টাইম মেশিন কি? এটি কিভাবে কাজ করে - টাইম মেশিন কি সত্যিই সম্ভব?

টাইম মেশিন কি? এটি কিভাবে কাজ করে – টাইম মেশিন কি সত্যিই সম্ভব?

আমাদের সবারই মাঝে মাঝে এমন মনে হয় যে ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা যদি জানতে পারতাম বা সময়ে পিছিয়ে গিয়ে কোন কাজ বা ভুল সংশোধন করতে পারতাম। আর এই চিন্তা থেকে মাথায় সবার প্রথমে যে বিষয়টা আসে তা হল টাইম মেশিন। টাইম মেশিন সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা আছে তার সবই কোন ফিকশনাল মুভি বা গল্প থেকে পাওয়া। কিন্তু বাস্তবে টাইম মেশিন এবং এর যাবতীয় বিষয় সস্পর্কে খুব বেশি ধারণা নেই।

তাই আজকের এই আর্টিকেলে টাইম মেশিন ও টাইম ট্রাভেলিং এর ব্যাপারগুলো যতটা সম্ভব সহজভাবে আলোচনা করবো, আর লাখ টাকার প্রশ্নের উত্তর খুঁজব- টাইম মেশিন তৈরি করা কি সত্যিই সম্ভব?

টাইম মেশিন কি

টাইম মেশিন কি?

সহজ ভাষায় বলতে গেলে টাইম মেশিন একটি কাল্পনিক মেশিন যা ব্যবহার করে আপনি ইচ্ছা মতো অতীতে বা ভবিষ্যতের যেকোন সময়ের যে কোন জায়গায় যেতে পারবেন।

টাইম মেশিন সম্পর্কে জানার জন্য মাত্রা বা ডাইমেনশন সম্পর্কে বুঝতে হবে। আপাতত শুধু ত্রিমাত্রিক বা থার্ড ডাইমেনশন এবং চতুর্মাত্রিক বা ফোরথ ডাইমেনশন সম্পর্কে বুঝলেই চলবে। আমরা ত্রিমাত্রিক পৃথিবীতে বাস করি, নির্দিষ্ট কোন স্থান যেমন- ঢাকা, রাজশাহী ইত্যাদি ত্রিমাত্রিক ডাইমেনশন। চতুর্মাত্রিক ডাইমেনশন হল সময়, আর চতুর্মাত্রিক গন্তব্য হচ্ছে ১৯৫০, ২০৩০ ইত্যাদি সাল। টাইম মেশিন একটি চতুর্মাত্রিক যান, তাই স্থান ও সময়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হয় টাইম মেশিন এর মাধ্যমে।

সত্যি বলতে টাইম মেশিন আপাতত একটি থিউরি বা বৈজ্ঞানিক কল্পনা, যার কোন প্র্যাক্টিকাল রুপ এখনও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তবে অনেক বৈজ্ঞানিক টার্ম আছে যেগুলো দিয়ে মনে করা হয় টাইম মেশিন তৈরি করা সম্ভব। এ বিষয়ে আমি আগে আরও বিস্তারিত আলোচনা করবো। তবে আশা করি আপনাদের টাইম মেশিন কি সেই সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে পেরেছি।

টাইম ট্রাভেল কি সত্যিই করা সম্ভব?

আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বলে যে সময় স্থির ধ্রুবক নয়, এটি মাধ্যাকর্ষণ বল এবং বেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়। যার ফলে অনেকে মনে করেন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে হয়ত সময়ের হেরফের করা সম্ভব।

আইনস্টাইন তার বিখ্যাত রিলেটিভির সুত্রে বলেছিলেন গ্রাভিটি বা মহাকর্ষ বল সময়কে ধীর করে দেয়। আপনি যত দ্রুত ভ্রমণ করবেন আপনার জন্য সময় তত বেশি ধীর হয়ে যাবে বা আস্তে চলবে। মনে করেন দুটি ঘড়ির একটি ১০০০ কিলোমিটার স্পীডে চলা জেট প্লেনে এবং অন্যটি পৃথিবীতে একটি বাড়িতে রাখা হল। এই দুটি ঘড়ির মধ্যে প্লেনে থাকা ঘড়িটি বাড়িতে থাকা ঘড়ির চেয়ে আস্তে চলবে। যদিও এটা আপনি আমি অনুভব করতে পারবো না, কেননা এই পরিবর্তন বলতে পারেন হাজার ভাগের এক ভাগ।

টাইম ট্রাভেল কি সত্যিই করা সম্ভব

তবে স্পীড যত বাড়ানো হবে এবং মহাকর্ষ বল থেকে যত দূরে যাওয়া যাবে এই সময়ের ব্যবধান তত বাড়বে।

নিউট্রন তারায় সময় পৃথিবীর সময় থেকে ৩০ শতাংশ ধীরে চলে। যদি ঐ তারা থেকে কেউ যদি টেলিস্কোপ দিয়ে পৃথিবীতে উকি মারে তাহলে দেখা যাবে পৃথিবীতে সবাই ফাস্ট ফরওয়ার্ডের মতো দৌড়াচ্ছে।

গেলাক্সি

আইনস্টাইনের সূত্রমতে, কোনো বস্তু যত দ্রুত গতিতে চলবে, তার সাপেক্ষে সময় তত স্থির থাকবে। অর্থাৎ আপনি যদি আলোর বেগে চলতে থাকেন তাহলে আপনার জন্য সময়টা ধীর হয়ে যাবে।

মনে করেন রহিম ও করিম দুই ভাই যাদের বয়স ৩০ বছর। এদের মধ্যে রহিম স্পেস যানে করে ২০ বছর আলোর গতিতে ভ্রমণ করল এবং করিম সে সময় পৃথিবীতে অবস্থান করল। ২০ বছর পরে দুইজন একত্রিত হলে দেখা যাবে রহিমের বয়স ৪০ বছর, যেখানে করিমের বয়স ৫০ বছর। অর্থাৎ রহিম ২০ বছর মহাকর্ষ বলের বাইরে থেকে আলোর গতিতে ভ্রমণ করার ফলে তার জন্য সময় ধীরে চলেছে। এই বিষয়টিকে টাইম ডাইলেশন বলে যা ইন্টারস্টেলার মুভিতে অনেক ভালো ভাবে দেখানো হয়েছে।

তাহলে কি বুঝলেন? সবই স্পীড এর খেলা। অনেক বিজ্ঞানী তো মনে করেন যদি কোন ভাবে আমরা আলোর গতি ১৮৬০০০ মাইল প্রতি সেকেন্ডে ট্রাভেল করেত পারি তাহলে স্পেসে টাইম ট্রাভেল করা সম্ভব হবে।

স্পেসে টাইম ট্রাভেল

চলেন আর একটা সম্ভাবনার কথা বলি। সময় সাধারণ অবস্থায় সরল রেখায় চলে, অনেকটা একটা তলের উপরে হাঁটার মতো। কিন্তু তলটাকে যদি বাঁকিয়ে দেওয়া হয় তখন সময় সেই বাঁক অনুসরণ করবে। যেমন মনে করেন বড় একটা লাঠি যার দুই মাথা A থেকে B এর দূরত্ব ১০মিটার এবং A থেকে B বিন্দুতে যেতে ১ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু ঐ লাঠিকে বাকিয়ে যদি ধনুক বানানো হয় তাহলে A থেকে B এর দূরত্ব হবে ৮ মিটার এবং A থেকে B বিন্দুতে যেতে সময় লাগবে ৪৮ সেকেন্ড। অর্থাৎ শর্টকাট ব্যবহার করে কম সময়ে কিন্তু একই গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। ধারনা করা হয় মহাশূন্যে ছোটছোট ব্লাক হোল থাকতে পারে যেগুলো ওয়ার্ম হোলের সৃষ্টি করে। এটার এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে অপর প্রান্ত দিয়ে বের হতে পারলে টাইম ট্রাভেল করা সম্ভব হবে।

ওয়ার্ম হোল

এরকম আরও কিছু থিওরি আছে, যেমন প্যারালাল ইউনিভার্স যেগুলো থেকে অনেকে মনে করে টাইম ট্রাভেল আসলে সম্ভব। কিন্তু এখনকার জন্য পুরো বিষয়টাই শুধু কল্পনা ও থিওরি।

বর্তমানে টাইম ট্রাভেলের ব্যবহার

বর্তমানে আমাদের কাছে এমন কোন টাইম মেশিন নাই যাতে করে আমরা ১০০ বছর আগে বা পিছনে যেতে পারব, তবে কিছু বিষয় আছে যা টাইম ট্রাভেলের রুলস ফলো করে।

আচ্ছা আমরা সবাই অচেনা কোন জায়গা খুঁজে বের করার জন্য GPS ব্যবহার করি। GPS স্যাটেলাইটগুলো ৮৭০০ মাইল প্রতি ঘণ্টা স্পীডে পৃথিবী থেকে প্রায় ১২,৫৫০ মাইল উচ্চতায় ঘুরতে থাকে। ফলে এর উপরে  গ্রাভিটির প্রভাব অনেক কম পরে।

GPS স্যাটেলাইট

 

আর যেমনটা আইনস্টাইন বলেছিল সময় মাধ্যাকর্ষণ বল এবং বেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়, তার উপরে ভিত্তি করে পৃথিবীর ঘড়ির সাথে স্যাটেলাইট এর ঘড়ির সময়ের হেরফের হয়ে যায়। তবে সায়েন্টিস্টরা এই সময়ের হেরফের ঠিক করে বলে আমরা রিয়েল টাইম লোকেশান সুবিধা ব্যবহার করতে পারি।

টাইম মেশিন তৈরি করা কি সম্ভব?

