পুরান ঢাকার দর্শনীয় স্থান ও বিখ্যাত খাবার সমূহ

পুরান ঢাকার দর্শনীয় স্থান ও বিখ্যাত খাবার সমূহ

পুরান ঢাকা বাঙালি জাতির এক অতুলনীয় ঐতিহ্য ও অপূরণীয় অধ্যায়। পুরান ঢাকাকে ব্যাখ্যা করা যায় ‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি’ বলে। শুধু বাজার নয়, এখানে আছে অনেকগুলো ‘পুর’, ‘গঞ্জ’, ‘তলা’, ‘তলী’ এবং বাহারি নামের এলাকা। ৪০০ বছরের ইতিহাসের খনি পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো যেন একেকটা গল্প। পুরান ঢাকার অধিকাংশ স্থানীয় অধিবাসী আদি ঢাকাইয়া। এই অঞ্চলের মানুষজন কিছুটা পৃথক ধরণের ভাষায় কথা বলে। যাকে ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা বলা হয়।

পুরান ঢাকার মানুষ খেতে খুব পছন্দ করে। আর সারা বাংলাদেশে পুরান ঢাকার খাবার খুবই বিখ্যাত। পুরান ঢাকায় অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এই দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ পিপাসু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যে পুরান ঢাকা যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি তারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। এখানের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। আজকের এই আর্টিকেলে আমি আপনাদের জানাবো পুরান ঢাকার পরিচিতি ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং এখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো কি কি সেইসাথে পুরান ঢাকার দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে। চলুন তবে শুরু করা যাক-

পুরান ঢাকার পরিচিতি ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

পুরান ঢাকার পরিচিতি ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ঢাকা মহানগরীর আদি অঞ্চলটিকে পুরান ঢাকা বলা হয়। পুরান ঢাকার পূর্ব-পশ্চিমে গেন্ডারিয়া ফরিদাবাদ থেকে হাজারীবাগ ট্যানারি মোড় পর্যন্ত এবং দক্ষিণে ঢাকা সদরঘাট থেকে নবাবপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাধারণ বাঙালির সংস্কৃতির থেকে পুরান ঢাকার সংস্কৃতি অনেকটাই আলাদা এবং ভিন্নতর।

পুরান ঢাকা শহরটি ৭০০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পূর্ববঙ্গের ঢাকা নামক অঞ্চলটিতে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠে। অনেকের মতে, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকাকে সুবাহ্ বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশার বেশকিছু অঞ্চল) রাজধানী রূপে ঘোষণা করেন। তখন সুবাদার ইসলাম খান আনন্দের বহিঃপ্রকাশস্বরূপ নগরে ঢাক বাজানোর নির্দেশ দেন। এই ঢাক বাজানোর কাহিনী লোকমুখে কিংবদন্তির রূপ নেয় এবং তা থেকেই নগরের নাম ‘ঢাকা’ হয়ে যায়।

পুরান ঢাকা ৮টি মেট্রোপলিটন থানা এলাকা নিয়ে গঠিত। পুরান ঢাকার পশ্চিমে মোহাম্মদপুর, উত্তরে ধানমন্ডি, নিউ মার্কেট, শাহবাগ, রমনা, মতিঝিল ও সবুজবাগ, পূর্বে যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুর এবং দক্ষিণে কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জ উপজেলা অবস্থিত। পুরান ঢাকার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বাহন হলো রিকশা। এছাড়াও এখানে ঘোড়ার গাড়ী বা টমটম ও চলতে দেখা যায়। পুরান ঢাকা বাংলাদেশের প্রধানতম বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানকার চকবাজার এলাকায় সব রকমের পণ্যসামগ্রীর পাইকারী বিপণন হয়ে থাকে। (wiki)

পুরান ঢাকার দর্শনীয় স্থান

পুরান ঢাকাতে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এই শহরটি একটি প্রাচীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জনপদ। এখানে থাকা একেকটি স্থানগুলো ঐতিহাসিক এবং অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুরান ঢাকার যেসব উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলো রয়েছে তাদের মধ্যে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থানগুলো হচ্ছে যেমন বাহাদুর শাহ পার্ক, লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, রোজ গার্ডেন, রুপলাল হাউস, তারা মসজিদ, ঢাকেশ্বরী মন্দির, কার্জন হল, পরিবিবির মাজার ও আর্মেনীয় গির্জা ইত্যাদি।

পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিল

পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিল

আহসান মঞ্জিল পুরান ঢাকার ইসলামপুরের কুমারটুলী এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। নওয়াব আবদুল গনি আহসান মঞ্জিল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে এর নির্মাণ কাজের সমাপ্ত হয়। দীর্ঘ ১৩ বছর লেগেছিলো প্রাসাদটি নির্মাণ করতে। তিনি তার প্রিয় পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন ‘আহসান মঞ্জিল’। এটি পূর্বে ছিল ঢাকার নবাবদের আবাসিক প্রাসাদ ও জমিদারীর সদর কাচারি। বর্তমানে এটি  বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক পরিচালিত একটি জাদুঘর।

১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আহসান মঞ্জিল ভ্রমণের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ জাদুঘরের সংগ্রহশালা। মোট ৪ হাজার ৭৭ টি নিদর্শন আহসান মঞ্জিলের ২৩টি কক্ষে প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত করা আছে। নয়টি কক্ষ সেই নবাবী আমলের মতো করেই সাজানো রয়েছে। আহসান মঞ্জিল পরিদর্শন করতে জনপ্রতি ২০ টাকা দিয়ে প্রবেশ টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। ১২ বছরের নিচে অপ্রাপ্ত শিশুরা জনপ্রতি ১০ টাকায় প্রবেশ করতে পারে।

পুরান ঢাকার প্রাচীন আর্মেনীয় গির্জা

পুরান ঢাকার প্রাচীন আর্মেনীয় গির্জা

আর্মেনীয় গির্জা ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি পুরান ঢাকার একটি প্রাচীন খ্রিস্টধর্মীয় উপাসনালয়। আর্মেনীয় গির্জাটি আরমানিটোলা ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ এর মাঝে চার্চ রোডে অবস্থিত। শতকে পুরান ঢাকার আর্মেনীয় বসতি থেকেই গির্জাটি আর্মেনীয় গির্জা নামে পরিচিত হয়।  গির্জার ঘণ্টাঘরের পাশে ক্লক টাওয়ার হিসেবে একটি সুদৃশ্য গির্জাচূড়া ১৮৩৭ সালে নির্মাণ করা হয় যা ১৮৯৭ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে।

আগা ক্যাটচিক মিনাস গির্জার জন্য এই জমিটি দান করেন। তাঁর স্ত্রী সোফি ১৭৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে গির্জায় সমাধিস্থ করা হয়। গির্জার মূল ভবনটিতে ১৪ ফুট প্রশস্ত আঙিনা রয়েছে। আয়তাকার ভবনটি তিনটি অংশে বিভক্ত- একপাশে রেলিংবেষ্টিত উচ্চ বেদী, একটি কেন্দ্রীয় প্রার্থনাগৃহ এবং নারী ও শিশুদের জন্য সংরক্ষিত গ্যালিরিযুক্ত একটি অংশ। ১০ ফুট উঁচু বেদীটি সম্ভবত কাঠের তৈরি। বেদীটি দেয়াল থেকে ৪ ফুট দূরবর্তী অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজবিশিষ্ট ছাদের নিচে স্থাপিত।

শ্যামবাজার এলাকার রূপলাল হাউজ

শ্যামবাজার এলাকার রূপলাল হাউজ

রূপলাল হাউজ ভবনটি নির্মাণ করেন হিন্দু ব্যবসায়ী ভ্রাতৃদ্বয় রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস। রূপলাল হাউজ বাংলাদেশের ঢাকা শহরের পুরান ঢাকার শ্যামবাজার এলাকায় ঊনবিংশ শতকে নির্মিত একটি ভবন। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর পারে ফরাসগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত। এটি ৯১.৪৪ মিটার দীর্ঘ একটি দ্বিতল ভবন। এর পেছনভাগে বুড়িগঙ্গা নদী প্রবহমান। এটি জমিদার ও বণিকদের তৈরি। দ্বিতল এই ভবনের স্থাপত্য শৈলী অভিনব।

এটি দুইটি অসম অংশে বিভক্ত যার প্রতিটিতে কিছুটা ভিন্ন স্থাপত্য শৈলী দেখা যায়। এর ভিত্তিভূমি ইংরেজি E অক্ষরের ন্যায়, যার বাহুত্রয় শহরের দিকে প্রসারিত। মাঝের দীর্ঘতম বাহুটির দৈর্ঘ্য ১৮.৩৩ মিটার। ভবনটির ছাদ নির্মাণ করা হয়েছিল ‘কোরিনথীয়’ রীতিতে। এর উপরে রয়েছে রেনেসাঁ যুগের কায়দায় নির্মিত ‘পেডিমেন্ট’। রূপলাল হাউজে দ্বিতীয় তলায় দুটি অংশে বিভিন্ন আয়তনের মোট ৫০টিরও বেশি কক্ষ রয়েছে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

আজিমপুর দায়রা শরীফ

আজিমপুর দায়রা শরীফ

আজিমপুর দায়রা শরীফ ঢাকার আজিমপুর এলাকায় অবস্থিত। দায়রা শরীফ খানকাহ একটি ঐতিহাসিক মাজার, এটি সাধারণত বড় দায়রা শরীফ নামে পরিচিত। দায়রা একটি ফার্সি শব্দ যার অর্থ “বৃত্ত” বা “কাজের এলাকা”। ১৭৬৬-৬৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় এসে শাহ সুফি সাইয়েদ মুহাম্মদ দায়েম আজিমপুর দায়রা শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন। শাহ সুফি সৈয়দ আহমদুল্লাহ জোবায়ের ১৯৯৮ সাল থেকে দায়রা শরীফের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক।

সুফি বংশের উত্তরসূরিরা গদ্দিনশিন নামে পরিচিত। যিনি মানুষের সেবা করার জন্য গদ্দি বা আসনের উপর বসেন তাকে গদ্দিনশিন বলা হয়। দায়রা শরীফের প্রধান মসজিদটি একটি ছোট আয়তাকার ভবন যেখানে চারটি অষ্টভুজাকার কোণার টাওয়ার রয়েছে, যা প্যারাপেটের উপরে উচুতে রয়েছে এবং কপোলা দ্বারা সমাপ্ত হয়েছে।

পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লা

পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লা

লালবাগ কেল্লা রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকায় অবস্থিত। লালবাগ কেল্লা নির্মাণের পরিকল্পনা সম্রাট আওরঙ্গজেব গ্রহণ করলেও তাঁর পুত্র যুবরাজ শাহজাদা আজম ১৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে লালবাগ দূর্গের নির্মাণ কাজ আরম্ভ করেন। লালবাগ কেল্লার প্রথম নাম ছিল আওরঙ্গবাদ দূর্গ বা আওরঙ্গবাদ কেল্লা।

১৮৪৪ সালে আওরঙ্গবাদ এলাকাটির নাম পরিবর্তন করে লালবাগ রাখা হয়। এলাকার নামের সাথে সাথে কেল্লাটির নামও পরিবর্তিত হয়ে লালবাগ কেল্লা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে লালবাগ কেল্লা জাদুঘর  হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পূর্বে এটি সুবেদার শায়েস্তা খাঁনের বাসভবন ও দরবার হল ছিল। লালবাগ কেল্লা প্রবেশ টিকেট মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা। লালবাগ কেল্লা রবিবার বন্ধ থাকে এবং সোমবার অর্ধ দিবসের জন্য বন্ধ থাকে।

বাহাদুর শাহ পার্ক

বাহাদুর শাহ পার্ক

বাহাদুর শাহ পার্ক একটি ঐতিহ্যবাহী উদ্যানের নাম। এটি পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত। ১৮৮৫ সালের ১৭-ই ফেব্রুয়ারী স্যার সলিমুল্লাহর পুত্র খাজা হাফিজুল্লাহ স্মরণে বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের পার্কে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। পার্কটি ডিম্বাকৃতি এবং পার্কটি লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা।

এর পূর্ব এবং পশ্চিম পাশে দুটো প্রধান ফটক বা গেট রয়েছে। পার্কটির ভেতরে রেলিং এর পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা করা হয়েছে। পার্কটিকে ঘিরে ৭টি রাস্তা একত্রিত হয়েছে। ১৯৫৭ সালে নবাব খান বাহাদুর পার্কটির নাম পরিবর্তন করে বাহাদুর শাহ পার্ক রাখেন। বাহাদুর শাহ পার্ক সপ্তাহের ৭ দিনই খোলা থাকে। ভোর ৫টা থেকে রাত ১০.৩০ মিনিট পর্যন্ত যে কোন সময়ই প্রবেশ করা যায়। প্রবেশে কোন টিকেট কাটার প্রয়োজন হয়না।

মোঘল তারা মসজিদ

মোঘল তারা মসজিদ

তারা মসজিদ পুরান ঢাকার আরমানিটোলা এলাকায় আবুল খয়রাত সড়কে অবস্থিত। ধারণা করা হয়, তারা মসজিদটি তৎকালীন ঢাকার জমিদার মির্জা গোলাম পীর ১৮ শতকের শুরুর দিকে নির্মাণ করেন। মসজিদটি মোঘল স্থাপত্য কৌশলে নির্মিত। মসজিদটি অনেকের কাছে সিতারা মসজিদ বা মির্জা গোলাম পীরের মসজিদ নামে পরিচিত। নির্মাণকালে মসজিদের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ছিল যথাক্রমে ৩৩ ও ১২ ফুট।

আয়তাকার মসজিদের ছাদে স্থাপন করা হয় নীল রঙের তারা খচিত সাদা বৃত্তাকার ৩ টি গম্বুজ। মসজিদের ভেতরে প্রবেশের জন্য পূর্ব দিকে ৩ টি, উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে ১ টি করে দরজা রাখা হয়। মসজিদটি তিনবার সংস্কার করা হয় এবং সংস্কার করার পর মসজিদটির বতর্মান দৈর্ঘ্য – প্রস্থ যথাক্রমে ৭০ এবং ২৬ ফুট।

ঢাকেশ্বরী মন্দির

ঢাকেশ্বরী মন্দির

ঢাকেশ্বরী মন্দির বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত একটি হিন্দু মন্দির। এই মন্দিরটিকে বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির ও বলা হয়। ঢাকেশ্বরী শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘ঢাকার ঈশ্বরী’। অনেকে মনে করেন, এই ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নাম থেকেই ঢাকার নামকরণ করা হয়েছে। সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি পাকিস্তানী বাহিনী কতৃক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী সময়ে মন্দিরের মূল নকশা অনুযায়ী পুননির্মাণ করা হয়। ঢাকেশ্বরী মন্দির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সলিমুল্লাহ হলের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঢাকেশ্বরী রোডে অবস্থিত। মন্দিরের মণ্ডপে রয়েছে ধাতু-নির্মিত দুর্গা দেবীর প্রতিমার স্থায়ী বেদী। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে ৪ টি শিব মন্দির ও সন্তোষী মাতার মন্দির।

পুরান ঢাকার বিখ্যাত খাবার

পুরান ঢাকা তার ঐতিহ্যবাহী খাবারের জন্য পুরো দেশব্যাপী অনেক বিখ্যাত। এখানকার খাবারগুলো সারাদেশেই অনেক জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত। এখানকার মানুষজন ভোজনরসিক। তারা খেতে অনেক পছন্দ করেন এবং ভালোবাসেন। দীর্ঘ ৪০০ বছরের অধিক সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকা মানেই বিখ্যাত সব সেরা খাবারের সমারোহ। পুরান ঢাকার বিখ্যাত খাবারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ মোরগ পোলাও, হাজির বিরিয়ানি, বাকরখানি ইত্যাদি।

হাজির বিরিয়ানি

হাজির বিরিয়ানি

পুরান ঢাকার বিখ্যাত সব খাবার গুলোর মধ্যে হাজির বিরিয়ানি অন্যতম। এটি পুরান ঢাকার অত্যান্ত জনপ্রিয় একটি খাবার। এই হাজির বিরিয়ানি পাওয়া যায় পুরান ঢাকার নাজির বাজারে। হাজির বিরিয়ানি রান্না করার পদ্ধতি নিম্নে লেখা হলো-

প্রথমে তেল গরম করে নিতে হবে এবং তার মধ্যে গরুর মাংস ভাজতে হবে। তারপর তেজপাতা, লবঙ্গ, দারুচিনি, এলাচ এবং আদা বাটা যোগ করতে হয়। তারপর রসুন এবং পেঁয়াজ বাটা যোগ করতে হয়। এরপর লাল মরিচ গুঁড়া এবং জিরা গুঁড়া যোগ করা হয়। তারপর বিরিয়ানি মসলা (দারুচিনি ২ টুকরা + এলাচ ৬/৭ টুকরা + লবঙ্গ ৪/৫ টুকরা + জয়ত্রী ২ + জায়ফল অর্ধেক + সাদা মরিচ ১ চা চামচ) যোগ করতে হয়। এরমধ্যে ২/৩ আলু টা যোগ করা হয়। এবং শুকনা ভাজা জিরা গুঁড়া ২ চা চামচ যোগ করা হয়। পরিশেষে, স্বাদ অনুযায়ী লবণ যোগ করতে হবে।

মোরগ পোলাও

মোরগ পোলাও

মোরগ পোলাও পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। পোলাওয়ের চাল আর মুরগির মাংস দিয়ে পোলাও এর এই বিশেষায়িত পদটি রান্না করা হয়। মুরগির মাংস দিয়ে এই পদটি রান্না করা হয় বিধায় এর নামকরণ করা হয়েছে মোরগ পোলাও। মোরগ পোলাও রান্না করার পদ্ধতি নিম্নে লেখা হলো-

প্রথমে মাংস ভাল করে ধুয়ে পানি ঝড়িয়ে রাখতে হবে এবং সেইসাথে পোলাও এর চাল ধুয়েও পানি ঝরিয়ে নিয়ে একপাশে রেখে দিতে হবে। তারপর হাড়িতে তেল গরম করে পেয়াজ কুচি হালকা ব্রাউন করে ভেজে নিয়ে তাতে গোটা মশলা দিয়ে দিতে হবে। এখন একটু নেড়েচেড়ে পেয়াজ বাটা দিয়ে দিন এবং কিচ্ছুক্ষণ নেড়ে জয়ফল জয়ত্রি বাটা ছাড়া একে একে সব বাটা মশলা,গুঁড়ো মশলা ও পরিমাণ মত লবন দিয়ে মাংসের পিস দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দিন এবং জয়ফল জয়ত্রি বাটা দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ভালভাবে কষিয়ে নিতে হবে।

কষানো হয়ে গেলে টকদই ও প্রয়োজনে পানি দিয়ে মাংস সেদ্ধ হওয়া অবধি রান্না করতে হবে এবং মাংস সিদ্ধ হয়ে গেলে হাড়ি থেকে মাংসগুলো আলাদা পাত্রে তুলে রেখে দিতে হবে। এবার মাংস তুলে নেয়ার পর মাংসের তেল মশলায় ঘি ও চাল এবং পরিমাণ মত লবন দিয়ে ক্ষিয়ে নিয়ে ভাজা ভাজা করে নিতে হবে। চাল কষানো বা ভাজা হয়ে গেলে চালের দ্বিগুণ গরম পানি দিয়ে দিন এবং লবণ চেক করে নিন।

পোলাও এর পানির বলক উঠলে চিনি দিয়ে নেড়েচেড়ে দিন এবং পোলাও হয়ে গেলে উপর থেকে অর্ধেক পোলাও তুলে রাখুন। এবার আলাদা করে তুলে রাখা মাংস পোলাও এর উপর ভাল করে বিছিয়ে দিয়ে বাকি তুলে রাখা পোলাও দিয়ে ভালভাবে মাংস ঢেকে দিন এবং উপরে পেয়াজ বেরেস্তা,মাওয়া,কেওড়া জল,কাঁচামরিচ এবং বাদাম কুচি ছিটিয়ে দমে রেখে দিন ১০/১৫ মিনিট।

খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি

খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি

পুরান ঢাকার বিখ্যাত, ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খাবারের তালিকা করলে সবার প্রথমেই নাম আসবে খাসির কাচ্চি বিরিয়ানির নাম। এটি পুরান ঢাকা অত্যান্ত জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার। বর্তমানে এটি সমগ্র বাংলাদেশেরই জনপ্রিয় একটি খাবার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই খাবারটি খেতে অনেক সুস্বাদু। খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করার পদ্ধতি নিম্নে লেখা হলো-

প্রথমে মাংস ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। এবার রান্নার হাঁড়িতে মাংস ঢেলে সব উপকরণ দিয়ে কিছুক্ষণ পাত্রটি ঢেকে রাখতে হবে। তারপর চাল ধুয়ে অন্য একটি হাঁড়িতে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ সেদ্ধ করে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। এবার মাংসের উপরে আগে থেকে ভেজে রাখা আলু ও সেদ্ধ করে নেওয়া চাল দিয়ে চুলায় বসিয়ে হাঁড়ির ঢাকনার চারপাশে আটা দিয়ে ডো তৈরি করে আটকে দিতে হবে। এভাবে চুলার উপর অল্প আঁচে রাখতে হবে আড়াই-তিন ঘণ্টা। এরপর ঢাকনা খুলে একটি কাঠি হাঁড়ির মাঝখানে দিয়ে দেখতে হবে ভেতরে কোনরকম পানি আছে কিনা। যদি পানি না থাকে তাহলে নামিয়ে গরম গরম পরিবেশন করতে হবে।

বাকরখানি

বাকরখানি

বাকরখানি পুরান ঢাকার অত্যান্ত জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার। খাবারটি পুরান ঢাকাবাসীদের সকালের নাস্তা হিসাবে একটি অতি প্রিয় খাবার। ময়দার খামির থেকে রুটি বানিয়ে তা মচমচে বা খাস্তা করে ভেজে বাকরখানি তৈরি করা হয়। পুরান ঢাকায় ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের বাকরখানি পাওয়া যায়। বাকরখানি রান্না করার পদ্ধতি নিম্নে লেখা হলো-

প্রথমে একটি বাটিতে ময়দার সঙ্গে লবণ ও ১ টেবিল চামচ সয়াবিন তেল মিশিয়ে নিন। অল্প অল্প পানি মিশিয়ে ডো তৈরি করুন। ডো যেন নরম হয়। এরপর একটি ভেজা কাপড় দিয়ে ডোটি ৩০ মিনিট ঢেকে রাখুন। অন্য আরেকটি পাত্রে আধা কাপ সয়াবিন তেলের সঙ্গে ভেজিটেবল সর্টেনিং অথবা ডালডা মেশান। এরপর রুটি বেলার জন্য একটি বড় জায়গা নির্বাচন করুন। জায়গাটি পরিষ্কার করে তেলের মিশ্রণটি ঘষে নিন। রুটি বেলার বেলুনিতেও মেখে নিন। রুটি বেলতে হবে বড় ও পাতলা করে। যতটুকু সম্ভব পাতলা করে বেলে হাতে তেলের মিশ্রণ নিয়ে ছড়িয়ে দিন রুটির ওপর।

পুরো রুটিতেই মাখতে হবে। একইভাবে উপরে ময়দা ছিটিয়ে মেখে নিন। এভাবে আরও এক লেয়ারে তেলের মিশ্রণ ও ময়দা ছড়িয়ে দিন। এবার রুটি মাঝ বরাবর ভাঁজ করুন। এক কোণার সঙ্গে আরেক কোণা মিলিয়ে মাঝ বরাবর ভেঙ্গে ভাঁজ করতে হবে। ভাঁজ করার পর অর্ধেক চাঁদের মতো দেখতে হবে রুটিটি। আগের মতো প্রথমে তেল ও পরে ময়দা ছিটিয়ে নিন ভাঁজ করা রুটির উপর। দুই লেয়ারে ময়দা ও তেল দিতে হবে। এবার নিচ থেকে দুই কোণা টেনে মাঝে নিয়ে আসুন। মাঝের ফাকা অংশটি টেনে লাগিয়ে দিন। আবারো তেলের মিশ্রণ ও ময়দা দিন দুই লেয়ারে।

শেষ ভাঁজটি করুন তিনদিক থেকে কোণা টেনে মাঝে নিয়ে এসে। উপরের অংশ থেকে ভাঁজ করে রোল করে নিন। এবার ছোট ছোট করে লেচি কেটে নিন রোল থেকে। খুব বেশি মোটা বা পাতলা করবেন না। ছুরির সাহায্যে কয়েকটি দাগ কেটে নিন উপরে। বেকিং ট্রেতে একটি একটি করে বাকরখানি রাখুন। সামান্য ফাঁকা করে রাখবেন যেন একটির সঙ্গে আরেকটি লেগে না যায়। ৩৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে প্রি হিট করা ওভেনে ৩০ মিনিট বেক করুন।

পুরান ঢাকার লাচ্ছি

পুরান ঢাকার লাচ্ছি

লাচ্ছিও পুরান ঢাকা জনপ্রিয় একটি খাবার। এটি মূলত বিরিয়ানি বা পোলাও খাওয়ার পর পান করা হয়। বিশেষ করে, প্রচন্ড গরমে এই আইটেমটি অতুলনীয়। লাচ্ছি রেসিপি অবশ্যই আপনার শরীরের সতেজতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। লাচ্ছি রান্না করার পদ্ধতি নিম্নে লেখা হলো-

প্রথমে পানি কুসুম গরম করে নিন। এখন এর সাথে গুড়ো দুধ টাকে খুব ভালো মতো মিশিয়ে নিন। এর পরে এতে লেবুর রস মিশিয়ে ভালো ভাবে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখুন। আট থেকে দশ মিনিট পর আপনি দেখতে পাবেন দুধ জমাট বেধে গিয়েছে। এইবার এই জমাট বাধা দুধ গুলোর সাথে পরিমান মতো চিনি, অর্ধেক পরিমানে বরফ কুচি এবং বাদাম কুচি দিয়ে ভালো ভাবে ব্লেন্ড করে নিন।

ব্লেন্ড করার পর চামচ  দিয়ে চিনির পরিমান টা চেক করে নিন। প্রয়োজন হলে আরো চিনি দিন এবং আবার ব্লেন্ড করে নিন। এখন এর মধ্য আবার বরফ কুচি দিন। এবং সব কিছু ঠিক ঠাক আছে কিনা চেক করে গ্লাসে ঢালুনা গ্লাসে ঢেলে এর মধ্যে কিছু পরিমান বরফ কুচি দিয়ে দিন। সর্বশেষে, এর মধ্যে আইসক্রিম দিয়ে দিন এবং পরিবেশন করুন।

 

শেষ কথা

প্রিয় পাঠক, আশা করি আর্টিকেলটি আপানাদের পছন্দ হয়েছে। আজকের এই আর্টিকেলে আপনারা পুরান ঢাকা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পেরেছেন। এখানে আমি আপনাদের জানিয়েছি পুরান ঢাকার পরিচিতি ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, এখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো কি কি এবং পুরান ঢাকার দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে। আপনারা চাইলে পুরান ঢাকাতে গিয়ে এসব দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণ করে আসতে পারেন এবং সেই সাথে সেখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদও গ্রহণ করতে পারেন।

আরও পড়ুনঃ- সিলেটের ১০টি দর্শনীয় স্থান ও ভ্রমণ গাইড।

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইসলামী ব্যাংক শাখা সমূহ ও রাউটিং নাম্বার দেখে নিন

ঢাকা জেলার পোস্ট কোড ও এরিয়া কোড জেনে নিন