পাইলস এর লক্ষণ ও প্রতিকার । পাইলস কেন হয়

পাইলস এর লক্ষণ ও প্রতিকার । পাইলস কেন হয়

পাইলস এর লক্ষণ গুলো কি কি? বাঙালীরা বেশি মসলাযুক্ত খাবার খেতে পছন্দ করে। যার পরিণতি পাইলস এ রূপান্তরিত হয়। আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়া, কায়িক শ্রম না করা, পানি কম পান করা, মলমূত্র চেপে রাখা এই সব পাইলস হওয়ার কারণ। আমাদের দেশে কম-বেশি প্রায় সবারই পাইলস হয়ে থাকে। আমরা যখন অ-স্বাস্থ্যকর খাবার খাই, অনিয়মিত জীবন-যাপন করি ঠিক তখনই পাইলস এর আবির্ভাব দেখা দেয়। আবার নিয়মানুযায়ী জীবন-যাপন করলে পাইলস আপনা-আপনি চলে যায়। কারো পরিবারে যদি এই সমস্যা থাকে সে ক্ষেত্রেও পরবর্তী প্রজন্মে এই রোগটি স্থানান্তরিত হয়। আরোও বিস্তারিত জানতে আমার সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়তে হবে। আশা করি পাইলস এর লক্ষণ ও পাইলস সম্পর্কিত সকল তথ্য এই আর্টিকেলে পেয়ে আপনারা উপকৃত হবেন।

পাইলস কি

পাইলস কি?

পাইলস বা অর্শরোগ হলো বর্ধিত রক্তনালী যা আপনি আপনার মলদ্বারের ভেতরে বা বাহিরে পেতে পারেন। একে ইংরেজিতে “হেমোরয়েড” বলা হয়। আপনার মলদ্বারের ভিতরে বা বাইরে এই ফোলা শিরাগুলি ব্যথা, মলদ্বারে চুলকানি এবং মলদ্বার থেকে রক্তপাত হতে পারে। পাইলস দুইভাবে বিকশিত হয়। মলদ্বারের ভেতরে শিরা ফুলে যায় বা পাইলস বিকশিত হয়, যাকে অভ্যন্তরীণ হেমোরয়েড বলা হয়। আবার এই শিরাগুলি মলদ্বারের চারপাশে ত্বকের নীচেও হতে পারে , যাকে বহিরাগত বা বাহ্যিক হেমোরয়েড বলা হয়। পাইলস এর চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে। পাইলস যখন ফুলে যায় এবং বড় হয় তখনই তারা বিরক্তিকর উপসর্গ তৈরি করে। অনেকেই ঘরোয়া চিকিৎসা এবং জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বস্তি পায়।

পাইলস এর প্রকারভেদ

পাইলস এর প্রকারভেদ

পাইলস সাধারণত ২ প্রকার হয়ে থাকে। যথাঃ-

  1. অভ্যন্তরীণ পাইলস
  2. বাহ্যিক পাইলস

অভ্যন্তরীণ পাইলসঃ-

অভ্যন্তরীণ পাইলস আপনার মলদ্বারের ভেতরে হয়, তবে সেগুলি ঝুলে যেতে পারে এবং আপনার মলদ্বার থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এটি বের হয়েছে কিনা বা এটির অবস্থানের উপর ভিত্তি করে চারটি শ্রেণি বা পর্যায় করা হয়েছে।

  • প্রথম পর্যায় – পাইলস থেকে রক্তপাত হয় কিন্তু পাইলস ফুলে বাহিরের দিকে বের হয়ে আসে না।
  • দ্বিতীয় পর্যায় –  মলমূত্র করার পর পাইলস ফুলে আপনার মলদ্বার থেকে বেরিয়ে আসে কিন্তু পরে নিজেরাই ভিতরে ফিরে যায়।
  • তৃতীয় পর্যায় – পাইলস আপনার মলদ্বার থেকে বেরিয়ে আসে এবং আপনি যদি শারীরিকভাবে তাদের আবার ভিতরে ঠেলে দেন তবেই তারা ভিতরে ফিরে যায়।
  • চতুর্থ পর্যায় – পাইলস সবসময় আপনার মলদ্বার থেকে নিচে ঝুলে থাকে এবং আপনি সেটিকে পিছনে ঠেলে দিতে পারবেন না। যদি পাইলসের ভিতরে রক্ত ​​জমাট বেঁধে যায় তবে সেগুলি ফোলা এবং বেদনাদায়ক হতে পারে।

বাহ্যিক পাইলসঃ-

বাহ্যিক পাইলস হল ফোলাভাব যা আপনার মলদ্বারের কাছাকাছি ছোট ছোট গলদ তৈরি করে। এগুলো সত্যিই বেদনাদায়ক হয়ে থাকে, বিশেষ করে যদি তাদের মধ্যে রক্ত ​​​​জমাট বাঁধে।

পাইলস কেন হয়?

