কুমিল্লা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। কুমিল্লা বাংলাদেশের ঐতিহ্যমন্ডিত ও বিখ্যাত একটি জেলা। আগে কুমিল্লা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের একটি অংশ ছিল। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালের দিকে ত্রিপুরা জেলার নামকরণ করা হয় কুমিল্লা।
আজকের এই আর্টিকেলে আমি আপনাদের জানাবো কুমিল্লা কিসের জন্য বিখ্যাত এবং এই জেলার কিছু দর্শনীয় স্থানসমূহ সম্পর্কে। তার আগে আমরা জানবো কুমিল্লা জেলার ইতিহাস ও এই জেলার অবস্থান এবং আয়তন সম্পর্কে। চলুন তবে শুরু করা যাক-
কুমিল্লা জেলার ইতিহাস, অবস্থান ও আয়তন
কুমিল্লা জেলা সর্বপ্রথম ১৭৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এই জেলার নাম কুমিল্লা ছিল না। সেই সময় জেলাটি ত্রিপুরা নামে পরিচিত লাভ করে। পরবর্তীতে ত্রিপুরা থেকে এই জেলাটির নাম রাখা হয় কুমিল্লা। কুমিল্লা যার (আদিনাম কমলাঙ্ক এর অপভ্রংশ, যার অর্থ পদ্মফুলের দীঘি)।
কুমিল্লা জেলার মোট আয়তন ৩,০৮৭.৩৩ বর্গ কিলোমিটার। কুমিল্লা জেলার মোট জনসংখ্যা ৬২,১২,২১৬ জন। জনসংখ্যার ঘনত্ব ১৯৭৪ জন। সাক্ষরতার হার ৮২.০০%। ধর্মবিশ্বাস অনুসারে কুমিল্লা জেলার মোট জনসংখ্যার ৯৪.৬২% মুসলিম, ৫.২৬% হিন্দু এবং ০.১২% বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। রাজধানী ঢাকা থেকে এ জেলার দূরত্ব প্রায় ৯৭ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় সদর থেকে প্রায় ১৪৯ কিলোমিটার।
এ জেলার উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা, মেঘনা নদী ও নারায়ণগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে ফেনী জেলা ও নোয়াখালী জেলা, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা, পশ্চিমে চাঁদপুর জেলা, মেঘনা নদী ও মুন্সীগঞ্জ জেলা। কুমিল্লা জেলার প্রধান নদ-নদীগুলো হলো: মেঘনা নদী, গোমতী নদী, তিতাস নদী ইত্যাদি। কুমিল্লা জেলা মোট ১৭টি উপজেলা নিয়ে গঠিত। কুমিল্লা জেলায় কিছু ঐতিহ্যবাহী শিল্প প্রচলিত আছে যেমন; মৃৎশিল্প, তাঁত শিল্প, কুটির শিল্প এবং কারু শিল্প।
কুমিল্লা কিসের জন্য বিখ্যাত
কুমিল্লা কিসের জন্য বিখ্যাত এই প্রশ্ন আমাদের অনেকের মনেই কড়া নাড়ে। কুমিল্লা জেলা মূলত রসমালাই ও খদ্দর (খাদী) এর জন্য বিখ্যাত। ঠিক তেমনি এই জেলা মৃৎশিল্প, তাঁত শিল্প ও কুটির শিল্পের জন্যও বিখ্যাত। এই শিল্পগুলো বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
যখনই কুমিল্লা নামটি শোনা হয় তখনই সর্বপ্রথম কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই এর কথা মাথায় আসে। উনিশ শতকের দিকে খনিন্দ্র সেন ও মণিন্দ্র সেন নামের দুই ভাইয়ের মাধ্যমে বিখ্যাত এই রসমালাই এর খ্যাতি চারিদিক ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় রসমালাই বিক্রি করা হলেও। কুমিল্লার রসমালাই এর স্বাদই অন্যরকম।
কুমিল্লা জেলা তাঁত শিল্পের জন্যও বিখ্যাত। যা মুঘল আমল থেকেই বিখ্যাত ছিল। সে সময় এই তাঁত বুনন পেশা কুমিল্লার ময়নামতি, চান্দিনা, দেবীদ্বার, গৌরিপুর, নবীনগরে সমস্ত এলাকার মানুষদের প্রধান পেশাগুলোর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল।
কুমিল্লা জেলার বিখ্যাত খাবার
কুমিল্লা জেলাটি খাবারের জন্যও অনেক বিখ্যাত। কুমিল্লা কিসের জন্য বিখ্যাত এই প্রশ্ন আসলে সর্বপ্রথম যে যে জিনিসটি সামনে আসে তা হচ্ছে কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই। শুধু রসমালাই ই নয়, এই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে বেশ সমৃদ্ধ করেছে এখানকার নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় খাবার। নিচে কুমিল্লা জেলার বিখ্যাত খাবারগুলো সম্পর্কে লেখা হলো-
কুমিল্লার রসমালাই
কুমিল্লার একটি বিখ্যাত খাবার হচ্ছে রসমালাই। সেরা মান ও উৎকৃষ্ট স্বাদের রসমালাই মানেই কুমিল্লার রসমালাই। কিন্তু কুমিল্লার সব জায়গার রসমালাই এর স্বাদ যে এক রকম তা কিন্তু নয়। রসমালাই এর অথেনটিক স্বাদ একমাত্র কুমিল্লার মাতৃ ভান্ডারে পাওয়া যায়।
কমপক্ষে দুই ঘণ্টা ধরে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন হয়ে আসলে তা দিয়ে ছানা তৈরি করা হয়। এরপর ছানা কেটে ছোট ছোট মিষ্টি তৈরি করা হয়। পরে রসের মধ্যে দিয়ে বানানো হয় অপূর্ব স্বাদের রসমালাই।
কাঁচা মরিচের রসগোল্লা
কুমিল্লায় এক ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায় যার স্বাদ কিনা ঝাল মিষ্টি। হ্যাঁ, আপনি ঠিকি শুনেছেন এই মিষ্টির নাম হলো কাঁচা মরিচের রসগোল্লা। বর্তমানে এটি কুমিল্লায় অনেক জনপ্রিয় একটি খাবার হিসেবে সকলের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। কাঁচা মরিচের রসগোল্লা এই মিষ্টির উদ্ভাবন করেছেন কুমিল্লার টমছম ব্রিজ রেলিশ বেকারি এন্ড কনফেকশনারির মালিক মাসুদ খন্দকার।
দুধ জ্বাল দিয়ে ছানা তৈরি করে সেই ছানা মাখানোর সময় তার মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয় একদম মিহি করে পেস্ট করা কাঁচামরিচ । তাই দিয়ে বানানো হয় গোলাকৃতির মিষ্টি। পাতলা করে তৈরি করা চিনির সিরায় সবুজ রঙের মিষ্টি দিয়ে জ্বাল করে নেয়ার সময় তার মধ্যে দেয়া হয় দু ভাগ করা কাঁচামরিচের টুকরো। এভাবেই ছানা, চিনি ও কাঁচামরিচের সমন্বয়ে তৈরি করা হয় অনন্য স্বাদের কাঁচা মরিচের রসগোল্লা।
পেড়া মিষ্টি
কুমিল্লায় রসমালাই যেমন বিখ্যাত ঠিক তেমনি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় আরেকটি মিষ্টির নাম হলো পেড়া মিষ্টি। রাজকীয় স্বাদের কারনে বাংলাদেশ সহ বিদেশেও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে কুমিল্লার বিখ্যাত পেড়াবমিষ্টি।
পেড়া মিষ্টির মূল উপকরণ দুধ। গুড়া দুধ ও কনডেস্ট মিল্ক একসাথে জ্বাল করে একদম শক্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। সাথে দিয়ে দেয়া হয় জাফরান ও এলাচ গুঁড়ো। শক্ত ডো তৈরি করে হাতে ঘি মেখে গোল ও কিছুটা চ্যাপ্টা আকৃতির মিষ্টি তৈরি করে নেয়া হয়। মাঝখানে চাপ দিয়ে কিছুটা গর্ত করে তার মধ্যে দিয়ে দেয়া হয় পেস্তা বাদাম কুচি। এই মিষ্টির পুরো প্রসেসিংটাই চলে দুধ দিয়ে।
মাড়ি পিঠা
কুমিল্লার খুবই জনপ্রিয় একটি পিঠা হচ্ছে মাড়ি পিঠা। এই পিঠা মূলত এক ধরনের ডেজার্ট আইটেম যা সাধারণত কাঁঠালের সাথে খাওয়া হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে যখন কাঁঠালের সিজন থাকে তখন কুমিল্লার ঘরে ঘরে এই মাড়ি পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়।
পোলাওয়ের চাল ভিজিয়ে শীল পাটায় বেটে অথবা ব্লেন্ড করে তা দুধ, গুড়, নারকেল ও গরম মসলা দিয়ে রান্না করা হয়। তবে পায়েসের মতো একদম পাতলা করা হয় না। এই পিঠা হাত দিয়ে খাওয়া হয়ে থাকে। রান্না করা সুস্বাদু এই পিঠা পাকা কাঁঠালের সাথে মেখে খেতে অসাধারণ।
কুমিল্লার বিখ্যাত স্থানসমূহ
কুমিল্লা একটি প্রাচীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জেলা। এই জেলা প্রাচীনকালে সমতট জনপদের অন্তর্গত ছিল। কুমিল্লা জেলাতে অনেক দর্শনীয় স্থানসমূহ রয়েছে। যেমনঃ শালবন বৌদ্ধ বিহার, ময়নামতি জাদুঘর, ধর্মসাগর দিঘী ইত্যাদি। এই জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ সমৃদ্ধ শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। নিচে এই জেলার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হলো-
শালবন বৌদ্ধ বিহার
এক সময় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রধান উপাসনালয় শালবন বৌদ্ধ বিহার ছিল কুমিল্লায়। এই শালবন বৌদ্ধ বিহারের অবস্থান ছিল কুমিল্লার কোটবাড়িতে। এখানে একটি বন রয়েছে। যেই বনে প্রচুর পরিমাণে শাল গাছ পাওয়া যেত স্বভাবত সেজন্যই বিহারটির নাম শালবন বিহার।
এই বিহারে মোট ১৫৫ টি কক্ষ রয়েছে, যেখানে বুদ্ধের অনুসারিরা ধর্মচর্চা করতেন। বিভিন্ন সময়ে এই বিহার থেকে প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রোঞ্জ ও মাটির মূর্তি, সিলমোহর, ৮টি তাম্রলিপি এবং অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা পাওয়া গেছে।
ময়নামতি জাদুঘর
কুমিল্লার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান হলো ময়নামতি জাদুঘর। ১৯৬৫ সালে কোটবাড়ির শালবন বিহারের পাশেই স্থাপন করা হয় ময়নামতি জাদুঘরের। এই জাদুঘর ঐতিহাসিক নিদর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা। এই জাদুঘরের অবস্থান কুমিল্লা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে সালমানপুরে।
জাদুঘরের ৪২ টি ভিন্ন ভিন্ন সংরক্ষণাগার রয়েছে ব্রোঞ্জ ও পাথরের ছোট-বড় মূর্তি, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রোঞ্জের বিশাল ঘণ্টা, পোড়ামাটির ফলক, মাটির খেলনা, কাঠের পুরানো জিনিসপত্র, মৃৎশিল্প সামগ্রী এবং প্রাচীন হাতে লেখা পান্ডুলিপি। এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো কুমিল্লার চারপত্র, রূপবান ও কোটিলা মুড়া, শ্রীভবদের মহাবিহার, ইটাখোলা, রানির বাংলা ও ভোজ রাজবাড়ি বিহার এবং আনন্দ বিহার খননকালে খুঁজে পাওয়া যায়।
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব সৈনিক শহীদ হয়েছেন সেসব সৈনিকদের ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার একটি আন্তর্জাতিক সমাধিক্ষেত্র এই ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি। এই সমাধিক্ষেত্রে ২৪ জন জাপানি যুদ্ধবন্দি ও একজন বেসামরিক ব্যক্তি সহ মোট ৭৩৭ জন সৈন্যের কবর আছে।
এই সমাধিক্ষেত্রটি প্রায় ৪ দশমিক ৫ একর পাহাড়ি ভূমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে। এই ওয়ার সিমেট্রি বাংলাদেশের দ্বিতীয় কমনওয়েলথ সমাধিক্ষেত্র। স্থানীয়রা একে ইংরেজ কবরস্থান নামে ডাকে। কিন্তু এখানে সমাহিত সৈন্যদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও ইহুদিও রয়েছেন।(wiki)
ধর্মসাগর দীঘি
ধর্মসাগর কুমিল্লা শহরে অবস্থিত একটি বিশাল জলাধার। এটি একটি প্রাচীন দীঘি। রাজা ধর্মপালের নামানুসারে এই দীঘির নাম হয়েছে ধর্মসাগর দীঘি। আনুমানিক ১৭৫০ অথবা ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রজাহিতৈষী রাজা ছিলেন ধর্মপাল। তিনি ছিলেন পাল বংশের রাজা।
১৭৫০ থেকে ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা ধর্মপালের শাসনামলে রাজ্যে এক ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখন পাল বংশের এই জনদরদী রাজা প্রজাদের কষ্ট দূর করার জন্য খনন করে দেন ধর্মসাগর দীঘিটি। এই অঞ্চলের মানুষের জলের কষ্ট নিবারণ করাই ছিল রাজার মূল উদ্দেশ্য। অতঃপর তার নামেই দীঘিটি প্রসিদ্ধি লাভ করে।
আশা করি, আজকের এই আর্টিকেলে আপনারা কুমিল্লা জেলা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পেরেছেন। যেমন, কুমিল্লা জেলার ইতিহাস, কুমিল্লা কিসের জন্য বিখ্যাত, এই জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ সম্পর্কে।
বিভিন্ন জেলার বিখ্যাত স্থান, বাক্তি ও খাবার সম্পর্কে জানতে আমাদের সাইটে চোখ রাখুন।
Leave a Comment