নওগাঁর দর্শনীয় স্থান ও ভ্রমণ গাইড

নওগাঁর দর্শনীয় স্থান ও ভ্রমণ গাইড

নওগাঁর দর্শনীয় স্থান যা উত্তরবঙ্গে ভ্রমণের জন্য সেরা জায়গা। অসংখ্য পুরাতন মসজিদ, মন্দির, গীর্জা ও জমিদার বাড়ি প্রমাণ করে যে নওগাঁ জেলার সভ্যতার ইতিহাস অনেক পুরাতন। আমাদের মধ্যে অনেকে সমৃদ্ধ ইতিহাস জানতে আগ্রহী বা প্রত্নতাত্ত্বিক দর্শনীয় স্থান ঘুরতে চান তাদের জন্য আজকের আর্টিকেলে থাকছে নওগাঁর দর্শনীয় স্থান ও ভ্রমণ গাইড সম্পর্কে বিস্তারিত।

নওগাঁর দর্শনীয় স্থান

নওগাঁ জেলার পরিচয়

নওগাঁ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত একটি জেলা। এর উত্তরে জয়পুরহাট জেলা, পূর্বে বগুড়া জেলা, দক্ষিণে রাজশাহী জেলা এবং পশ্চিমে নাটোর জেলা। জেলাটির আয়তন প্রায় 3,435 বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় 2.5 মিলিয়ন। নওগাঁ নামটি এসেছে নাও গ্রাম থেকে। এটি ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ জেলায় পরিণিত হয়। এখন এটি রাজশাহী বিভাগের একটি অংশ। এই  জেলাটি ১১টি উপজেলায় বিভক্ত। জেমস (নগর বাউল-গায়ক) এবং রাজনীতিবিদ আবদুল জলিল (আ.লীগ) এই জেলার ছিলেন। অসংখ্য ছোট ছোট নদীর লীলাক্ষেত্র এ অঞ্চল। প্রধান নদীগুলো হলো আত্রাই, পুনর্ভবা, ছোট যমুনা, নগর, শিব চলন বিল।

নওগাঁ জেলা ভালো মানের ধান উৎপাদনের জন্য বেশ বিখ্যাত এলাকা এবং নওগাঁতেই সর্বাধিক ধান প্রক্রিয়াজাতকরণ মিল রয়েছে। তাই বিপুল সংখ্যক ধান প্রক্রিয়াকরণ মিলের বিবেচনায় শীর্ষ তালিকায় স্থান পেয়েছে। এমনকি রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার তুলনায় এ জেলায় প্রচুর পরিমাণে ভালো আম উৎপাদিত হয়। নওগাঁ জেলার আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি হল সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুন্ডা।  নওগাঁর প্যারা সন্দেশের খ্যাতি। দুধ ও চিনি ব্যবহার করে তৈরি একটি বিশেষ জাতের মিষ্টি, ইতিমধ্যেই এই মিষ্টি সীমানা ছাড়িয়ে গেছে কারণ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা এই সুস্বাদু মিষ্টি তাদের স্থানীয় আত্মীয়স্বজন এবং প্রিয়জনদের কাছে পাঠায়।

নওগাঁর দর্শনীয় স্থান

নওগাঁর দর্শনীয় স্থান বলতে এ জেলা তার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলির জন্য সুপরিচিত, যার মধ্যে রয়েছে প্রাচীন পুন্ড্র রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ এবং বরেন্দ্রভূমি, একটি অঞ্চল যা তার অনন্য বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত। জেলাটি আম, ধান চাষ এবং তাঁত বস্ত্রের জন্যও বিখ্যাত। নওগাঁর বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষণ স্পট রয়েছে। সেগুলো হলোঃ পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, রবীন্দ্রনাথ কুঠিবাড়ি, কুসুম্বা মসজিদ সহ আরও অনেক কিছু। এগুলো নওগাঁর কিছু জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ। দর্শনীয় স্থানগুলো এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের একটি অনন্য আভাস দেয়। নিম্নে বিখ্যাত কয়েকটি দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণ্না করা হলো।

পাহাড়পুর জাদুঘর

পাহাড়পুর জাদুঘর

দক্ষিন এশিয়ার সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন পাহাড়পুর হলো বৌদ্ধবিহার। এটি নওগাঁ জেলা থেকে প্রায় ৩৫ কি.মি উত্তরে পাহাড়পুর ইউনিয়নে পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। প্রাচীন বৌদ্ধবিহারটি তৈরি করেছিলেন পালরাজ ধর্মপাল। ষাটের দশকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এখানে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে। পাহাড়পুর জাদুঘর সংস্কৃতির পরিসর সম্পর্কে একটি ভাল ধারণা দেয়।

১৯৯৪ সালে পুরাতন জাদুঘরের পরিবর্তে একটি নতুন জাদুঘর ভবন তৈরি হয়েছিল। পাহাড়পুর জাদুঘরটি চার গ্যালারি বিশিষ্ট একটি জাদুঘর। এখানে পাওয়া বিভিন্ন প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। এ জাদুঘরে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংরক্ষিত নিদর্শন রয়েছে। যেমনঃ অলংকৃত ইট, পোড়ামাটির ফলক, একটি মাঝারি আকারের ব্রোঞ্চের তৈরি বৌদ্ধের আবক্ষ অংশ, পোড়ামাটির তৈজসপত্র, পাথরের মূর্তি, ইত্যাদি ।

কিভাবে যাবেন

নওগাঁ শহর হতে বদলগাছী উপজেলা হয়ে পাহাড়পুর বাজারে যাবেন। তারপর  পাহাড়পুর বাজার হতে ২ কি: মি: রাস্তায় সিএনজি, অটোরিক্সা কিংবা ভ্যান রিক্সা করে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার যাওয়া যায়।

ডানা পার্ক

ডানা পার্ক

নওগাঁ জেলার ভবানীপুর গ্রামে প্রায় ১০টি বড় জমির ওপর নির্মিত হয়েছে ডানা পার্ক। এখানে  সব বয়সের দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য রয়েছে  টয় ট্রেন, নাগরদোলা, চরকি, মেরিগো হর্স, প্যাডেল বোট, স্লিপার, সুইং, লাইভ হর্স, চিলড্রেন কর্নার, সুইমিং পুল, কটেজ, রেস্টুরেন্ট, কমিউনিটি সেন্টার এবং পিকনিক সুবিধাসহ বিভিন্ন আকর্ষণ। ডানা পার্কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য। যেমনঃ  হাতি, হরিণ, বাঘ, ক্যাঙ্গারু, ঘোড়া, জিরাফ, বক ইত্যাদির ভাস্কর্য। এছাড়াও পার্কের দেয়ালে গ্রামবাংলার বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। যে কেউ টিকেট কেটে  ডানা পার্ক পুকুরে নৌকা ভ্রমণের সুবিধা নিতে পারেন।

ডানা পার্কে প্রবেশের টিকেট জনপ্রতি ২০ টাকা। বিভিন্ন রাইডের মূল্য 10 টাকা এবং সুইমিং পুল ব্যবহার করলে জনপ্রতি 50 টাকা। দানা পার্ক প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সকল দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

কিভাবে যাবেন

যেকোন জেলা থেকে নওগাঁর উদ্দেশ্যে রওনা দিবেন। নওগাঁ শহর থেকে অটো কিংবা রিকশা নিয়ে ডানা পার্ক যেতে পারবেন।

সোমপুর মহাবিহার

সোমপুর মহাবিহার

সোমপুর মহাবিহার বাংলাদেশের অতি প্রাচীন বাংলার একটি বৌদ্ধ বিহার। এটা শুধু কোনো জায়গা নয়; এটি অনেক ইতিহাস এবং প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক একটি জায়গা যা নওগাঁর দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। 1879 সালে, স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশাল কাঠামো আবিষ্কার করেন। এই স্থানটি  প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের জন্য বিখ্যাত। 1985 সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।  সোমপুর মহাবিহার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রাচীন উপাসনালয়।

এখানে শান্তিপূর্ণ জায়গায় একটি বড় মঠ রয়েছে, যেখানে সন্ন্যাসীরা থাকেন এবং প্রার্থনা করেন। এই মঠটি 770-810 শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। মঠের সামনে অবস্থিত জাদুঘরে মূল্যবান পাথর, তামার মুদ্রা এবং অন্যান্য উপকরণ সংরক্ষিত আছে। বিহারের দেয়ালে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম খণ্ডায়িত আছে। সোমপুর মহাবিহার পাহাড়পুর এলাকায় অবস্থানের কারনে অনেকে একে পাহাড়পুর বিহার নামেও চিনেন। সোমপুর মহাবিহার ১৩০০ বছরেরও বেশি আগে তৈরি হয়েছিল। ভাবুন তো কত পুরনো! এটি সেই সময়ের উন্নত স্থাপত্য কৌশলগুলির একটি নিখুঁত উদাহরণ। সারা বিশ্ব থেকে লোকেরা এই জায়গাটি দেখতে আসে কারণ এটি অতীতের ঐতিহ্য তুলে ধরে। (wiki)

কিভাবে যাবেন

সোমপুর মহাবিহার নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। নওগাঁ জেলার বালুডাংগা বাস টার্মিনাল থেকে বাসে করে আনুমানিক ৩২ কিঃমিঃ দূরে ঐতিহাসিক পাহাড়পুরে যাওয়া যায় ।