আপনার পায়ুপথের শিরা ফুলে গেলে পাইলস হয় অর্থাৎ মলদ্বারে চাপ বৃদ্ধির ফলে এর চারপাশের রক্তনালীগুলি চাপে প্রসারিত হয় এবং ফুলে যায়, যা পাইলস তৈরি করে। আপনি যখন টয়লেটে যান তখন কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে আপনার শ্বাস আটকে রাখা এবং নিচের মলদ্বারের শিরাগুলিতে আরও বেশি চাপ তৈরি করে। এছাড়াও আরও বিভিন্ন কারণে আপনার হেমোরয়েড হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। এর মধ্যে রয়েছেঃ-

  • দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য
  • দীর্ঘদিন ডায়রিয়া থাকলে
  • দীর্ঘসময় মল চেপে রাখলে
  • কায়িক শ্রম কম করার ফলে
  • ওজন বেশি থাকার কারণে
  • অনেক মেয়েদের প্রেগন্যান্সি সময়ও পাইলসের সমস্যা দেখা দেয়।
  • আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়া।
  • কিছু লোক পারিবারিক সূত্রে পাইলস হওয়ার প্রবণতা পায়।
  • আপনার বয়স বাড়ার সাথে সাথে আপনার শরীরের সহায়ক টিস্যুগুলি দুর্বল হয়ে যায় এবং আপনার পাইলস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।

    পাইলস এর লক্ষণ

পাইলস এর লক্ষণ

অনেক ক্ষেত্রে পাইলস এর লক্ষণ দেখা দেয় না এবং কিছু লোক বুঝতেও পারে না যে তাদের পাইলস আছে। পাইলস এর প্রকারভেদ অনুযায়ী এর উপসর্গগুলো কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। যেমনঃ অভ্যন্তরীণ হেমোরয়েডগুলি খুব কমই ব্যথা সৃষ্টি করে। আবার বাহ্যিক হেমোরয়েডগুলি মলদ্বারে বাহিরে চুলকারি হয়। যাইহোক, যখন পাইলস দেখা দেয়, তাদের মধ্য নিম্নলিখিত পাইলস এর লক্ষণ গুলি অন্তর্ভুক্ত হতে পারেঃ-

  • মলদ্বার স্থানে চুলকানি
  • মলত্যাগের সময় রক্তপাত
  • মলদ্বার স্থানে ব্যথা, বিশেষত যখন দীর্ঘ সময় বসে থাকে
  • মলদ্বারের চারপাশে লালভাব এবং ফোলাভাব
  • মল যাওয়ার সময় ব্যথা ও অস্বস্তি
  • মলদ্বারের বাহিরে শিরা ঝুলে থাকা

পাইলসের ঘরোয়া প্রতিকার

পাইলস হলে মলদ্বারের শিরাগুলি ফুলে যায় এবং ব্যথা অনুভূত হয়। এটি খুবই কষ্টদায়ক ও অস্বস্তিকর ব্যাপার। তাই পাইলস এর সমস্যা থেকে রেহায় পেতে শুরু থেকেই সচেতন হওয়া জরুরি। তা না হলে পরবর্তীতে এটি বড় আকার ধারণ করতে পারে এমনকি অপারেশন করার প্রয়োজন হতে পারে। পাইলস প্রতিকারের সর্বোত্তম উপায় হল আপনার মল নরম রাখা, যাতে সহজে মলত্যাগ হয়। কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা রয়েছে, যা পাইলস এর লক্ষণগুলি উপশম করতে এই টিপসগুলি সহায়তা করে। এই প্রতিকারগুলো প্রতিরোধের ভূমিকাও পালন করে।

গরম পানির সেঁক করা

হিপবাথ বা গরম পানির সেঁক মলদ্বারের জ্বালাকে প্রশমিত করতে সাহায্য করতে পারে। আপনি হিপবাথ ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। এটি এমন পদ্ধতি যা একটি ছোট প্লাস্টিকের টব যেটি টয়লেট সিটের উপরে ফিট করে যাতে আপনি কেবল আক্রান্ত স্থানটিতে গরম পানির সেঁক দিতে পারেন। এটি মূলত শরীরের নীচের অংশে অস্বস্তি এবং ব্যথা উপশম করতে ব্যবহৃত হয়। এই গরম পানিতে ডাক্তারের পরামর্শে বেটাডিন দ্রবণ বা অন্যান্য অ্যান্টিসেপটিক দ্রবণ ব্যবহার করা যেতে পারে।

পর্যাপ্ত পানি পান করা

পর্যাপ্ত পানি পান না করলে মল শক্ত হয়। মল শক্ত হলে পাইলসের সমস্যা বৃদ্ধি পায়। তাই চিকিৎসকরা পাইলস আক্রান্ত রোগীদের অতিরিক্ত পানি পান করার পরামর্শ দেয়। সারাদিনে ৩ থেকে ৪ লিটার পানি পান করলে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। পানি পান করার পাশাপাশি ডাবের পানি, স্যুপ, ডাল, ফলের রস অর্থাৎ তরল জাতীয় খাবা্র খেতে হবে। যখন আপনার শরীর ভালভাবে হাইড্রেটেড থাকবে, তখন আপনার হজমের সমস্যা দূর হবে এবং আপনাকে মলত্যাগের সময় কম চাপ দিতে সাহায্য করে। অ্যালকোহল এড়ায়ে চলুন।

নারিকেল তেল ব্যবহার

পাইলসে আক্রান্ত হলে মলত্যাগের পর মলদ্বার ফুলে যায় ও ব্যথা হয়। এটি খুবই কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। এই অস্বস্তি কমাতে নারিকেল তেল সাহায্য করতে পারে। এতে ব্যথা উপশমকারী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এছাড়াও  ২০০৮ সালে পরিচালিত গবেষণা অনুসারে, নারকেল তেলে শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা প্রদাহ এবং ফোলা কমাতে পারে।

আঁশযুক্ত খাবার খান

পাইলস এর লক্ষণ দেখা দিলে খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন আনতে হবে। আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়ার কারণেই মূলত পাইলস হয়ে থাকে। তাই  বেশি করে ফলমূল, শাকসবজি এবং গোটা শস্য খান। এটি খেলে মল নরম হয় এবং এর বাল্ক বৃদ্ধি পায়।পর্যাপ্ত ফাইবার সমৃদ্ধ সুষম খাবার গ্রহণ করলে আপনার নিয়মিত মলত্যাগে সহায়তা করবে।

টেনশন মুক্ত ও ভালো ঘুম

টেনশন মুক্ত থাকলে ভালো ঘুম হয় আর ভালো ঘুম হলে হজমের সমস্যা দূর হয়। তাই স্ট্রেস মুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। রাতে ৮-৯ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। রাতে পর্যাপ্ত ঘুম আপনার  হজম স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।

মলত্যাগের পরে ভিজা টিস্যু ব্যবহার করা

মলত্যাগের পরে টয়লেট টিস্যু ব্যবহার করার ফলে মলদ্বারে আরও বেশি জ্বালাতন করতে পারে। ভিজা টিস্যু বা ভিজা ওয়াইপগুলি ব্যবহারে আপনার মলদ্বারে জ্বালা করবে না এবং ঐ স্থানটি পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও আপনি এমন ওয়াইপ ব্যবহার করতে পারেন যেগুলিতে প্রশান্তিদায়ক অ্যান্টি-হেমোরয়েড উপাদান রয়েছে, যেমন উইচ হ্যাজেল বা অ্যালোভেরা।

ব্যায়াম করার অভাস তৈরি করা

কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করতে এবং মলদ্বারের শিরাগুলির উপর চাপ কমাতে ব্যায়াম করার অভ্যাস তৈরি করুন। ব্যায়াম আপনাকে অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে। দীর্ঘক্ষণ বসে না থেকে শরীরকে সক্রিয় রাখুন। বেশিক্ষণ বসে থাকলে, বিশেষ করে পায়খানার ওপর, মলদ্বারের শিরার ওপর চাপ বাড়তে পারে।

পাইলস এর চিকিৎসা

পাইলস এর চিকিৎসা

ঘরোয়া চিকিৎসার মাধ্যমে পাইলস এর লক্ষণ গুলি এক সপ্তাহের মধ্যে চলে যায়। আপনার যদি ঘরোয়া প্রতিকার অনুসরণ করার পরও মলত্যাগের সময় রক্তপাত এবং পাইলস থাকে তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যে আপনার ডাক্তার দেখানো উচিত।

অনুমান করবেন না যে, মলদ্বারে রক্তপাত পাইলস এর কারণে হয়। এটি অন্যান্য রোগের সমস্যার কারণেও হতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে কোলোরেক্টাল ক্যান্সার এবং পায়ূর ক্যান্সার। বিশেষ করে যদি আপনার মলমূত্রের অভ্যাস পরিবর্তন হয় বা আপনার মলের রঙ পরিবর্তন হয়। আপনার যদি প্রচুর পরিমাণে মলদ্বার থেকে রক্তক্ষরণ হয়, মাথা ঘোরা বা অজ্ঞানতা থাকে তবে জরুরি চিকিৎসা নিন।

পাইলস আক্রান্তকারীর মাত্র কয়েক শতাংশের পাইলস অপসারণের জন্য অপারেশনের প্রয়োজন হয়। যদি অন্য চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি কাজ না করে বা আপনার মলদ্বারে রক্তনালী বড় থাকে সে ক্ষেত্রে অপারেশন করতে হয়।

শেষ কথা

পাইলস মূলত একটি সাধারণ সমস্যা। এগুলি খুব সাধারণ এবং মলদ্বারের শিরাগুলিতে চাপের কারণে ঘটে। এটি কোনো গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে না। গর্ভাবস্থায় পাইলস একটি অস্বস্তিকর মনে হলেও এটি কিন্তু সাধারণ অবস্থা। তাই ভয় পাবার কিছু নেই। উপরে উল্লিখিত ঘরোয়া প্রতিকারগুলি অনুসরণ করলে ভবিষ্যতে পাইলস প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। আশা করছি, আমার আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ে পাইলস এর লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জেনে আপনারা উপকৃত হয়েছেন। ধন্যবাদ।

এ সম্পর্কে আরও জানতেঃ-(wikipedia)

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *