গাজীপুর জেলা শতবর্ষের নানা ইতিহাস ঐতিহ্যে লালিত এক সুপ্রাচীন ও ঐতিহাসিক জনপদ, যার রয়েছে এক বিশাল সমৃদ্ধ অতীত। কালের বিবর্তনে ঐতিহ্যবাহী গাজীপুর জেলা সমৃদ্ধ হয়েছে নানান দর্শনীয় পর্যটন শিল্পের কারণে। রাজধানী ঢাকা জেলার সাথে লাগোয়া গাজীপুর দর্শনীয় স্থান ও প্রত্নসম্পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো;
গাজীপুর সাফারি পার্ক বা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, জল জঙ্গলের কাব্য, নুহাশ পল্লী, ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্ক, বেলাই বিল, সোহাগ পল্লী, ভাওয়াল রাজবাড়ী, ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, দত্তপাড়া জমিদার বাড়ি, সিংগারদিঘী, আনন্দ পার্ক ও শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ি। আপনাদের জানার সুবিধার্থে নিচে গাজীপুর দর্শনীয় স্থান গুলোর সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য দেওয়া হলো-
গাজীপুর দর্শনীয় স্থান
গাজীপুর হলো গাজীপুর জেলার একটি শহর। এটি ঢাকার সন্নিকটে অবস্থিত। অনেকগুলো ভারী এবং মাঝারি শিল্প এলাকা নিয়ে এই শহর গড়ে উঠেছে। দেশের সর্ববৃহৎ ফসল গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ জেলায় অবস্থিত। এছাড়াও গাজীপুর জেলার যেসব দর্শনীয় স্থানগুলো রয়েছে এবং গাজীপুর দর্শনীয় স্থান গুলোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই আর্টিকেলের মাধ্যমে তুলে ধরবো। চলুন শুরু করা যাক-
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক
গাজীপুর দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক অন্যতম। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নে অবস্থিত। বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে প্রবেশ পথ বাঘের বাজার থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে। পার্কের মধ্যে একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে, সেখান থেকে আপনি পুরো সাফারি পার্ক সহ সমগ্র গাজীপুর এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দয্য উপভোগ করতে পারবেন।[উইকি]
পার্কটি ঢাকা শহরের কাছাকাছি অবস্থিত হওয়াই আপনি আপনার পরিবারের সাথে এক দিনে ঘুরে দেখতে পারেন এবং একই দিনে ঢাকায় ফিরে আসতে পারেন। এই সাফারি পার্কের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে কোর সাফারি। চারপাশে উন্মুক্ত বাঘ, সিংহ, জিরাফ, জেব্রা, বন্য হরিণ, ও অন্যান্য প্রাণী হেঁটে বেড়াচ্ছে আর তার মাঝ দিয়ে আপনি মিনি বাস দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
প্রায় ৩ হাজার ৬৯০ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে রয়েছে ছোট ছোট টিলা ও শালবন। থাইল্যান্ডের সাফারি ওয়ার্ল্ডের অনুকরণে ২০১৩ সালে এটি গড়ে তোলা হয়। গাজীপুর সাফারি পার্ক ৫ ভাগে বিভক্ত-
- কোর সাফারি,
- সাফারি কিংডম,
- জীববৈচিত্র্য পার্ক,
- বিস্তৃত এশিয়ান সাফারি পার্ক এবং
- বঙ্গবন্ধু চত্বর।
সাফারি পার্কে প্রবেশ মূল্য
সকল বাংলাদেশি নাগরিকদের পার্কে প্রবেশ টিকেটের মূল্য ৫০ টাকা, তবে ১৮ বছরের নিচে ছেলেমেয়েরা ২০ টাকায় পার্কে প্রবেশ করতে পারবে। শিক্ষা সফরে আসা শিক্ষার্থীদের পার্কে প্রবেশ করতে লাগবে ১০ টাকা। বিদেশী পর্যটকদের লাগবে ৫ ডলার।
কিভাবে যাবেন
সর্বপ্রথম আপনাকে ঢাকার মহাখালী থেকে ভালুকা বা ময়মনসিংহ গামী বাসে গাজিপুরের চৌরাস্তা অতিক্রম করে বাঘের বাজারে নামতে হবে। সেখান থেকে রিকশা বা অটোরিকশা যোগে সাফারি পার্কে যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৩০-৪০ টাকা।
বেলাই বিল
বেলাই বিল গাজীপুর দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে একটি নিদর্শন। এটি গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর উপজেলায় কানাইয়া এলাকায় অবস্থিত। এটি গাজীপুরের অন্যতম একটি জায়গা, যার রুপে গুনে সৌন্দয্যে এই জেলার সকল স্থানের শীর্ষে। বিশাল বড় এই বিলটির কিছু কিছু জায়গাতে কোন সময়ই পানি শুকিয়ে যায় না। বর্ষাকালে বৃষ্টির মধ্যে এর সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। বিকেল বেলায় যখন সূর্যের আলোটা বিলের মধ্যে গিয়ে পড়ে তখন এর সৌন্দর্য আরো বেশি বেড়ে যায়।
বিলতে সারা বছর পানি না থাকলেও বর্ষার পানি দ্বিগুণ হওয়াই বিল জুরে চলে শাপলা ফুলের মেলা। লাল, সাদা শাপলা তাদের নিজস্ব রাজ্য খুলে বসে আছে। ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করে নিজেরাই চালিয়ে ঘুরতে পারবেন শাপলার রাজ্য বেলাই বিল। বিকেলের বিলটির দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। বাজারের নতুন ব্রিজের উপর থেকে এই দৃশ্য দেখলে কিছুক্ষণের জন্য ধ্যানে পড়ে যাবেন। চাইলে ঘুরে আসতে পারেন বিলের মধ্যে অবস্থিত বামচিনি মৌজা নামক দ্বীপ গ্রামটি থেকে।
কিভাবে যাবেন
ঢাকার যেকোন স্থান থেকে বাস বা সুবিধা জনক পরিবহণে গাজীপুর শিববাড়িতে নেমে পড়বেন। সেখান থেকে রিকশা বা সিএনজি করে কানাইয়া বাজার আসতে হবে। কানাইয়া বাজার ঘাটে বিল ভ্রমনের জন্য নৌকা ভাড়া পাবেন, দরদাম করে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন উন্মুক্ত বিলে। ছোট নৌকা হলে সারা দিন ভাড়া নিবে ৫০০-৬০০ টাকা আর বড় নৌকা হলে ১৫০০-২০০০ টাকা নিবে।
ভাওয়াল রাজবাড়ি
বাংলাদেশের মধ্যে আরেকটি অন্যতম রাজবাড়ী হলো এই ভাওয়াল রাজবাড়ী, যেটি অবস্থিত হলো গাজীপুর জেলায়। রাজবাড়ীটি স্থাপিত হয়েছে ১৭০৪ সালে যা এখনো ঠিক নতুন এর মত দাঁড়িয়ে আছে। এই রাজবাড়ীর বিশাল এলাকা জুড়ে প্রায় ৫ লক্ষ প্রজা বস বাস করত। এই বাড়িটি রামেন্দ্রনারায়ন রায় এর আমলে নির্মান করা হয়।
বর্তমানে ভাওয়াল রাজবাড়ি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কারুকার্য খচিত সীমানা ঘেরা ভাওয়াল রাজবাড়ির প্রবেশ পথে নজরে পড়বে সারা বছর ফুলে ছেয়ে থাকা নাগলিঙ্গম ফুলের গাছ। রাজবাড়ির পশ্চিম দিকে রয়েছে বিশাল দীঘি ও সামনে বিসৃতত সমতল মাঠ।
কিভাবে যাবেন
ভাওয়াল রাজবাড়ি যেতে চাইলে আপনে প্রথমে গাজীপুর চৌরাস্তা আসতে হবে। সেখান থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে শিবপুর মোড় হয়ে জয়দেবপুর সড়ক ধরে পুর্বদিকে এগিয়ে গেলেই ভাওয়ালের রাজবাড়ি পৌঁছে যাবেন। এছাড়াও চৌরাস্তা থেকে যেকোন রিকশাওয়ালাকে জেলা প্রশাসকের কার্যলয় বললে ভাওয়ালের রাজবাড়ি আসতে পারবেন।
নুহাশ পল্লী
নুহাশ পল্লী গাজীপুর সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে পিরুজালী গ্রামে অবস্থিত। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ১৯৮৭ সালে প্রায় ২২ বিঘা জমির ওপর নিজের ছেলে নুহাশের নামে এটি গড়ে তোলেন। যা গাজীপুর দর্শনীয় স্থান হিসেবে সকলের কাছে অনেক পরিচিত। ২০১২ সালে মৃত্যুর পর এখানেই শায়িত আছেন গল্পের এই জাদুকর।
নুহাশ পল্লীর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল লীলাবতী দীঘি। এই দীঘির চারপাশ জুড়ে দেখবেন নানা রকমের গাছ। এখানে আরো রয়েছে সানকাধানো ঘাট। নুহাশ পল্লীতে ২৫০ প্রজাতির দূর্লভ ঔষধি, ফলজ, বনজ এবং মসলা জাতীয় গাছ রয়েছে। প্রত্যেক গাছের গায়ে সেটে দেয়া আছে পরিচিতি ফলক, যা দেখে খুব সহজে গাছ চেনা যাবে।
কিভাবে যাবেন
নুহাশ পল্লী তে যেতে প্রথমে আপনাকে গাজীপুর জেলার হোতাপাড়া স্ট্যান্ডে আসতে হবে। সেখান থেকে রিকশা বা সিএনজি করে নুহাশ পল্লীতে যাওয়া যায়। রিকশা ভাড়া লাগবে ৬০-৭০ টাকা ও সিএনজি ভাড়া লাগবে ১৩০-১৪০ টাকা।
নুহাশ পল্লীতে প্রবেশ মূল্য
নুহাশ পল্লীতে ঢুকতে পূর্ব অনুমতি লাগেনা। ২০০ টাকা এন্ট্রি ফি দিয়ে যে কেও ঢুকতে পারে। ১০ বছরের নিচে বাচ্চাদের, ড্রাইভার এবং গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য টাকা লাগেনা। হুমায়ন আহম্মেদ এর কবর জিয়ারত করতে গেলে কোন প্রবেশ ফি লাগেনা।
আনন্দ পার্ক
আনন্দ পার্ক গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার একটি পরিচিত জায়গা। প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে মিশে যাওয়া ও মন ভালো করার শান্তশিষ্ট একটি জায়গা আনন্দ পার্ক। যেখানে রয়েছে বিনোদন এর সব আয়োজনের ব্যবস্থা। ঢাকার মধ্যে যারা বসবাস করেন তারা চাইলেই একদিনের মধ্যে ঘুরে আবার আসতে পারবেন এই জায়গাটি থেকে। ৪২ বিঘা উঁচু নিচু টিলা ভুমিতে গড়ে তোলা হয়েছে আনন্দ পার্ক রিসোর্টটি। বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ গাছ এবং ফুলের গাছের বিশাল সমাহার রয়েছে এখানে।
মনোমুগ্ধকর স্থান আনন্দ পার্ক রিসোর্টে রাতে থাকার জন্য ৮ টি নন এসি রুমসহ বিভিন্ন সাইজ সম্বলিত ৬ টি কটেজ রয়েছে। নন এসি রুম ২৪ ঘন্টার জন্য ভাড়া ৩০০০ টাকা। একটি বেড রুম সহ কটেজ ভাড়া ৬০০০ হাজার টাকা।
আনন্দ পার্ক রিসোর্ট খরচ
মান ও ধরন অনুযায়ী আনন্দ রিসোর্টে ২৪ ঘন্টার জন্য একটি রুম ভাড়া নিতে খরচ পড়বে ৩০০০ থেকে ১৪০০০ টাকা পর্যন্ত। এখানে পিকনিকের জন্য স্পট ভাড়া ৫০,০০০ টাকা ও সম্পূর্ণ পিকনিক স্পট ভাড়া নিতে প্রায় ২,৫০,০০০ টাকা খরচ পড়বে। এছাড়া এই রিসোর্টে কনফারেন্স হলের ভাড়া ৪০,০০০ টাকা।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবস্থিত সফিপুর বাজার থেকে ২ কিলোমিটার উত্তরে সিনাবাহ বাজারের কাছে আনন্দ রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে। নিজস্ব পরিবহন বা যাত্রীবাহী বাসে করে গাজীপুর চৌরাস্তা হয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ধরে সফিপুর বাজারে যেতে হবে। সেখান থেকে অটোরিকশা বা সিএনজি করে আনন্দ পার্ক রিসোর্টে যাওয়া যায়।
শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ি
শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ি গাজীপুর দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন। গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরের শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ি ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে তিনটি জমিদার বাড়ি রয়েছে। জমিদার বাড়িগুলো প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যাবে। রহিম নেওয়াজ খান চৌধুরীর মাধ্যমে এই জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন ঘটে। যেকোন দর্শনার্থী শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ির দুটি অংশ ঘুরে দেখতে পারেন। ছোট অংশে জমিদারের বর্তমান উত্তরাধিকারগণ বসবাস করেন ফলে এখানে প্রবেশের জন্য অনুমতি প্রয়োজন।
প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা, এই জমিদারির ইতিহাস প্রায় দুইশ বছরের। সেকালে জমিদারদের মাঝে এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা হত তাদের শান সাওকাত, বাড়ি ঘর, পুকুর, স্কুল-কলেজ, চিকিৎসালয় নিয়ে। প্রতিযোগিতা হত কার বাড়ি কত বড় আর কি তাদের কারুকাজ। এসব বিষয়ে জমিদারদের নিরব প্রতিযোগিতারই একটা ফসল এই জমিদারী এলাকা আর জমিদার বাড়ি।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে যেকোন পরিবহণে করে গাজীপুর জেলা কালিয়াকৈরের শ্রীফলতলী মোড়ে নামতে হবে। গাবতলি সাভার রোড ধরে আসা যায়। বাসে করে গাজীপুরের চন্দ্রা মোড়ে এসে অন্য লোকাল বাসে করে কালিয়াকৈর বাজারে যেতে হবে, সেখান থেকে রিকশা করে জমিদার বাড়ি যাওয়া যায়। এক্ষেত্রে জনপ্রতি ২০-২৫ টাকা ভাড়া নিবে।
সর্বশেষ কথা
এই আর্টিকেলটি পড়ে যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই আপনার বন্ধু বান্ধবদের সাথে শেয়ার করবেন যাতে তারা গাজীপুর দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে জানতে পারে। এই রকম আরও বিভিন্ন জেলার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে আর্টিকেলটি পেতে ভিজিট করুন আমাদের এই ওয়েব সাইটটিতে।
Leave a Comment