আমি আগেই বলেছি টাইম ট্রাভেল সম্পর্কিত যত সম্ভাবনা আছে তার সবগুলোই থিওরি। তবে বিজ্ঞান ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে। আজ থেকে ২০০ বছর আগে কেউ কল্পনাও করেনি আজ আমরা আমাদের হাতের মুঠোর স্মার্টফোন দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের খবর নিতে পারব, সুপারসনিক জেট ব্যবহার করে শব্দের থেকে দ্রুত গতিতে ট্রাভেল করতে পারব। হয়ত সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তি উন্নত হবে, আমরা আরও অনেক সম্ভাবনা দেখতে পাব। টাইম মেশিন না হলেও হয়ত অনুরুপ কাছাকাছি কিছু তৈরি করা সম্ভব হবে। তাই ভবিষ্যতে টাইম মেশিন তৈরি করা সম্ভব হবে কি না এই ব্যাপারে আপাত দৃষ্টিতে এখনই নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।

টাইম ট্রাভেল নিয়ে মজাদার সব প্যারাডক্স

টাইম ট্রাভেল নিয়ে আলোচনা করার সময় প্যারাডক্স নিয়ে কথা না বললে আলোচনা সম্পূর্ণ হবে না। প্যারাডক্স শব্দের অর্থ হল কূটাভাস। প্যারাডক্স হল এমন কিছু বাক্য বা উক্তি যা থেকে নির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে আসা যায় না। এসকল বাক্যের অর্থ বের করতে গেলে দুটি পরস্পর বিরোধী সমাধান পাওয়া যায় যার কোনটিকে সম্পূর্ণ সত্য বা সম্পূর্ণ মিথ্যাও বলা যায় না। এই ধরনের বিভ্রান্তিকর দার্শনিক বা গাণিতিক বাক্যকেই প্যারাডক্স বলে। চলুন এরকম মজাদার কিছু প্যারাডক্স সম্পর্কে জেনে নেইঃ-

গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স

ধরুন আপনি টাইম ট্রাভেল করে অতীতে এমন এক সময় পৌঁছালেন যখন আপনার বাবার জন্মই হয় নি। এবার আপনি আপনার দাদাকে খুঁজে বের করে আপনার বাবার জন্মের পূর্বেই তাঁকে (দাদা) হত্যা করলেন। তাহলে হিসাব অনুযায়ী আপনার পিতার জন্মই হবে না কারণ তার আগেই আপনি আপানার দাদাকে হত্যা করলেন। আর আপনার পিতার জন্ম না হলে আপনার নিজেরও জন্ম হবে না। এখন আপনার যদি জন্মই না হয় তাহলে অতিতে গিয়ে আপনার দাদাকে কে হত্যা করল?

বুটস্ট্র্যাপ প্যারাডক্স

মনে করুন, ২০২৩ সালে আপনি একজন দেশ সেরা লেখক। আপনি আপনার সবচেয়ে বিখ্যাত বই কোন দোকান থেকে কিনে নিয়ে টাইম ট্র্যাভেল করে আপনার যুবক বয়সের সময়ে গেলেন। তারপর নিজেকে নিজের বই দিয়ে এলেন। ঐ বই দেখে যুবক (আপনি নিজে) বইটি লেখে প্রকাশনীতে দিয়ে দিল। বই প্রকাশ পেল আর বিখ্যাত হয়ে গেলেন। এখন প্রশ্ন আসে তাহলে বই এর মূল রচয়িতা কে?

শেষ কথা

কাল্পনিক টাইম মেশিনের লোভ আমাদের সবার ভিতরেই আছে। আসলে টাইম ট্রাভেলের বিষয়টি সত্যি কিন্তু আপনি যেভাবে মুভিতে দেখেছেন বা গল্পে পড়েছেন তেমনটা নয়। কিছু শর্ত যেমন স্পীড, মহাকর্ষ বল মেনে হয়ত ১/২ সেকেন্ডের টাইম ট্রাভেলের ফিল নেওয়া সম্ভব। তবে ভবিষ্যতে এই সময় আরও বাড়ানো যাবে কি না তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

নিউট্রন তারা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতেঃ- নিউট্রন তারা

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *