আপনি যদি সিজারিয়ান ডেলিভারির পরিকল্পনা করছেন বা সি-সেকশন করার জন্য আপনি প্রস্তুত থাকতে চান তাহলে সিজারের পর আপনার খাবার তালিকা কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে আপনার প্রশ্ন থাকতে পারে। সি-সেকশন করার পর কীভাবে নিজের এবং আপনার শিশুর যত্ন নেবেন তা আপনাকে জেনে রাখতে হবে।
সন্তান প্রসবের আগে ও পরে সিজারিয়ান মায়ের যত্ন সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরী। তাই আজকের আর্টিকেলে আমি সিজারের পর মায়ের যত্ন কিভাবে নিবেন সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। তা ছাড়াও এই আর্টিকেলের মাধ্যমে জানতে পারবেন একজন প্রসূতি মায়ের সিজারের পর খাবার তালিকা সম্পর্কে নির্দেশিকা।
সিজার কি?
সিজারিয়ান সেকশন একটি নারীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অপারেশন। ইংরেজি Caesarean section বা মার্কিন ইংরেজিতে Cesarean section যা সি-সেকশন (C-section)(wiki) বা সিজার (Caesar) নামেও পরিচিত। যা এক বা একাধিক শিশু জন্মদানের জন্য মায়ের উদর ও জরায়ুতে করা হয়। বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক উপায়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার বিকল্পে সিজারের সাহায্যে নবজাতকের জন্ম দিয়ে থাকে। অনেক সময় প্রাকৃতিক পন্থায় নবজাতক জন্মদানে মা ও শিশুর জীবন হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। তাই প্রাকৃতিক নিয়মে নবজাতকের প্রসব সম্ভব হলেও অনেক মা সিজারের মাধ্যমে শিশু জন্মদানের জন্য ডাক্তারের কাছে অনুরোধ করে থাকেন। তবে সিজার পরবর্তী সময়ে মায়ের সঠিক যত্ন কিভাবে নিতে হয় সে ব্যাপারে অনেকের স্পষ্ট ধারণা নেই।
সিজারের পর মায়ের যত্ন
সিজারিয়ান ডেলিভারি করা মায়েদের জন্য এই সময়টা খুব বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়। প্রসবোত্তর সময়ে মাতৃ মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, তাই মায়ের যত্নের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। সিজারের পর প্রথম ৬ সপ্তাহ প্রসূতি মা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মেনে চলে। কমপক্ষে ৩ দিন পর গোসল করতে হবে। গোসলের সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন সেলাইয়ের জায়গা না ভেজে । সেলাইয়ের জায়গা বার বার ভিজলে সেলাই তাড়াতাড়ি শুকাবে না। যদি সেলাইয়ের জায়গা উঁচু হয়ে ওঠে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শে ক্রিম লাগাতে হবে।
পরবর্তী ১ বছর পর্যন্ত কোনো ভারী কাজ করা যাবে না এবং ভারী কিছু তোলা থেকে এড়িয়ে চলা উচিত। বেশিরভাগ গৃহস্থালির কাজ এড়ানো উচিত। স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে হবে। সিজারের পর একজন প্রসূতি মায়ের ঠিকমত ঘুম ও বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। সেলাই না শুকানো পর্যন্ত সাবধানতা মেনে চলে ঘুমানো উচিত। ঘুমানোর সময় বাম দিকে সোয়া এবং পরবর্তী ৬ মাস পর্যন্ত সেই নিয়ম অনুযায়ী শুতে হবে। ঠান্ডা বা এলার্জি থাকলে আগেই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। কারণ ঠান্ডা জনিত সমস্যার কারণে বারবার হাঁচি বা কাশি হলে সেলাইয়ের জায়গায় ব্যথা অনুভূত হতে পারে। সিজারের পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ নারীর পা ফুলে যায়। এজন্য খেয়াল রাখতে হবে এ সময় পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে ঘুমালে পা ফোলা কমে যাবে।
এই সময় আপনার শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। আপনার শরীরের শক্তি পুনরুদ্ধার করতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করতে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে।
সিজারিয়ান সেকশন এর পরবর্তী সময়ে একজন নারীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে অনেকটা সময়ের প্রয়োজন হয়। তাই এ সময়ে মায়ের সঠিক যত্ন এবং বিশ্রাম নেওয়া অত্যন্ত জরুরী । শুধু তাই নয়, সিজারের পর কি কি খাওয়া যাবে না এ সম্পর্কে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। নিচে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করেছি, তবে আপনি যদি একজন সিজারিয়ান মা হয়ে থাকেন তাহলে ডাক্তার আপনার শরীরের অবস্থা দেখে বলে দিবেন যে সিজারের পর কি কি খাওয়া যাবে না। তাই, অবশ্যই আপনার খাবার তালিকা একজন গাইনী বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে জেনে নিবেন।
সিজারের পর খাবার তালিকা
সি সেকশনের পর কি ধরনের খাবার খেতে হবে তা একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার একটি ডায়েট চার্ট তৈরি করে দিবে। তারপরেও কিছু খাবার আছে যা ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার, রঙিন শাকসবজি, ভেষজ এবং পুষ্টিকর উষ্ণ স্যুপের মতো প্রদাহবিরোধী খাবারগুলো গ্রহণ করা উচিত। এই খাবারগুলো আপনার হজমের উন্নতি করতে সাহায্য করতে পারে, দ্রুত ক্ষত নিরাময় করতে পারে এমনকি আপনার বুকের দুধে উৎপাদন বাড়াতে পারে। তাই সিজারের পর আপনার খাবার তালিকায় সুষম খাদ্য খাওয়ার চেষ্টা করুন। নিচের অংশে আমরা এর আরো বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।
আয়রন সমৃদ্ধ খাবার
শরীরে হিমোগ্লোবিন উৎপাদন এর জন্য আয়রন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর বাচ্চা প্রসবের সময় প্রসূতি মায়েদের জন্য আয়রন অত্যাবশ্যকীয়। হিমোগ্লোবিন এক ধরণের প্রোটিন যা আপনার শরীরে লাল রক্ত কণিকার মধ্যে থাকে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করে। গর্ভবতী মহিলার জন্য দৈনিক ২৭ মিলিগ্রাম আয়রন প্রয়োজন। আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে কুমড়ার বীচি, ডিমের কুসুম, পালং শাক, লাল মাংস, সিদ্ধ আলু, ঝিনুক, কলিজা এবং শুকনো ফল(কাজুবাদাম, কিসমিশ) সবচেয়ে ভালো উৎস। আয়রনের ঘাটতি পূরণের জন্য উনিশ বছরের বেশি বয়সী মহিলাদের দিনে ১৮ মিলিগ্রাম আয়রন খাওয়া প্রয়োজন। অত্যধিক আয়রন গ্রহণ করার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। তাই পরিমাপমত আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত।
প্রচুর পরিমাণে পানি পান
একজন প্রসূতি মায়ের জন্য পর্যাপ্ত পানি পান করা উচিত। কারণ, স্তন্যদানকারী মা প্রচুর ডিহাইড্রেশন ঝুঁকিতে ভোগেন। প্রচুর পরিমাণে পানি গ্রহণ করার ফলে প্রসূতি মায়ের জন্য বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে যেমনঃ কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করা এবং পেটে অতিরিক্ত চাপ কমানো। এই কারণেই সিজারের পর নতুন মায়েদের তরল জাতীয় খাবার খাওয়ার জন্য উত্সাহিত করা হয়। যেমনঃ আদা চা, মুরগির স্যুপ, স্যুপ কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ নুডুলস ইত্যাদি।
তরল জাতীয় খাবারের মধ্যে একটি ভাল স্যুপ হল “সবুজ পেঁপের ভেষজ মাছের স্যুপ”, যা সবুজ পেঁপে, মাছ, স্নেকহেড, আদা এবং রসুন দিয়ে তৈরি করা হয়।
প্রোটিন এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার
সিজারিয়ান ডেলিভারির পরে প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবারগুলো নিতান্তই সেরা খাবার হিসেবে বিবেচিত। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য আপনার শরীরের নতুন টিস্যু বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তবে প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবারের উপকারিতা এখানেই থেমে থাকে না। আপনার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে নবজাতক ২৫০ থেকে ৩৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম পায়। তাই এই প্রয়োজনীয়তাগুলিকে সহায়তা করার জন্য একটি বর্ধিত প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত।
অপরদিকে ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি, আয়রন এবং জিঙ্কের মতো খনিজ পদার্থে গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা আপনার ক্ষত মেরামত প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে এবং কোলাজেন উৎপাদনে সাহায্য করতে পারে।
এখানে কিছু প্রোটিন- এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার রয়েছে যা ব্যাপকভাবে সিজারিয়ান ডেলিভারির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমনঃ ডিম, দুধ, মাছ, গরুর মাংস, মিষ্টি কুমড়ার বিচি ইত্যাদি। উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের মধ্যে রয়েছে মসুর ডাল, শাকসবজি ইত্যাদি।
গোটা শস্য জাতীয় খাবার
গোটা শস্য জাতীয় খাবার প্রসূতি মায়ের বুকের দুধ উৎপাদন করতে সহায়তা করে। গোটা শস্য জাতীয় খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গম, ভুট্টা, বাদামি চাল, বাদামী রুটি ইত্যাদি। এই খাবারগুলিতে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে যা নবজাতক শিশুর বিকাশে প্রাথমিক পর্যায়ে আয়রন, ফাইবার এবং ফলিক অ্যাসিড তৈরিতে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। যে মায়েরা ঘুমহীন রাত বা বুক জ্বালাপোড়ায় ভুগছেন তারা প্রতিদিন সকালের নাস্তায় গোটা শস্যদানা খাবার খেতে পারেন।
সিজারের পর কি কি খাওয়া যাবে না?
নতুন মায়েরা সন্তান জন্ম দেওয়ার পরে দীর্ঘদিন সার্জারী এর ক্ষত নিরাময়ের ঝুঁকিতে থাকে। তাই আপনাকে অবশ্যই আপনার খাদ্যাভ্যাসের দিকে নজর দিতে হবে এবং অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে।
সিজারের পরে যে খাবারগুলি এড়িয়ে চলা উচিত তার মধ্যে রয়েছে শর্করাযুক্ত খাবার, মসলাযুক্ত খাবার এবং তেলে ভাজা খাবারগুলি যা প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং শরীরের ক্ষত নিরাময় প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই সিজারিয়ান ডেলিভারির পরে এই সাধারণ তিনটি খাবার এড়ানো সবচেয়ে ভালো। তা ছাড়াও কার্বনেটেড ড্রিংক বা কোমল পানীয়, কিছু শাকসবজি এবং খাবার যা ফোলাভাব সৃষ্টি করে, চা-কফি জাতীয় খাবার, অ্যালকোহল, ঠান্ডা খাবার ইত্যাদি।
সিজারের পর কী খাবার খাওয়া উচিত এবং পরবর্তীতে কী খাবারগুলি এড়িয়ে চলা উচিত তাও জানা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শেষ কথা
একজন সদ্য মায়ের জন্য সিজারের পরের সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ডাক্তার সি-সেকশন ডেলিভারির পরে একটি ডায়েট চার্ট তৈরি করে দেয়। এই ডায়েট চার্ট আপনাকে যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। কারণ, একটি সুষম খাদ্য আপনার সার্জারি থেকে পুনরুদ্ধার করতে এবং আপনার শিশুকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করতে পারে। তাই সিজারের জটিলতা থেকে রক্ষা পেতে আপনার খাদ্য তালিকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
আমরা এই আর্টিকেলে একজন সন্তান প্রসূতি মায়ের যত্ন এবং সিজারের পর খাবার তালিকা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আপনি যদি উপরে উল্লিখিত খাদ্য তালিকার মধ্য কোনো খাবারে অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হন তাহলে আপনি ডাক্তারের পরামর্শ দিতে পারেন। আশা করছি, আপনারা এই আর্টিকেল পড়ে দ্রুত সুস্থতার জন্য খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করবেন। আজকের আর্টিকেলটি যদি আপনাদের উপকৃত করে তাহলে অবশ্যই নব প্রসূতি মায়েদের সাথে এই আর্টিকেল শেয়ার করতে ভুলবেন না।
আরও পড়ুনঃ- গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা।
Leave a Comment