কাঁচা হলুদ খাওয়ার নিয়ম । কাঁচা হলুদের উপকারিতা ও অপকারিতা

কাঁচা হলুদ খাওয়ার নিয়ম । কাঁচা হলুদের উপকারিতা ও অপকারিতা

রান্না হোক বা রুপচর্চায় আমাদের অন্যতম একটি পরিচিত উপাদান হলো হলুদ। আমরা ছোট থেকেই কমবেশি হলুদের গুণাগুণ সম্পর্কে জানি। ত্বকের সমস্যা, শরীরের সমস্যা, পেটের সমস্যা সবকিছুতেই সমানভাবে কার্যকরী এই হলুদ। আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শাস্ত্রে শুরু থেকেই বিভিন্ন ত্বক পরিচর্যাকারী ওষুধ তৈরি করতে কিংবা স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরি করতে এর ব্যবহার হয়ে চলেছে।

আজকের এই আর্টিকেলে কাঁচা হলুদের উপকারিতা এবং এর খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও কাঁচা হলুদের অপকারিতাগুলো জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

কাঁচা হলুদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

কাঁচা হলুদ হলো একটি অতি প্রাচীন আয়ুর্বেদিক ঔষধ এবং মশলা যা প্রাচীন ভারতের সময়কাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর ইংরেজী  প্রতিশব্দ হলো Untried Turmeric এবং বৈজ্ঞানিক নাম Curcuma longa। এটি মূলত গাছের কন্দমূল থেকে সংগ্রহণ করা হয়। হলুদে রয়েছে নানবিধ উপাদান এবং বিভিন্ন ভিটামিন।

দক্ষিণ এশিয়া হলো হলুদ গাছের আদি উৎস। এটি ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে জন্মে থাকে। কাঁচা হলুদ একটি মশলা যা সাধারণত বাংলাদেশ, ভারত এবং পৃথিবীর বিভিন্ন  দেশের রান্নায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

কাঁচা হলুদের উপকারিতা

কাঁচা হলুদের উপকারিতা

রান্নার কাজে কমন একটি উপাদান হলো হলুদ। যা খাবারের কালার, খাবারের গন্ধ ও স্বাদ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। কাঁচা হলুদে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টেন্ড এবং অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান। এই উপাদান গুলো স্বাস্থ্যের জন্য নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনতে পারে।  চলুন জেনে 

নিই কাঁচা হলুদের উপকারিতাগুলো:-

ওজন কমাতে কাঁচা হলুদ:- কাঁচা হলুদে বিদ্যমান অ্যান্টি ওবেসিটি গুণ যা শরীরে বাড়তি মেয়াদ জমতে দেয় না এবং মেটালিজমের হাড় বাড়ায়। ফলে কাঁচা হলুদ  শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে একটি কার্যকরী উপাদান।

লিভার ভালো রাখতে কাঁচা হলুদ:- লিভার আমাদের দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। হলুদে বিদ্যমান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান, যা যেকোনো ধরনের লিভারের চিকিৎসা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ক্যান্সার প্রতিরোধে কাঁচা হলুদ: ত্বকের ক্যান্সার এবং ওলড পেডের মতো রোগ নিরাময়ে কাঁচা হলুদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হলুদে থাকা প্রতিরোধ মূলক উপাদানগুলো ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়াও এই উপাদান ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি কমায়ে  শরীরকে সুস্থ রাখে।

সর্দি কাশি দূর করতে কাঁচা হলুদ:- হলুদ সর্দি কাশি দূর করতে সাহায্য করে। এতে থাকা ভিটামিন সি সর্দি কাশির মতো সমস্যা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৃদ্ধিতে কাঁচা হলুদ:- কাঁচা হলুদ শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর উপাদান বৃদ্ধি করে যা শরীরকে অ্যানিমিয়ার হাত রক্ষা করে। মূলত মেয়েদের ক্ষেত্রে অ্যানিমিয়ার হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তাই মেয়েদের প্রতিদিন কাঁচা হলুদ খাওয়া প্রয়োজন।

বাতের ব্যথা কমাতে কাঁচা হলুদ:- যেকোনো ব্যথা কমাতে হলুদের ব্যবহার খুবই কার্যকরী। এক্ষেত্রে হাঁটুর ব্যথা, বাতের ব্যথা, যেকোনো ধরনের ব্যথার ক্ষেত্রে কাঁচা হলুদের ব্যবহার হয়ে থাকে। হলুদে থাকা অ্যান্টিইমফ্লেমেটরি উপাদান গুলো শরীরের ভেতরে ব্যথা নিরাময়ক হিসেবে কাজ করে।

ত্বকের যত্নে কাঁচা হলুদ:- ত্বকের যত্নে কাঁচা হলুদের ভূমিকা অপরিসীম। প্রাচীন কাল থেকে ত্বকের যত্নে কাঁচা হলুদ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সানবার্ন, দাগ, রিংকেল থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্যতম উপাদান হলো এই হলুদ। এতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা বয়সের ছাপ দূর করতে সাহায্য করে। অ্যালোভেরার সাথে কাঁচা হলুদ মিক্স করে ব্যবহার করলে মুখের উজ্জলতা বৃদ্ধি পায়।

এলার্জি নিরাময়ে কাঁচা হলুদ:- কাঁচা হলুদে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ যা এলার্জি  নিয়াময়ে সাহায্য করে।

মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাঁচা হলুদ:- কাঁচা হলুদ মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত এটি খেলে ডিমেনশিয়া, অ্যালঝাইমার্স- সহ মস্তিষ্কের বেশ কিছু সমস্যা নিরাময় হয়।

হজমশক্তি বৃদ্ধিতে কাঁচা হলুদ:- কাঁচা হলুদে গ্যাস্ট্রো প্রটেক্টিভ গুণ থাকে যা খাবারকে হজম করতে সহায়তা করে। গ্যাসের সমস্যা, হজমের গোলমালের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

কাঁচা হলুদের অপকারিতা

কাঁচা হলুদের অপকারিতা

হলুদ এমন একটি মশলা বা ওষুধ যা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পূজোর সময় বা বিয়ের আগে হলুদ ব্যবহার করা হয়। তবে আমরা সকলেই জানি যে অতিরিক্ত কোনো কিছু বব্যহার করা ঠিক না। এতে উপকারের বদলে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক অতিরিক্ত হলুদ খাওয়ার অপকারিতাগুলোঃ-

  • অতিরিক্ত হলুদ শরীর থেকে আয়রন শোষণ করে নেয়। তখন রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়। ফলে শরীরে আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয়। হলুদের মধ্যে কিউকারমিন থাকে যা ভেঙে গিয়ে ফেরিক কিউকারমিন তৈরি হয়। এর ফলে শরীর থেকে অতিরিক্ত আয়রন শুষে নেয়।
  • হলুদে কিউকারমিন থাকে যা আমাদের শরীরের জন্য খুবই ভালো এবং স্বাস্থ্যের দিক থেকেও উপকারী। কিন্তু বেশি হলুদ খেলে অ্যানিমিয়া হয়। তবে শুধুই যে  অ্যানিমিয়া হবে তা নয়, এর সঙ্গে কিডনি স্টোন, রক্তপাতে সমস্যা, ডায়াবেটিস এসবও কিন্তু আসতে পারে।
  • হলুদ দেহে আয়রন ভারসাম্যের জন্য দায়ী হেপসিডিন, পেপটাইডস সংশ্লেষণকেও বাধা দিতে পারে। এই সব কারণগুলি একসঙ্গে আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয় এবং হজমে সমস্যা হতে পারে। অতিরিক্ত হলুদ খেলে মাথা ধরা, ত্বকের সমস্যা এসব লেগেই থাকে। এছাড়াও আলসার, লিভার বড় হয়ে যাওয়া, প্রদাহ এসবও হতে  পারে।

কাঁচা হলুদ খাওয়ার নিয়ম

বিজ্ঞানীরা বলছেন, রোজ  সকালে ও রাতে দুই বেলায় ২৫০ মিলিগ্রাম করে কাঁচা হলুদ খাওয়া যেতে পারে। সকালে খালি পেটে হলুদ খেতে পারেন। তবে খাওয়ার পর আধ ঘণ্টা কিছু খাওয়া উচিত না। আবার রাতে ঘুমানোর আগে হলুদ-দুধ খেতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন এর থেকে বেশি হলুদ না খাওয়ার, এতে উপকারের বদলে ক্ষতি হতে পারে।

হলুদ কিভাবে খাবেন?

চিকিৎসাবীদরা বলছেন, দুধ দিয়েই খেতে হবে হলুদ। কারণ দুধ হলুদের প্রধান উপাদান কারকিউমিনকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে। পানি বা গুড়ের সাথে হলুদ মিশিয়ে  খেতে পারেন। এতে কারকিউমিনের অনেকটা শোষিত হয় না। এছাড়াও গোলমরিচের সাথে বেটে এটি খাওয়া যায়। কারণ, গোলমরিচে পিপারিন আছে যা কারমিউমিনের কার্যক্ষমতা প্রায় ২০০০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়৷

কাঁচা হলুদ খেলে কি ফর্সা হয়?

হলুদ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। তবে এটি শুধু খাবারেই ব্যবহার করা হয় না, ত্বকের জন্যও খুবই কার্যকারী। হলুদে থাকা অ্যান্টি-ফাঙ্গাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মুখের ব্রণ এবং ব্রণের মতো ত্বক সম্পর্কিত আরও অনেক সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।

কাঁচা হলুদ আর মধু খেলে কি হয়?

কাঁচা হলুদ আর মধু মিশিয়ে খেলে লিভারের সমস্যায় উপকার পাওয়া যায়। সকালবেলা খালি পেটে কাঁচা হলুদের রসের সাথে সামান্য নুন মিশিয়ে খেলে কৃমি সারে। আবার সকালবেলা খালি পেটে এটি খেলে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। তবে প্রতিদিন রান্নায় হলুদ বেটে দেওয়া একটু সময় সাপেক্ষ।

গুঁড়ো হলুদ খাওয়া যায়?

গুড়ো হলুদ খাওয়া একেবারেই উচিত নয়। কারণ এতে ভেজাল হিসেবে থাকতে পারে বার্লি, বিষাক্ত মেটালিক হলুদ রং, ময়দা ইত্যাদি। ফলে স্বাস্থ্যের উপকারের জন্য কাঁচা হলুদই খেতে হবে। প্রথমে ভাল ভাবে ধুয়ে নিতে হবে। তার পরে তা শুকিয়ে নিয়ে টুকরো করেও খাওয়া যায়, অথবা বেটে নেওয়া যায়।

কাদের জন্য কাঁচা হলুদ খাওয়া উচিত নয়?

রান্নার পরিমাণে যে পরিমাণ হলুদ ব্যবহার করা হয় তা সবার জন্য নিরাপদ। তবে কারকিউমিনের উপকারিতা পাওয়ার আশায় অধিক পরিমাণে কাঁচা হলুদ খাওয়া বা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা নিরাপদ নাও হতে পারে। যেমনঃ-

  • লিভারে রোগ, কিডনিতে পাথর ও পিত্তিথলিতে পাথর থাকলে তাদের অতিরিক্ত হলুদ খাওয়া যাবে না।
  • স্তন ক্যান্সার থাকলে তাদের অতিরিক্ত হলুদ খাওয়া যাবে না।
  • রক্তস্বল্পতা রোগীদের অতিরিক্ত হলুদ খাওয়া যাবে না।
  • গর্ভবতী মায়েদের জন্য অতিরিক্ত হলুদ খাওয়া নিরাপদ নয়।
  • কাঁচা হলুদে যাদের এলার্জি আছে তাদের এটি খাওয়া নিরাপদ নয়।

আমি এই পুরো আর্টিকেলটি জুড়ে চেষ্টা করেছি কাঁচা হলুদের বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তোলার। এবং আপনাদের জানিয়েছি কাঁচা হলুদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, এর উপকারিতা ও অপকারিতাগুলো, কিভাবে খাবেন, কাদের জন্য খাওয়া উচিত না এই বিষয়গুলি। আপনারা যারা এই বিষয়গুলো জানতেন না, আশা করি এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনারা উপকৃত হবেন।

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *