যাকাত দেওয়ার নিয়ম ও সঠিক ইসলামিক বিধান

যাকাত দেওয়ার নিয়ম ও সঠিক ইসলামিক বিধান

যাকাত ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোকন তাই আমাদের সকলের যাকাত দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হল সালাত ও যাকাত। মহানবী (সাঃ) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করেন। আর তখন থেকেই সে রাষ্ট্রে যাকাত ব্যবস্থা চালু হয়েছে এবং যাকাত দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে ইসলামে সঠিক বিধান রয়েছে। যাকাত শব্দটির অর্থ হলো বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্র করা, প্রশংসা ও পরিছন্নতা ইত্যাদি।

পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে “যাকাত” শব্দের উল্লেখ এসেছে ৩২ বার। আল্লাহ তা’আলা বলেন : ‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দু’আ করবেন। আপনার দু’আ তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা তাওবা : ১০৩)। এই আয়াতে আল্লাহপাক সম্পদ পরিশোধিত হওয়ার কথা বলেছেন।

যাকাত কাকে বলে

যাকাত কাকে বলে

যাকাত একটি আরবি শব্দ যার অর্থ ‎‎“পরিশুদ্ধকরণ, পবিত্র করা, বৃদ্ধি পাওয়া, বরকত হওয়া ইত্যাদি”। আরবী হিজরী ১ বছরে যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ মজুদ থাকে তাহলে সেই সম্পদ হতে শতকরা ২.৫ শতাংশ (২.৫%) বা ১/৪০ অংশ গরীব-দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে যাকাত বলা হয়। ইমাম ইবনু তাইমিয়ার মতে, যা প্রদান করার মাধ্যমে মন ও আত্মার পবিত্রতা লাভ হয়, সম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং সম্পদ পরিচ্ছন্ন হয় তাকে যাকাত বলে। আর হাদীস শরীফ থেকে জানা যায় যে, যাকাতের মাধ্যমে সম্পদ পরিশোধিত হয়। ধনীদের যে সম্পদ, তার মালিক সে একা নয়। এই সম্পদে গরিবের হক রয়েছে।

সুতরাং যাকাত হলো ব্যক্তি ও মালামাল পবিত্র করার একটি মাধ্যম। যা প্রদান করলে মাল কমে না বরং বাড়ে। তাই আমাদের সকলের উচিত ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে যথাযথ ভাবে যাকাত প্রদান করা। এছাড়া যাকাত কে প্রত্যেক সামর্থবান মুসলিম নর- নারীর উপর ফরজ করা হয়েছে এবং যে ব্যক্তি যাকাত প্রদানে অস্বীকার করবে তাকে কাফের বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি

দ্বিতীয় হিজরীতে মদিনাতুল মুনাওয়ারায় যাকাত ফরজ হয়। কোন মুসলিম নর-নারী যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তাহলে উক্ত ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ। যাদের উপর যাকাত ফরজ হবে তাদেরকে অবশ্যই যাকাত দিতে হবে। কিন্তু যাকাত সকলের উপর ফরজ নয় যার জন্য যাকাত দেওয়ার নিয়ম ও বিধান সম্পর্কে আমাদের সঠিক ভাবে জানতে হবে। যেমনঃ গরীব মানুষের জন্য যাকাত ফরজ নয়। যাকাত ফরজ ধনবান বিত্তশালী মুসলমানদের জন্য। নিচে যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ৭টি শর্ত লেখা হলো-

  • যাকাত ফরজ হওয়ার ১ম শর্তই হলো মুমিন এবং মুসলমান হওয়া।
  • ২য় শর্ত হলো নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া। অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা এর সমপরিমাণ টাকা বা ব্যবসার মালের মালিক হলে তাকে ইসলামের বিধান অনুযায়ী যাকাত প্রদান করতে হবে। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হলে তার উপর যাকাত ফরজ নয়।
  • বালেগ হওয়া অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। কারণ, নাবালক এর জন্য যাকাত ফরজ নয়।
  • যাকাত প্রদান করতে হলে তাকে বিবেক ও বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ হতে হবে। পাগলের উপর যাকাত ফরজ নয়।
  • যে ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ রয়েছে সেই ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ।
  • যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে সম্পদ ঋণ মুক্ত হতে হবে। ঋণ পরিশোধ করার পর যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ মজুদ থাকে তবে সেই সম্পদের যাকাত প্রদান করতে হবে। যদি কোন ব্যক্তি ঋণগ্রস্থ থাকে তাহলে সে প্রথমে ঋণ পরিশোধ করবে তারপর যাকাত প্রদান করবে।
  • নিসাব পরিমাণ সম্পদ ও মালের অধিকারী হওয়ার পর সেই মালের বয়স এক বছর হওয়া।

যাকাত কাদের উপর ফরজ

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়টি হচ্ছে যাকাত। ঈমানের পর নামাজ ও তার পরই যাকাতের স্থান। এমন অনেকেই আছেন যাদের সুস্পষ্ট ধারণা নেই যে কত টাকা থাকলে তাকে যাকাত দিতে হবে। তবে জেনে রাখা ভালো সকলের উপর কিন্তু যাকাত ফরজ নয়। শুধুমাত্র ওই ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ যার আল্লাহ তা’আলা নির্দেশিত নির্দিষ্ট পরিমান সম্পদ রয়েছে। যাদের উপর যাকাত ফরজ তাদের সম্পর্কে নিচে লেখা হলো-

  • যে ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ তাকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে। কোন অমুসলিমের ওপর যাকাত ফরজ নয়।
  • যদি কোন ব্যক্তির নিকট কমপক্ষে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তলা রুপা কিংবা ওই সমমূল্যের অর্থ বা সম্পদ জমা থাকে তবে তাকে যাকাত দিতে হবে। অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে।
  • কোন ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ নয়। কিন্তু সে যদি ঋণ পরিশোধ করে এবং তার কাছে যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকে তাহলে তার উপর যাকাত দিতে হবে।
  • কোন পাগল অথবা বুদ্ধি জ্ঞানহীন ব্যক্তির ওপর যাকাত ফরজ নয়।
  • অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি বা বালেগ এর উপর যাকাত ফরজ নয়।

যাকাত দেওয়ার নিয়ম

যাকাত দেওয়ার নিয়ম

আপানার উপর যদি যাকাত দেওয়া ফরজ হয় তাহলে আপনাকে অবশ্যই যাকাতের নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ গরিব দুঃখীকে দিতে হবে। যাকাত দেওয়ার নিয়ম ও সঠিক বিধান জানলে আমরা খুব সহজেই যাকাত দিতে পারব। যাকাত দেওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি ও মালামাল পবিত্র হয়ে যায়। ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে যথাযথ ভাবে যাকাত প্রদান করতে হবে। কোরআন মজিদে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে, কোন মুসলমান যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও যাকাত প্রদান না করে তাকে মুশরিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই আমাদের সকলকে যথাযথ নিয়ম মেনে যাকাত প্রদান করতে হবে। নিচে যাকাত দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে লেখা হলো-

  • যাকাত প্রদান করার পূর্বে এর নিয়ত সহী করা। অর্থাৎ যাকাত আদায় করার সময় নিয়ত থাকতে হবে যে- এ সম্পদ আল্লাহর ওয়াস্তে যাকাত হিসেবে প্রদান করা হচ্ছে। নতুবা যাকাত আদায় হবে না।
  • যে সকল সম্পদের উপর যাকাত ফরজ হয় সেই সম্পদ হিসাব করে তার ৪০ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে অর্থাৎ ২.৫ শতাংশ। ধরুন, আপনার সম্পদের মূল্য যদি ১০০০ টাকা হয় সেখানে আপনার যাকাত দিতে হবে ২৫ টাকা।
  • যদি যাকাত দাতা ঋণগ্রস্ত হন তাহলে ঋণ পরিশোধ করার পর নেসব পরিমাণ সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকলে তাকে সেই সম্পত্তির উপর যাকাত দিতে হবে। কিন্তু যদি ঋণ পরিশোধ করার পর নেসব পরিমাণ সম্পত্তি তার কাছে জমা না থাকে তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে না।
  • আপনি যদি কাউকে ঋণ দিয়ে থাকেন এবং আপনার যদি ওই টাকা ফিরে পাওয়ার আশা না থাকে তাহলে যাকাত দিতে হবে না। কিন্তু যদি টাকা ফেরত পান সেক্ষেত্রে আপনাকে বিগত বছরের সহ যাকাত দিতে হবে।
  • যাকাত প্রদানের সময় গ্রহণকারীকে এ কথা জানানো প্রয়োজন নেই যে এটা যাকাতের টাকা। আপনজনকে যাকাত দিলে তাকে এ কথা না বলাই শ্রেয়। কারণ বললে তার খারাপ লাগতে পারে।
  • যাকাত দাতার অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ তার পক্ষ থেকে যাকাত দিয়ে দিলে যাকাত আদায় হবে না।

যাকাত কাদের উপর ফরজ

আশা করি আজকের এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনারা যাকাত কাকে বলে, কাদের উপর যাকাত ফরজ ও যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তগুলো এবং যাকাত দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। যাকাত আমাদের জন্য ফরজ করা হয়েছে। আর যাকাত আদায়ের মাধ্যমে পরকালীন জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত থাকা যায়। আর এই যাকাত না দিলে পরকালে আপনি জাহান্নামীদের কাতারে দাঁড়াবেন। তাছাড়া যাকাত আদায়ের মাধ্যমে হৃদয়ের সংকোচন ও কৃপণতা থেকে মুক্ত থাকা যায়, সেই সাথে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে হৃদ্যতা ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলা সম্ভব হয়। তাই নেসাবের অধিকারী সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলিমকে যাকাত আদায়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও যত্নশীল হতে হবে।

যাকাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানতেঃ- ভিসিট করুন। এ ধরনের আরও পোস্ট পড়তে আমদের সাথেই থাকুন

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *