সিলেট ভ্রমন পিপাসুদের জন্য একটি রুপকথার স্বর্গরাজ্য। নানান ইতিহাস ঐতিহ্য, লোক-সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দয্য, খাবার-দাবার ইত্যাদি বিষয় সিলেটকে অন্য সকল জেলা ও বিভাগ থেকে পৃথক করেছে। দুটিপাতা এবং একটি কুঁড়ির দেশ হিসেবে পরিচিত সিলেট। সিলেট কে সারা দেশব্যাপী ৩৬০ আউলিয়ার দেশ হিসেবে সবাই চিনে। এছাড়া ও সিলেটের রয়েছে প্রসিদ্ধ একটি ইতিহাস। চা বাগানের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত সিলেটের দর্শনীয় স্থান এর যেন শেষ নেই।
সিলেট জেলার সংক্ষিপ্ত পরিচয়
সিলেট বাংলাদেশের উত্তর-পুর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি জেলা যা প্রাচীন জনপদ হিসেবে পরিচিত। সিলেট জেলা সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত একটি সীমান্তবর্তী জেলা। স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে সিলেট জেলা ভারতের আসাম রাজ্যের একটি জেলা ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর একটি গণভোটের আয়োজন করা হয়। যার মাধ্যমে সিলেটে বসবাসকারীরা পাকিস্তানের অংশ হতে চায় এবং বর্তমানে সিলেট বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়।
সিলেট জেলার মোট আয়তন ৩,৪৯০.৪০ বর্গ কি. মি.। জনশুমারী ২০২২ অনুযায়ী সিলেটের মোট জনসংখ্যা ৩৮,৫৩,৫৭০ জন। ১ টি সিটি কর্পোরেশন, ১৩ টি উপজেলা, ১৭ টি থানা, ৫ টি পৌরসভা, ১০৬ টি ইউনিয়ন পরিষদ, ১৬৯৩ টি মৌজা, ৩৪৯৭ টি গ্রাম ও ৬টি সংসদীয় আসন নিয়ে সিলেট জেলা গঠিত।
বনজ, খনিজ ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এ জেলা দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী ও বিশ্বের দ্বিতীয় লন্ডন হিসেবে খ্যাত।
সিলেট জেলার অবস্থান
ঢাকা থেকে সিলেট জেলার দূরত্ব প্রায় ২৩৫ কিলোমিটার। এ জেলার অবস্থান ২৪°৩৬´ থেকে ২৫°১১´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°৩৮´ থেকে ৯২°৩০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। এছাড়া সিলেট জেলার সীমানা উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে মৌলভীবাজার জেলা, পূর্বে ভারতের আসাম রাজ্য, পশ্চিমে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা।
সিলেটের দর্শনীয় স্থান
ভ্রমন পিপাসু সহ সাধারণ মানুষের কাছে সিলেটের দর্শনীয় স্থান গুলো খুবই প্রিয়। দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী হিসেবে সিলেটে রয়েছে চা বাগান, জাফলং, রাতারগুল জলাবন, লালাখাল, হাকালুকি হাওর, ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, তামাবিল, পাহাড়, ঝর্ণা ইত্যাদি। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা সিলেটের দর্শনীয় স্থান গুলোর বিস্তারিত আলোচনা করবো-
সিলেটের দর্শনীয় স্থান জাফলং
সারা বাংলাদেশে প্রকৃতি কন্যা হিসেবে পরিচিত জাফলং। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে জাফলং অবস্থিত। সিলেট শহরের জিরো পয়েন্ট হতে ৬২ কিলোমিটার দূরে গোয়াইন ঘাট উপজেলায় জাফলং অবস্থিত। অনেক আগে থেকেই সিলেটের দর্শনীয় স্থান হিসেবে জাফলং পরিচিত। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ গুলো জাফলংকে অপরুপ করেছে। সীমান্তের ওপারে ভারতের পাহাড় টিলা। তাছাড়া ও আছে ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরামধারায় নেমে আসা জলপ্রপাত।
ঘন বন জঙ্গল, পাথরের স্তুপ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানির শুনশান নিরবতার কারণে দর্শনার্থীদের দারুন ভাবে আকৃষ্ট করে এই স্থানটি। দেশী-বিদেশী পর্যটকরা এসব দৃশ্যপট দেখতে প্রতিদিনই এখানে ছুটে আসেন। শীত ও বর্ষা মৌসুমে জাফলং তার আসল রুপ লাবন্য ভিন্ন মাত্রায় ফুটিয়ে তুলতে পারে।
সিলেটের দর্শনীয় স্থান মায়াবী ঝর্ণা
জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ১৫-২০ মিনিট হাঁটলে মায়াবী ঝর্না দেখতে পাওয়া যায়। ঝর্ণাটি ভারতের সীমান্তে অবস্থিত, তবে আপনি চাইলে বিএসএফ এর অনুমতি নিয়ে এর চুড়ায় উঠতে পারবেন। ঝর্ণার চুড়া থেকে মেঘালয় পাহাড়ের বয়ে যাওয়া গর্জন শোনা যায়। ঝর্ণার হাড় কাপানো পানি সবসময় বহমান থাকে। এখানে পাথর আর পানির মেলবন্ধন দেখতে পাওয়া যায়।
মায়াবী ঝর্ণার পানি খুবই স্বচ্ছ। বর্ষাকালে এই ঝর্ণার পানির প্রবাহ বাড়ার সাথে সাথে এখানে বাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের সংখ্যাও।
সিলেটের দর্শনীয় স্থান হাকালুকি হাওর
বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় হাওর হচ্ছে হাকালুকি হাওর। হাকালুকি হাওর সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। এই হাওরে যেতে আপনাকে সর্ব প্রথম সিলেট জেলা হতে ফেঞ্চুগঞ্জ সদরে যেতে হবে। সেখান থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে ঘিলাছড়া জিরো পয়েন্টে হাকালুকি হাওরের অবস্থান।হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮১.১৫ বর্গ কিলোমিটার। হাওরটি ৫টি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। এই হাওরে প্রায় ২৩৮টি বিল রয়েছে।
মাছের জন্য বিখ্যাত এই হাওরে শীতকালে অতিথি পাখিদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠে। এছাড়াও এই হাওরে প্রায় ১০০ প্রজাতির স্থানীয় পাখিদের দেখা যায়। হাওরে বিস্তির্ন ভুমি, বিল নির্ভর মানুষের জীবন যাত্রা, এবং অতিথি পাখির আগমনে ভ্রমন পিপাসুরা হাকালুকি হাওরের সৌন্দয্য দেখতে ছুটে আসে। হাকালুকি হাওর ভ্রমনের উপযুক্ত সময় হচ্ছে এপ্রিল-অক্টোবর পর্যন্ত।
সিলেটের দর্শনীয় স্থান রাতারগুল
রাতারগুল জলাবন বা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন বা সোয়াম্প ফরেস্ট এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যা সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত। রাতারগুলে যেতে হলে আপনাকে প্রথমে সিলেট জেলা হতে কদমতলী বাস স্ট্যান্ডে যেতে হবে, সেখান থেকে ২৬ কিলোমিটার দুরেই রাতারগুলের অবস্থান।
রাতারগুল জলাবনের আয়তন ৩,৩২৫.৬১ একর, এর মধ্যে ৫০৪ একর বনকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সারা পৃথিবীতে স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশে আছে দুটি। একটি শ্রীলংকায়, আরেকটি বাংলাদেশের রাতারগুল। রাতারগুল জলাবন বা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট পৃথিবীর অন্যতম বড় বন অ্যামাজনের সাথে তুলনা করা হয়।
অ্যামাজনের সাথে তুলনা করার অন্যতম কারণ হল এই বনের বেশির ভাগ গাছ গুলো ৪ থেকে ৭ মাস পানির নিচে ডুবে থাকে। এই বনে সাপের বসবাস অনেক বেশি। এছাড়া রয়েছে বানর, গুঁইসাপ, সাদা বক, কানা বক, মাছরাঙ্গা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল এবং বাজপাখি। রাতারগুল জলাবনে আপনি বছরের যেকোন সময়ে ঘুরতে যেতে পারবেন। তবে বর্ষাকালে এ বনের সৌন্দয্য অনেক বেশিই দেখা যায়।
সিলেটের ভোলাগঞ্জ
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে দেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারীর অবস্থান। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে বর্ষাকালে ঢল নেমে আসে, ধলাই নদীতে ঢলের সাথে প্রচুর পরিমাণে ছোট বড় অনেক সাদা পাথর। পরের বছর বর্ষা আসার আগ পর্যন্ত চলে পাথর সংগ্রহ। ভোলাগঞ্জ হতে ২০ মিনিটের ইঞ্জিন নৌকা দূরত্বে রয়েছে বিশেষ কোয়ারী’র অবস্থান। সীমান্তের অনেক কাছে হওয়ায় এই জায়গাকে বিশেষ কোয়ারী বলা হয়। সেখানে থেকে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য প্রাণ ভরে উপভোগ করা যায়।
পান্থুমাই ব্রিজ বা ঝর্ণা
বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে অবস্থিত মেঘালয় পাহাড়ের কোল ঘেষা একটি অপূর্ব গ্রামের নাম পান্থুমাই। এই গ্রামেই পান্থুমাই ঝর্ণা ও ব্রিজ অবস্থিত। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের এই গ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম।
পান্থুমাই ঝর্ণাকে অনেকে ফাটাছড়ির ঝর্ণা বা বড়হিল ঝর্ণা বলে ডাকে। ঝর্ণার মুল অবস্থান ভারতে হলেও ১০০ টাকা ভারা দিয়ে ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ঝর্ণার খুব কাছে যাওয়া যায়। অপূর্ব সুন্দর এই ঝর্ণা দেখতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক এখানে আসেন। পান্থুমাই ঝর্ণা দেখার উপযুক্ত সময় হচ্ছে বর্ষাকাল, কারণ এই সময় চারদিকে প্রচুর পানি থাকে।
হযরত শাহ্ জালাল (রঃ) মাজার
সিলেটের মাটিতে যেসব পীর দরবেশ শায়িত আছেন তাদের মধ্যে হযরত শাহ্ জালাল (রঃ) ছিলেন অন্যতম। এ জন্য তাকে ওলিকুল শিরোমণি বলা হয়। প্রতি বছর ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের ঢল নামে হযরত শাহ্ জালাল (রঃ) মাজার জিয়ারত করতে। হযরত শাহ্ জালাল (রঃ) মাজারের উত্তর দিকে একটি বড় পুকুর আছে, পুকুরে সোভা বর্ধন করে আছে অসংখ্য গজার মাছ।
এছাড়াও হযরত শাহ্ জালাল (রঃ) মাজারের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে জালালি কবুতর। সিলেট বাস স্ট্যান্ড হতে সিএনজি বা অটোরিকশা দিয়ে খুব সহজেই মাজারে যাওয়া যায়। সাধারণত রিকশায় গেলে ভারা লাগে ২০ থেকে ২৫ টাকা। আর সিএনজিতে গেলে ৮০ থেকে ১০০ টাকা ভারা লাগে।
সিলেটের মালনিছড়া চা বাগান
উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান হচ্ছে মালনীছড়া চা বাগান যা ইংরেজ সাহেব হার্ডসনের হাত ধরে ১৮৪৯ সালে ১৫০০ একর জায়গা জুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সিলেটের চা বাগানের খ্যাতি রয়েছে সারা বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশের মোট ১৬৩ টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৫ টি রয়েছে বৃহত্তর সিলেটে। অর্থাৎ দেশের মোট চায়ের ৯০ শতাংশই উৎপন্ন হয় সিলেটে। এজন্য সিলেটকে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশও বলা হয়।
বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ হলেও প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে অন্য এক ভালোলাগার ধারক হয়ে আছে সিলেটের এই চা বাগান। তাই ছুটির অবসরে কিংবা বৈকালিক বিনোদনের তৃষ্ণা মেটাতে পর্যটকরা ছুটে যান চা বাগানের সবুজ অরণ্যে। সারাটা বিকাল চলে সবুজের ভেতর লুকোচুরি, হৈ হুল্লোড় আর আনন্দে অবগাহন।
মালনিছড়া চা বাগানের প্রবেশদ্বার বেশ কয়েকটি। আপনি চাইলে যে কোন একটি পথ দিয়েই চা বাগান দর্শনের কাজ শুরু করে দিতে পারেন। তবে ঝামেলা এড়াতে বাগানে প্রবেশের আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়াই বাঞ্চনীয়। তারপর ঘুরে দেখেন বাগানের এপাশ থেকে ওপাশ। দেখে আসতে পারেন বাগানের বাংলো। মালনিছড়ার পাশেই রয়েছে আলী বাহার চা বাগান। ঘুরে আসতে পারেন ওখান থেকেও।
সিলেটের দর্শনীয় স্থান বিছানা কান্দি
বিছানাকান্দি বাংলাদেশের সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় রুস্তমপুর ইউনিয়নের একটি গ্রামের মধ্যে অবস্থিত। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে খাসিয়া পাহাড়ের অনেক গুলো ধাপ দুই পাশ থেকে এক বিন্দুতে এসে মিলেছে। পাহাড়ের খাঁজে রয়েছে সুউচ্চ ঝর্ণা।
বিছানাকান্দির মূল আকর্ষণ হলো পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলা পানি প্রবাহ। পূর্ব দিক থেকে পিয়াইন নদীর একটি শাখা পাহাড়ের নীচ দিয়ে বয়ে চলে গেছে ভোলাগঞ্জের দিকে। পাহাড়, নদী, ঝর্ণা আর পাথরের এক সম্মিলিত ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই বিছনাকান্দি। বিছনাকান্দি ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হচ্ছে বর্ষাকাল।
শেষ কথা
সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থান এর কোন কমতি নেই। আমরা যারা অল্প সময়ের জন্য ভ্রমণ করতে বের হই, তাদের জন্য সিলেট বেশ উপযোগী। ২ থেকে ৩ দিনের ছুটিতে আপনি চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন সিলেট থেকে।
Leave a Comment