প্যানিক এটাক হলো স্নায়বিক আক্রমণ, অস্বস্তি, ভয়-ভীতি, ও উদ্বেগের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এটি প্রায় সকল বয়সের মানুষের জীবনে হঠাৎ করেই ঘটতে পারে। যদি কোন মানুষ তার সাথে ঘটে যাওয়া কোন কিছু নিয়ে অতিরিক্ত মানসিক চাপ অথবা উদ্বিগ্ন বোধ করে, ঠিক তখনই প্যানিক এটাক হতে পারে। পাঠক বন্ধুরা আপনারা যারা প্যানিক এটাক কি, প্যানিক এটাক এর লক্ষণ ও প্যানিক এটাক কেন হয় জানতে চাচ্ছেন, তারা এই আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
প্যানিক এটাক কি
প্যানিক এটাক হলো একটি মানসিক রোগ। যার প্রভাবে একজন সুস্থ সবল মানুষ আকস্মিক ভাবে মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং প্রচণ্ড ভয় অনুভব করতে শুরু করে। প্যানিক আক্রান্ত রোগীর এই সময় মনে হয় যেন তার হৃৎপিণ্ড থমকে যাচ্ছে, এবং তারা সহজে শ্বাস নিতে পারেনা। আরও মনে হতে থাকে সে যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে অথবা মারা যাচ্ছে। এই রকম পরিস্থিতিকে ইংরেজি ভাষায় “প্যানিক অ্যাটাক” বলা হয়। প্যানিক এটাক এর লক্ষণ গুলি শুরু হওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে শীর্ষে পৌঁছায় এবং প্রায় ৩০ মিনিট ধরে প্যানিক এটাক স্থায়ী হয়, তবে প্যানিক এটাকের সময়কাল কয়েক সেকেন্ড থেকে ঘন্টা পর্যন্ত হতে পারে।
প্যানিক এটাক এর লক্ষণ
পাঠক বন্ধুরা, যদি আপনার সন্তান, পিতা-মাতা অথবা আত্মীয়স্বজন কেও প্যানিক এটাকের সম্মুখীন হলে তারা ভাবতে শুরু করে তাদের চারপাশে যা ঘটছে তা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। প্যানিক আক্রান্তের সময়ে রোগীরা অতিরিক্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এছাড়াও তারা ভাবতে শুরু করে তাদের শরীর বিপদের মধ্যে পরেছে, এমনকি তারা মারা যাচ্ছে। প্যানিক এটাক এর লক্ষণগুলোর কারনে মানব শরীরে যেসব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে তা নিচে তুলে ধরা হল;
শ্বাসকষ্ট
প্যানিক এটাকে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শ্বাসকষ্ট মনে হওয়া খুবই সাধারণত একটি সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রের সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, “আপনি যখন প্যানিক এটাকে আক্রান্ত হবেন, তখন ‘শ্বাসকষ্টের সমস্যা’ এবং ‘যথেষ্ট বায়ু পাচ্ছি না অনুভূতি’ হবে। যখন প্যানিক আক্রান্ত রোগীর এরকম ঘটে তখন উচ্চতর উদ্বেগ আপনাকে খুব দ্রুতগতিতে শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকে ঠেলে দেয়।
অতিরিক্ত ভয়
অতিরিক্ত ভয় কোন শর্তকতা ছাড়ায় আপনার প্যানিক এটাক ঘটাতে পারে। কোন কিছু নিয়ে অতিরিক্ত দুর্বলতা, শারীরিক ও মানসিক দুশ্চিন্তাও প্যানিক এটাকের অন্যতম কারন হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিদ্যা সমিতির মতে, আপনার উপরে ভয়ের যে ঢেউ আসে তা ‘তীব্র’ এবং ‘সুস্পষ্ট বা প্রত্যক্ষগোচর কোনো কারণ ছাড়াই তা আসে, যদিও প্রায় সব ক্ষেত্রে এটি ফিজিক্যালি ট্র্যাপড বা অ্যাগোরাফোবিক অথবা কোনো স্থানে ফাঁদে পড়া বা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ার অহেতুক ভয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আপনি যদি একের অধিকবার প্যানিক এটাকে আক্রান্ত হন তাহলে আপনি খুব দ্রুত প্যানিক ডিজঅর্ডারের দিকে ধাবিত হবেন।
অচল বা প্যারালাইজ হয়ে যাওয়া
আপনার মাত্রাতিরিক্ত ভয়ের কারনে প্যানিক এটাক হতে পারে যা আপনাকে গতিহীন বা অচল বা অসাড় করে দিতে সক্ষম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিদ্যা অ্যাসোসিয়েশনের বর্ণনামতে, অতিরিক্ত ভয় ভীতির কারনে প্যানিক এটাক আপনাকে অচল বা প্যারালাইজ পারে।
মনের উপর নিয়ন্ত্র হারানো
প্যানিক এটাকের অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে মনের উপর নিয়ন্ত্রন হারানো। বোস্টন ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসর টড ফারকিওন বিদেশি এক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন; মানসিক তীব্রতা এবংআকস্মিক অনুভূতি উদ্ভূত হওয়ার কারণে প্যানিক এটাক হয়, যার ফলে প্যানিক এটাক আক্রান্ত রোগী উন্মাদ হয়ে যায় অথবা মনের উপর নিজের নিয়ন্ত্র হারিয়ে ফেলে।
মাথা ঘোরা বা ঝিমঝিম করা
সাধারণত মাথা ঘোরা বা ঝিমঝিম করা প্যানিক এটাক এর লক্ষণ বলে বিবেচিত হয়। মাথা ঘোরা, ঝিম ঝিম করা, এবং শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ার অন্যতম কারন হচ্ছে, মস্তিষ্ক থেকে রক্ত দ্রুত বেগে আপনার হাত ও পায়ের দিকে চলে যাচ্ছে, যাতে আপনি প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে বা পালাতে পারেন। মাথা ঘোরা সঙ্গে বমি বমি ভাব যুক্ত হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
অতিরিক্ত ঘেমে যাওয়া
প্যানিক এটাকের উচ্চতর উদ্বেগের প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ঘেমে যাওয়া। ঘেমে যাওয়ার সাথে সাথে আপনি থর-থর করে কাপতে থাকবেন এবং ঝাকুনি অনুভব করতে পারেন। এটি প্যানিক এটাক এর লক্ষণ গুলোর মধ্যে একটি যা দেখে আপনে বুঝতে আপ্রবেন আপনার প্যানিক এটাক হয়েছে।
দ্রুত হৃদস্পন্দন
প্যানিক এটাক হওয়ার সময় আপনার শরীর হুমকির মধ্যে থাকা সত্ত্বেও আপনার শরীর প্রতিক্রিয়া করবে, কয়েক মিনিটের মধ্যে তা ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পেয়ে প্রচন্ড অস্বস্তিকর পর্যায়ে চলে যাবে। দুর্বল সিগন্যালের বড় ঢেউ অ্যামিগডালাকে সক্রিয় করে। অ্যামিগডালা হচ্ছে মস্তিষ্কের অনুভূতিমূলক ফাইট অর ফ্লাইট সেন্টার। ফাইট অর ফ্লাইট মানে হল জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করা অথবা এড়িয়ে যাওয়া। অ্যামিগডালা সক্রিয় হলে দ্রুতগতিতে ও আঘাতমূলকভাবে হৃদস্পন্দন হয়, যার ফলে আপনার মনে হবে আপনার হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে।
গরম লাগা ও ঠান্ডা লাগা
প্যানিক এটাক আক্রান্ত রোগীর কখনো গরম কখনো ঠান্ডা লাগা খুবই সাধারণ একটি বিষয়। আপনি শুধু মাত্র প্যানিক এটাকে ৫-১০ মিনিট থাকলে, আপনাকে গরম ও ঠান্ডা লাগা অনুভূতি কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারবেন।
অত্যাধিক মাত্রায় মানসিক দূশ্চিন্তা
প্যানিক এটাক এর লক্ষণ মধ্যে অতিরিক্ত মানসিক চাপই প্যানিক এটাক ঘটায়। অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও উদ্বেগ একই বিষয় নয়। এ সম্পর্কে নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রেইড উইলসন বিদেশি এক পত্রিকায় বলেন; প্রায় ক্ষেত্রে প্যানিক এটাকের প্রধান কারন হচ্ছে অতিরিক্ত মাত্রায় মানসিক দূশ্চিন্তা, যা ৬ থেকে ৮ মাস ধরে বিদ্যমান আছে। আপনি যদি প্রচুর পরিমাণ মানসিক দূশ্চিন্তায় ভুগেন তাহলে আপনার প্যানিক অ্যাটাক হওয়ার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে।
প্যানিক এটাক কেন হয়
আমরা এতক্ষণ প্যানিক এটাক এর লক্ষণ গুলো সম্পর্কে জানলাম। প্যানিক এটাক কি কারণে হয়ে থাকে এটি জানা অনেক জরুরী। ছোট শিশু বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রায় সকল বয়সের মানুষদের যেকোন সময় প্যানিক এটাক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্যানিক এটাক কেনো হয় কোন, এ সম্পর্কে কোন চিকিৎসক ক্লিয়ার ভাবে কিছু বলতে না পারলেও তারা আংশিকভাবে ধারণা দিয়েছেন। আর তা হলো কোন বিষয় নিয়ে অত্যাধিক মানসিক দূশ্চিন্তা করা, বা কিছু সম্পর্কে উদ্বিগ্ন বোধ করার কারনে প্যানিক এটাক হতে পারে। নিচে প্যানইক এটাক কেন হয় তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারন তুলে ধরছি-
- পারিবারিক ইতিহাসঃ প্যানিক এটাক রোগ যদি আপনার পরিবারের অন্য কোন সদস্য যেমন (বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানের) এর থাকে, সে ক্ষেত্রে আপনার প্যানিক এটাক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়।
- মানসিক সাস্থ্যঃ যে সকল মানুষের উদ্বেগ জনিত রোগ, বিষণ্নতা সহ আরও নানান ধরনে মানসিক স্বাস্থ্য জনিত রোগ রয়েছে তাদের প্যানিক এটাক হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
- প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতাঃ প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতা সাধারণত একটি শিশুর ১ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে ঘটতে পারে। এই সময়ের মধ্যে যদি কোন শিশু আঘাতমূলক ঘটনা দেখে থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে ওই শিশুর পরবর্তিতে প্যানিক এটাক হওয়ার সম্ভাবনইয়েবেশি থাকে।
- মৃত্যুঃ প্রিয়জন বা প্রিয় বস্তুর মৃত্যুর কারনেও প্যানিক এটাক হতে পারে।
- কোন বস্তুর অপব্যবহার জনিত সমস্যাঃ যেকোন প্রকার নেশা যেমন, ড্রাগের নেশা এবং মদ্যপান প্যানিক অ্যাটাকের সম্ভাবনাকে দ্বিগুণ হারে বাড়িয়ে দেয়।
শেষ কথা
আশা করছি আজকের এই আর্টিকেল থেকে আপনারা প্যানিক এটাক কি? প্যানিক এটাক এর লক্ষণ ও প্যানিক এটাক কেন হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। তথ্যবহুল প্যানিক এটাক এর লক্ষণ সম্পর্কিত আর্টিকেল যদি আপনাদের কাছে ভাল লেগে থাকে তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আপনি চাইলে প্যানিক এটাক এর লক্ষণ আর্টিকেলটি আপনার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের মাঝে শেয়ার করতে পারেন যাতে করে তারা প্যানিক এটাক সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা লাভ করতে পারে। আর্টিকেলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
প্যানিক এটাক সম্পর্কে আরও জানতেঃ- www.bbc.com
Leave a Comment