গলা ব্যথা কি? গলা ব্যথার কারণ ও ব্যথা কমানোর ঘরোয়া চিকিৎসা

গলা ব্যথার কারণ ও ব্যথা কমানোর ঘরোয়া চিকিৎসা

আমাদের মানবদেহে যত ধরণের সমস্যা দেখা দেয় তার মধ্যে একটি সমস্যা হচ্ছে গলা ব্যথা। আর এই গলা ব্যথার কারণ আমরা অনেকে জানি না, কিন্তু আমাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এটি একবার হলেও হয়েছে। এটি হওয়ার ফলে আমাদের গলায় প্রচন্ড রকমের অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। এই সমস্যাটি হয়ে থাকে সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, ঋতু পরিবর্তন, বহুক্ষণ কথা বলা ইত্যাদি কারণে।

গলা ব্যথার কারণ বিভিন্ন অসুখের জন্যে হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গলা ব্যথা কোন ওষুধ ছাড়া সেরে গেলেও অনেক সময় আবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। আবার কিছু সময় ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ঘরোয়া উপায়েও এই গলা ব্যথা সারানো যায়। আজকের এই আর্টিকেলে আমি আপনাদের জানাবো গলা ব্যথার কারণ কি, গলা ব্যথা হলে কি কি লক্ষণ দেখা দেয় এবং কীভাবে ঘরোয়া উপায়ে এই গলা ব্যথা সারানো যায়। তাহলে শুরু করা যাক-

গলা ব্যথা কি

গলা ব্যথা কি?

গলা ব্যথাকে ইংরেজিতে বলা হয় ফ্যারিঞ্জাইটিস (Pharyngitis)। এটি একটি খুবই সাধারণ উপসর্গ যা সব বয়সী মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। এই অবস্থায় গলা লাল হয়ে যায় এবং ফুলে যায়। খাদ্য গিলতেও অসুবিধা হয়। তীব্র গলা ব্যথার কারণ হচ্ছে ভাইরাস। প্রধানত ঠান্ডা ও ফলু (ইনফ্লুয়েঞ্জা) এর জীবাণুর সংক্রমণে গলায় এ ধরণের সমস্যা হতে দেখা যায়। এছাড়াও ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য সংক্রমণকারীরাও এর জন্য দায়ী। গ্রুপ এ স্ট্রেপটোকক্কাস (জি-এ-এস) হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাকটেরিয়া যা গলা ব্যথার কারণ।

গলা ব্যথার কারণ সমূহ

গলা ব্যথার কারণ সমূহ

চিকিৎসকদের মতে, গলা ব্যথার কারণ অনেকগুলো বিষয় দায়ী যার মধ্যে ভাইরাসজনিত অসু্‌স্থ্যতা যেমন ঠান্ডা, ফ্লু, মনোনিউক্লিওসিস অন্যতম। আবার অনেক সময় এলার্জি, হাম, চিকেনপক্স, ভাইরাল ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের কারণেও গলা ব্যথা হতে পারে। গলা ব্যথার আরোও যেসব কারণ সমূহ রয়েছে নিচে সেগুলো লেখা হলো। যথা-

  • ভাইরাল সংক্রমণঃ গলা ব্যথার কারণ গুলোর মধ্যে প্রধান হতে পারে ভাইরাল সংক্রমণ। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাল সংক্রমণ যেমন সাধারণ সর্দি-কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জাকে গলা ব্যথার প্রাথমিক কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যার ফলে গলায় অস্বস্তি ও ব্যথা অনুভব হয়।
  • এলার্জিঃ এমন অনেক মানুষই আছেন যাদের কোনো না কোন খাবার থেকে এলার্জি থাকতে পারে। মানুষের গলা একটি সংবেদনশীল জায়গা হওয়ায় এসব এলার্জিযুক্ত খাবার যখন গলার সংস্পর্শে আসে তখন গলাতেই সর্বপ্রথম এর প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। তাই এই রকম খাবার থেকে সবসময় দূরে থাকায় ভালো।
  • ব্যাকটেরিয়া সংক্রান্তঃ অনেক সময় ব্যাকটেরিয়ার কারণেও গলা ব্যথা হয়। আর ব্যাকটেরিয়ার কারণে যে গলা ব্যথা হয় সাধারণত তাকে স্ট্রেপ থ্রোট বলে। সাধারণ সর্দিকাশির কোনো লক্ষণ এই গলা ব্যথায় প্রকাশ পাবে না।
  • টনসিলঃ আমাদের মানবদেহে সকলেরই গলার ভেতরের দু’পাশে দুটি প্যালাটিন টনসিল থাকে। এগুলো এক ধরনের লসিকাগ্রন্থি বা লিম্ফয়েড টিস্যু বলা হয়। আর টনসিলের কারণে যদি আমাদের গলা ব্যথা হয় তাহলে আমরা এদের ইনফেকশনকেই বুঝি।
  • শুষ্ক বাতাসঃ শীতের সময় বা শুষ্ক জলবায়ুতে যখন ঘরের ভিতরের গরম বাতাস থেকে আর্দ্রতা সরে যায়, তখন গলায় অস্বস্তি বা গলা জ্বালা করতে পারে।
  • টিউমারঃ অনেক সময় টিউমার থেকেও গলা ব্যথা হতে পারে। গলায় টিউমার দেখা দিলে সঠিক সময়ে যদি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা না করা হয় তাহলে শরীরের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করতে পারে। তাই গলায় টিউমার শনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
  • বাহ্যিক আঘাতঃ গলার আশেপাশে কোনো বাহ্যিক আঘাত থেকেও গলায় ব্যথা হয়। তাই কোনসময় যদি গলার আশেপাশে ব্যথা পান তাহলে বসে না থেকে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহন করুন।
  • পরিবেশগত কারণঃ অনেক সময় দূষিত পরিবেশের কারণেও গলা ব্যথা হতে পারে। নোংরা ধোঁয়া, তীব্র গন্ধের কারণে গলার ইসোফেগাসে ব্যথা হতে পারে।

কাদের গলায় ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি বেশি

কাদের গলায় ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি বেশি ?

গলা ব্যথা একটি খুবই সাধারণ উপসর্গ যা সব বয়সী মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। এটা যে শুধু ছোটদের হবে বয়স্কদের হবে না বা বয়স্কদের হবে ছোটদের হবে না এমনটা নয়। শিশু থেকে বৃদ্ধ যেকোন বয়সের মানুষেরই গলায় ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এমন অনেকেই আছেন যাদের গলায় ব্যথা হওয়ার ঝুঁকিটা একটু বেশি। নিচে সে সম্পর্কে লেখা হলো-

  • যাদের ধূলা-বালি থেকে এলার্জির সমস্যা রয়েছে।
  • যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম রয়েছে।
  • শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা যারা ধুলা বালির সংস্পর্শে বেশি আসে।
  • যারা সাইনাসের সমস্যায় ভুগছেন।
  • যারা ঘরে ব্যবহার করা জ্বালানী ও রাসায়নিক বস্তুর সংস্পর্শে আসে।
  • যারা ঠান্ডায় বেশি সংবেদনশীল।
  • ধূমপান কারী ব্যক্তি বা পরোক্ষ ভাবে যারা ধূমপায়ী ব্যক্তির খুব কাছাকাছি থাকে।

গলা ব্যথার বিভিন্ন উপসর্গ

গলা ব্যথা যদি মারাত্মক ভাবে বেড়ে যায় তাহলে অনেক সময় টনসিল দেখা দেয়। এতে করে আমাদের গলা ব্যথা আরোও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। ফলে কারোও যদি গলায় এই রকম অবস্থা দেখা দেয় তাহলে বসে না থেকে খুব দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। টনসিল ছাড়াও গলা ব্যথা হলে আরোও যে উপসর্গগুলো দেখা দেয় নিচে তা লেখা হলো-

  • শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফুসকুড়ি দেখা দেয়।
  • ঢোক গিলতে বা খাবার খেতে অসুবিধা হয়।
  • বমি হয়।
  • গলা ব্যথা মরাত্মক আকার ধারণ করে।
  • অতিরিক্ত মাথা ব্যথা করে।
  • গলার টনসিল ফুলে লালচে হয়ে যায়।
  • অনেক সময় গলায় বা টনসিলে পুঁজও দেখা দেয়।
  • ৬ মাসের নীচে বয়সী শিশুদের জ্বর ১০১ ফারেনহাইট এবং বড়দের ক্ষেত্রে তা ১০৩ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে যায়।

গলা ব্যথার লক্ষণসমূহ

গলা ব্যথার লক্ষণসমূহ

আমাদের গলায় যখন ব্যথা হয় তখন বেশ কিছু লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। আমরা ইতি মধ্যে জেনেছি গলা ব্যথার কারণ হয় সাধারণত ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, ঠাণ্ডা লাগা, ঋতু পরিবর্তন, বহুক্ষণ কথা বলা ইত্যাদি। যখন গলা ব্যথা হয় তখন আমাদের খাবার খাওয়ার পাশাপাশি পানি খেতেও অসুবিধা হয়। আমরা ঠিকভাবে ঢোক গিলতে পারি না। গলা ব্যথা হলে আরোও যে লক্ষণগুলো দেখা দেয় নিচে সেগুলো লেখা হলো-

  • গলা খুশখুশ করে।
  • ঢোক গিলতে সমস্যা হয়।
  • গলায় শুষ্ক ভাব দেখা দেয়।
  • গলা জ্বালাপোড়া করে।
  • কিছু খাওয়ার সময় বা কথা বলার সময় গলায় ব্যথা অনুভূত হয়।
  • গলায় কফ জমে যায়।
  • গলায় ফোলাভাব ও লালচে ভাব দেখা দেয়।

গলা ব্যথা কমানোর ঘরোয়া চিকিৎসা

গলা ব্যথা কমানোর ঘরোয়া চিকিৎসা

আমরা গলা ব্যথার কারণ ও লক্ষণ গুলো জেনেছি এবং কিভাবে এর ঘরোয়া চিকিৎসা করতে হয় না নিয়ে আলোচনা করব। গলা ব্যথা সাধারণত দুই-তিনদিন কিংবা বড়জোড় হলে এক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকে। তারপর এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। আবার অনেক সময় এই ব্যথা সহজে ভালো হতে চাই না। সেক্ষেত্রে দেখা যায় এর প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। তখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পারেন কিংবা ঘরোয়া কিছু টিপস ব্যবহার করলেই এ ব্যথা থেকে উপশম পাওয়া যায়। নিচে গলা ব্যথা কমানোর ঘরোয়া কিছু চিকিৎসার কথা লেখা হলো-

প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুনঃ গলায় যদি কখনো ব্যথা অনুভব করেন তখন সর্বপ্রথম গলাকে বিশ্রাম দিতে হবে। একে কোনভাবেই শুষ্ক রাখা যাবে না। কিছুক্ষণ পর পরই কুসুম গরম পানি পান করতে হবে।

লেবুঃ লেবুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। আর এই ভিটামিন সি আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এতে রয়েছে অ্যান্টিইনফ্লেমেটারি উপাদানসমূহ যা গলার প্রদাহ দূরে রাখে। ফলে কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে গলা ব্যথা হলে লেবুর রস পান করুন।

গরম পানি ব্যবহার করুনঃ আমাদের যখন গলা ব্যথা হয় তখন গরম পানি আমাদের গলার জন্য অত্যন্ত উপকারী হয়ে থাকে। তাই গলা ব্যথার সময় পানি হালকা করে গরম করুন এবং তা পান করুন।

মধুঃ মধুর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান‌। যা গলার অস্বস্তি থেকে প্রশান্তি দিতে সহায়তা করে। তাই অনেকেই গলা ব্যথা হলে চায়ের সাথে মধু মিশিয়ে খেয়ে থাকে। আবার যাদের মধুতে এলার্জি আছে তাদের এই পদ্ধতি ব্যবহার না করাই উত্তম।

কুসুম গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করুনঃ যাদের গলায় ব্যথা হয় তারা চাইলে পানি গরম করার সময় তাতে সামান্য লবণ দিয়ে ওই পানি মুখের মধ্যে নিয়ে গড়গড়া করুন। গড়গড়া করলে গলার একাধিক সমস্যা উপশম করতে সহায়তা করে। একইসঙ্গে লবণ পানি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও সহায়তা করে। তাই কখনো গলা ব্যথা করলে এটি অ্যাপ্লাই করে দেখতে পারেন।

 যেকোন বয়সের মানুষেরই গলায় ব্যথা

মেথিঃ মেথিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান রয়েছে। ফলে ক্ষতিকর ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে যদি গলা ব্যথা হয় তখন মেথি ব্যবহার করে দেখতে পারেন। এটি অনেক কাজে দিবে। কিন্তু গর্ভবতী নারীদের জন্য মেথি থেকে দূরে থাকাই উত্তম।

প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিবায়োটিকঃ এতো কিছু করার পরেও যদি দেখেন গলা ব্যথা ভালো হচ্ছে না এবং আপনার ঔষধ ব্যবহার করতে হবে তাহলে প্রাথমিক পর্যায়ে প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন। তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কিন্তু ভুলেও নিজে নিজেই অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করবেন না। এতে করে হিতে বিপরীত হতে পারে।

আদা ও রসুনের ব্যবহারঃ আদাতে রয়েছে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন এক টুকরো আদা টনসিলের কারণে হওয়া গলা ব্যথা দূরে রাখে। আর রসুনের জীবাণু ধ্বংস করার ক্ষমতা অকল্পনীয়। এতে থাকা প্রদাহনাশক গলার ব্যথা উপশম করতে অধিক কার্যকরী।

গোলমরিচঃ গোলমরিচের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। গোলমরিচে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি উপাদান যা গলা ব্যথা সহ গলার বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

কম কথা বলাঃ আমাদের অনেকেরই কাজের ক্ষেত্রে অনেক বেশি কথা বলতে হয়। যেমনঃ শিক্ষক, গায়ক এতে করে আমাদের গলার উপর একটি প্রভাব পড়ে ফলে এর থেকেও আমাদের গলা ব্যথা হতে পারে। তাই যতটা সম্ভব চেষ্টা করতে হবে কম কথা বলার।

শেষ কথা

প্রিয় বন্ধুরা, আশা করি আজকের এই আর্টিকেল পড়ে আপনারা জানতে পেরেছেন গলা ব্যথার কারণ, গলা ব্যথা হলে কি কি লক্ষণ দেখা দেয় এবং কীভাবে ঘরোয়া পদ্ধতিতে এই গলা ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অনেকসময় গলা ব্যথা একটি অস্বস্তিকর ও বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা দিতে পারে। গলা যেহেতু একটি অতি সংবেদনশীল অঙ্গ। তাই যতটুকু সম্ভব গলার যত্ন নেওয়া এবং পরিচর্যা করা। ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন।

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *