শ্বাসকষ্টের মূল কারণ শ্বাসনালির সংকোচন। সাধারণভাবে, সর্দি-কাশি হলেও শ্বাসকষ্ট হয়। অনেক ক্ষেত্রে সাইনোসাইটিস হলেও শ্বাসকষ্টের প্রকোপ বাড়ে। শীতের শুরুতে শ্বাসকষ্টের নানা উপসর্গ দেখা দেয়। কারণ, শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ অনেকটা কমে যায়। এর ফলে ধুলার পরিমাণ বেড়ে যায়। আর সেই ধুলোগুলি আমাদের ফুসফুসে ঢুকে যার ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা বাড়তে থাকে।
শ্বাসকষ্ট কি?
শ্বাসকষ্ট এমন একটি শারীরিক অবস্থা যখন একজন মানুষ মনে করে যে সে যথেষ্ট ভালো করে শ্বাস নিতে পারছে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানীর ভাষায় একে ইংরেজিতে ডিসপ্নিয়া বলা হয়। বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে যে কোনো সময় যে কেউ শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে পারে। আপনি এটি অনুভব করতে পারবেন তখন যখন দেখবেন, আপনি ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছেন না, বাতাসের জন্য হাঁপাচ্ছেন, পর্যাপ্ত বাতাস পাচ্ছেন না, কোনো কাজ করছেন কিন্তু শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
কিছু অসুখের কারণে শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে। যেমনঃ ফুসফুসে পানি জমে গেলে, হৃৎপিণ্ডের বাম নিলয়ের কার্যকারিতা কমে গেলে, অ্যাজমা বা হাঁপানি থাকলে, কোনো কারণে যদি ফুসফুসের ভেতরের ছোট রক্তনালির অভ্যন্তরে রক্ত জমাট বাঁধে ইত্যাদি কারণে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
শ্বাসকষ্ট সাধারণত ২ ধরনের হয়ে থাকে। একটি হলো অ্যাকিউট বা তীব্র ধরনের। এটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তীব্র শ্বাসকষ্টে রূপান্তরিত হয়। এই রকম শ্বাসকষ্ট কারো দেখা দিলে অতি দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। দ্বিতীয়টি হলো ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট। এর তীব্রতা প্রথমে কম থাকলেও পরে এটি বাড়তে থাকে।
শীতে শ্বাসকষ্ট বাড়ার কারণ
বিশেষজ্ঞদের মতে শীতকালে মানুষ প্রধাণত দুটি কারণে এর সমস্যায় বেশি ভোগে। তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটায় কমে যায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে পরিবেশ শুষ্ক থাকে যার কারণে বাতাসে জলীয়বাষ্পের হার বা আর্দ্রতাও কমে যায়। এতে করে জীবাণু খুব সহজেই শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসের ভিতরে প্রবেশ করে এবং শরীর থেকে সহজে বের হয় না। তখন জীবাণুরা বংশ বিস্তার করে এবং আমাদের শ্বাসতন্ত্রে আক্রমণ করে।
আমাদের ফুসফুসের অভ্যন্তরে এক ধরনের তরল নিঃসৃত হয়, যাকে ব্রঙ্কিয়াল নিঃসরণও বলা হয়। এই তরল শ্বাসতন্ত্রের অভ্যন্তরে থাকা সিলিয়ারি কোষ শ্বাসের মাধ্যমে আমাদের ফুসফুসে ঢুকে পড়া ধুলাবালি ও জীবাণুকে বের করে দেয়। কিন্তু বাতাসের আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণে শ্বাসতন্ত্রে শুষ্কভাব তৈরি হয়। এই সময় পানি কম খাওয়া হয় যার ফলে ব্রঙ্কিয়াল নিঃসরণও কমে যায়।
শ্বাসতন্ত্রে শ্বাসকষ্ট সহ আরো বিভিন্ন রকমের রোগের সৃষ্টি হয়। যারা আগে থেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছেন তাদের ঠিক একই কারণে রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। আর যারা মাঝেমধ্যে শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগেন তাদের কাউকে কাউকে শীতকাল ও শুষ্ক মৌসুমে ইনহেলার প্রয়োজন হয়।
শ্বাসকষ্ট হলে যা মাথায় রাখবেন
শ্বাসকষ্ট হলে অবশ্যই যে বিষয়গুলো মাথায় রাখা জরুরিঃ-
- শ্বাসকষ্ট সাধারণত ব্রঙ্কাইটিস, টিবি বা যক্ষ্মা, অ্যাজমা, অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতার কারণে হয়। তাই কারো যদি শ্বাসকষ্ট দীর্ঘদিন ধরে হয়, তাহলে খুব দ্রুত ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
- শৈশবে যদি কারো শ্বাসকষ্টের ইতিহাস থাকে তাহলে তা সাধারণত অ্যাজমা বা হাঁপানির জন্য হয়। এ ধরনের রোগীর বয়স বাড়ার সাথে সাথে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
- অ্যাজমা বা হাঁপানিজনিত শ্বাসকষ্ট রাতে অথবা ভোরের দিকে বেশি হয়।
- শ্বাসকষ্টের সঙ্গে যদি জ্বর থাকে, বুকে ব্যথা হয় বা শ্বাস নেওয়ার সময় যদি শোঁ শোঁ শব্দ হয়, তা সাধারণত ফুসফুসের মারাত্নক জটিলতা। এ ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে রোগীকে হাস্পাতালে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।
- যাদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা নেই, কিন্তু কিডনি- সংক্রান্ত জটিলতা আছে, তাদেরও যদি হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হয় সেক্ষেত্রে বসে না থেকে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।
- বাড়ির বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন।
- ঘরের ভিতরটা সবসময় পরিষ্কার রাখুন।
- যাদের শ্বাসকষ্ট আছে এবং ধুমপান করেন তারা এই সময় অবশ্যই চেষ্টা করবেন ধুমপান পরিত্যাগ করতে।
শ্বাসকষ্টের লক্ষণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্বাসকষ্ট নিজে কোনো রোগ নয়। এটি অন্যান্য রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়। নিম্নে শ্বাসকষ্টের সাধারণ কিছু লক্ষণগুলি লেখা হলোঃ-
- ঘ্রাণ।
- বুক টান।
- দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস।
- উচ্চ হৃদস্পন্দনের হার।
- গভীর শ্বাস পেতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।
শ্বাসকষ্টের জন্য ঘরোয়া প্রতিকার
শ্বাসকষ্টের জন্য ঘরোয়া কিছু প্রতিকার রয়েছে। নিচে সেগুলো লেখা হলোঃ-
- চেয়ারে বসার সময় চেয়ারটাকে সামনের দিকে বাঁকানো বা সামনের দিক হয়ে বসা।
- হাঁটাহাঁটি বা উপরে যাওয়ার সময় একটি দেয়ালের বিপরীতে দাঁড়িয়ে শ্বাসনালী শিথিল করা।
- উঠে দাঁড়ানোর সময় চেয়ার বা টেবিলের সমর্থন নিয়ে দাঁড়ানো। শ্বাসনালী খোলার জন্য ঘাড় শিথিল করে রাখা।
- কড়া এক কাপ কফি পান করলে শ্বাসনালী খুলে যায়।
- আদা চা খাওয়া। কারণ, আদা শ্বাসনালীর প্রদাহ কমিয়ে অক্সিজেনের প্রবেশ স্বাভাবিক রাখে।
- সরিষার তেল হালকা গরম করে বুকে ও পিঠে এবং গলায় ভালো করে ম্যাসাজ করলে শ্বাসকষ্ট অনেকটাই কমে যায়।
- শুকনো ডুমুর খান। কারণ, ডুমুর ফুসফুসের কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। কয়েকটি ডুমুর সারা রাত পানিতে ভিজিয়ে রাখুন এবং সকালে খালি পেটে পানি ও ডুমুর খেয়ে ফেলুন। এতে অনেক উপকার পাবেন।
- খাবারের সাথে কাঁচা পেঁয়াজ খেলে বেশি উপকার পাওয়া যায়। শ্বাসকষ্ট কমাতে আধা কাপ দুধ ও এক টেবিল চামচ রসুন কুচি ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে পান করুন।
- এক গ্লাস হালকা গরম পানিতে এক চামচ মধু মিশিয়ে পান করুন। নিয়মিত এই মধু মিশ্রিত পানি পান করলে শ্বাসকষ্টের সাথে সাথে মেদ-ও কমে যায়।
- এসবে যদি কাজ না হয় তাহলে, যেকোনো ধরনের ঔষধ খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
শ্বাসকষ্ট হলে চিন্তার কোনো কারণ নেই, এটি একটি সাধারণ ঘটনা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এটি ভালো হয়ে যেতে পারে। এটি যদি আপনার সাধারণ জীবনযাপনে বাধা সৃষ্টি করে এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
Leave a Comment