দিব্যক জয়স্তম্ভ

দিব্যক জয়স্তম্ভ

দিব্যক জয়স্তম্ভ বাঙালি আভিজাত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। এটি পত্নীতলা উপজেলার দিবর দীঘির মাঝখানে অবস্থিত। এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি এই অঞ্চলে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। স্তম্ভটি ৩১ ফুট ৮ ইঞ্চি লম্বা। এতে সুন্দর স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা সেই সময়ের কারিগরদের দক্ষতা প্রদর্শন করে। এটি গ্রানাইট দিয়ে তৈরি এবং আটটি কোণ রয়েছে। স্তম্ভটি খাঁজযুক্ত মুকুট দ্বারা সজ্জিত, যা এটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।

দিব্যক জয়স্তম্ভ  বড় বিজয়ের স্মরণে নির্মিত বলে মনে করা হয়। যদিও এর সঠিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। দিব্যক জয়স্তম্ভ সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে।

আজ, দিব্যক জয়স্তম্ভ এলাকার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক স্থানগুলির মধ্যে একটি। যা স্থানীয় এবং পর্যটক উভয়কেই আকর্ষণ করে।

কুসুম্বা মসজিদ

কুসুম্বা মসজিদ

কুসুম্বা মসজিদটি নওগাঁ সদর থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।১৫৫৮ সালে গিয়াস আহমেদ শাহের শাসনামলে মসজিদটি নির্মিত হয়। এই মসজিদটি প্রায় চারশ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের পাঁচ টাকার নোটে এর ছবি ছাপা হয়েছে। মসজিদের আরেক নাম কালাপাহাড়। মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ৯৬৬ হিজরিতে (১৫৫৮-৫৯ খ্রি.)।

এই মসজিদটি দৈর্ঘ্যে 58 ফুট এবং চওড়া 42 ফুট। মসজিদের চারপাশের দেয়াল ছয় ফুট পুরু। মসজিদের বাইরের অংশ পাথর দিয়ে ঢাকা। মসজিদের সামনের দিকে তিনটি দরজা রয়েছে। দুটি দরজা আকারে বড় এবং অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোট। দরজাগুলো মিহরাব আকৃতির। মসজিদের চার কোনায় চারটি মিনার রয়েছে। মিনারগুলো মসজিদের ছাদ পর্যন্ত লম্বা এবং আট কোণ আকৃতির। ছাদে ছয়টি গম্বুজ আছে যেগুলো দুই সারিতে তৈরি। 1897 সালের ভূমিকম্পে এই মসজিদটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দ্বারা সংরক্ষিত রয়েছে।

কিভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী যেকোন বাসে চড়ে নওগাঁ যেতে পারবেন। নওগাঁ শহর থেকে বাস অথবা সি এন জি করে কুসুম্বা মসজিদ যাওয়া যায়।

রবি ঠাকুরের কুঠিবাড়ী

রবি ঠাকুরের কুঠিবাড়ী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিসৌধ, শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। এটি নওগাঁর আত্রাইয় উপজেলায় অবস্থিত। কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দিবসে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। রবি ঠাকুরের জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ ছিল এই কুঠিবাড়ি। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এই অঞ্চলের জমিদারি লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অঞ্চলের জমিদারীতে আসেন। এখানে তিনি ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারি পরিচালনা করেন।

এখানে তিনি স্বর্ণ, চিত্রা, চৈতালী প্রভৃতি রচনা করেন। এমনকি ‘গীতাঞ্জলি’র অনুবাদের কাজও এখানে শুরু হয়। ১৯৫৮ সাল থেকে, শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের গৌরবময় স্মৃতিতে সংরক্ষিত ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কুঠিবর্তির গুরুত্ব অনুধাবন করে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংরক্ষণ করে বাড়িটিকে জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

কিভাবে যাবেন

নওগাঁ শহর থেকে বাস কিংবা যেকোন স্থানীয় যাতায়াত ব্যবস্থায় আত্রাইয় উপজেলায় যেতে পারবেন।

শেষ কথা

নওগাঁর দর্শনীয় স্থান সমৃদ্ধ ইতিহাসে ভরপুর। যারা অনন্য সংস্কৃতি, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ও এবং শান্ত পরিবেশ উপভোগ করতে চান তাদের জন্য নওগাঁ জেলা একটি চমৎকার জায়গা। আশা করছি, আজকের আর্টিকেল থেকে নওগাঁর দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে  জানতে পেরেছেন। তাই উত্তরবঙ্গ ভ্রমণে যেতে চাইলে  নওগাঁ জেলাকে বেছে নিন। নওগাঁ আপনার জন্য একটি অবিস্মরণীয় ভ্রমণের জন্য অপেক্ষা করছে।

দেশের বিভিন্ন জেলার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে জানতে আমাদের সাইটে চোখ রাখুন

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *