

কেমোথেরাপিঃ ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলার জন্য কেমোথেরাপি একটি রাসায়নিক ওষুধ। এটি ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য সেবন করা যেতে পারে। কেমোথেরাপির ওষুধ রোগীর নির্দিষ্ট চাহিদা এবং ক্যান্সারের বৈশিষ্ট্য অনুসারে তৈরি করা হয়। সেইসাথে কেমোথেরাপির এই চিকিৎসা কয়েকটি চক্রে করা হয়।

রেডিয়েশন থেরাপিঃ ক্যান্সার যদি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে এবং এখনও যদি  আক্রমনাত্মক না হয় তাহলে রেডিয়েশন থেরাপি প্রায়শই ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলার জন্য ব্যবহার করা হয়। কারণ, এই রেডিয়েশন উচ্চ-শক্তি এক্স-রে বিম ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষকে হত্যা করে। এটি অস্ত্রোপচারের পরে ক্যান্সারের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি কমাতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। অস্ত্রোপচারের জন্য যোগ্য নয় এমন মহিলাদের জন্যও রেডিয়েশন থেরাপির পরামর্শ দেওয়া হয়।

হরমোনাল থেরাপিঃহরমোনাল থেরাপির পরামর্শ দেওয়া হয় সাধারণত জরায়ুর বাইরে ছড়িয়ে পড়া এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের উন্নত ক্ষেত্রে। হরমোনাল থেরাপি নির্দিষ্ট ধরণের জরায়ু ক্যান্সারের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশেষ করে যাদের ইস্ট্রোজেন বা প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর পজিটিভ স্ট্যাটাস রয়েছে। কারণ, হরমোনাল থেরাপি শরীরের কিছু হরমোনকে লক্ষ্য করে যা জরায়ু ক্যান্সার বৃদ্ধিতে সহায়তা করে বা প্রতিরোধ করে।

 

শেষ কথা

প্রিয় পাঠকগণ, আশা করি আজকের এই আর্টিকেল থেকে আপনারা জরায়ু ক্যান্সারের কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে অনেক উপকৃত হয়েছেন। তাই কখনো যদি আপনার মধ্যে জরায়ু ক্যান্সারের কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় তাহলে অবহেলা না করে খুব দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। কারণ, স্বাস্থ্য সচেতনতা অবলম্বনের মাধ্যমেই এই ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন।

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফুসফুস ক্যান্সারের লক্ষণ, কারণ এবং চিকিৎসা পদ্ধতি

ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে শীতকালীন সবজির ভূমিকা ও উপকারিতা

বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপের পরিচয় ও বিষাক্ত সাপ কামড়ালে করণীয়