ঘি বাঙালিদের জন্য একটি সুপার ফুড। ভোজন রসিক বাঙালি জাতি এই ঐতিহ্যবাহী পণ্য খাবারের পুষ্টিগুণ ও স্বাদ বাড়াতে খেয়ে থাকে। তবে আমরা বেশিরভাগ মানুষই ঘি এর উপকারিতা ও অপকারিতা এবং এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে অবগত নই। তাই আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ঘি এর উপকারিতা ও অপকারিতা, ঘি খাওয়ার নিয়ম ও উপযুক্ত সময় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। চলুন তার আগে জেনে নেই ঘি আসলে কি-
ঘি কি?
আমার মতো অনেকেরই প্রশ্ন জাগতে পারে ঘি আসলে কি। ঘি এর ইংরেজি কি অনেকেই হয়তো জানেন না ঘি এর ইংরেজি নাম হলো ক্লারিফাইড বাটার। এটি মূলত এক ধরনের সম্পৃক্ত চর্বি যা দুধ থেকে তৈরি করা হয়। এতে প্রায় ৯৯.৯৯% চর্বি থাকে, আর বাকি অংশটুকু হলো চর্বিতে মেশানো পানি। ঘি প্রাচীনকাল থেকেই জনপ্রিয় খাবার যা অত্যাধিক পুষ্টিকর ও উপকারি খাবার হিসেবে প্রসিদ্ধ।
ঘি এর পুষ্টিগুণ
খাঁটি ঘি বহু পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ খাবার, যা মানবদেহের জন্য খুবই উপকারী। দুধের মধ্যে যে যে পুষ্টি উপাদান থাকে খাঁটি ঘি তে ঠিক তাই থাকে। এগুলোর বাইরেও ঘি এর কিছু নিজস্ব পুষ্টিগুণ আছে। ঘি এর পুষ্টিগুণ গুলোর মধ্যে ভিটামিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন ডি, ভিটামিন কে, ভিটামিন ই, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফ্যাটি এসিড, লিনোলিক এসিড এবং ওমেগা থ্রি রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। এসব পুষ্টি উপাদান হাড়ের গঠন মজবুত দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে। এছাড়াও ব্রেইন টনিক মানুষের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ঘি এর উপকারিতা ও অপকারিতা
প্রতিটি জিনিসেরই দুটি দিক রয়েছে। একটি ভালো দিক এবং অপরটি খারাপ দিক। তেমনি ঘি এর উপকারিতা ও অপকারিতা উভয় রয়েছে। সঠিক নিয়ম মেনে ঘি খেলে এর ভালো উপকারিতা পাবেন। কেনোনা ঘি এর রয়েছে দারুন স্বাস্থ্য উপকারিতা। তো চলুন প্রিয় পাঠক বন্ধুরা জেনে নেই ঘি এর উপকারিতা ও অপকারিতা সমূহ:-
ঘি এর উপকারিতা
ঘি একটি দুগ্ধজাত খাবার। এটি শুধু খাবারের স্বাদ বৃদ্ধিই করেনা বরং এর রয়েছে নানান উপকারিতা। ঘি মূলত শীতকালে খাওয়া ভালো, তবে গরম কালেও এটি খাওয়া যায়। ঘি মানব শরীরের বিভিন্ন রকম উপকার করে থাকে। আসুন জেনে নেই ঘি এর কয়েকটি উপকারিতা সমূহ কি কি:-
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে
ঘি তে প্রয়োজনীয় ফ্যাট-দ্রবণীয় ভিটামিন ডি, কে, ই, এ সমৃদ্ধ তাই এই উপাদানগুলো প্রতিরোধ-ক্ষমতা সহ আমাদের দেহের নানাবিধ কার্য সম্পাদন করে। ঘি শরীরকে অন্যান্য খাবার থেকে চর্বিযুক্ত দ্রবণীয় খনিজ এবং ভিটামিন শোষণে সহায়তা করে এবং আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। ঘি অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-ফাঙ্গাল, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট গুণসমৃদ্ধ হওয়ায় এটি ভাইরাস, ফ্লু, কাশি, সর্দি প্রভৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে।
ঘি শরীরকে ঠান্ডা রাখে
মিষ্টি এবং শীতল প্রকৃতির খাবার হচ্ছে ঘি। ঘি মানব শরীরের প্রদাহ বা জালাপোড়া দূর করতে সাহায্য করে। ঘি খেলে আমাদের মন ও শরীরে এক ধরনের শীতলতা কাজ করে এবং শরীর কে শীতল রাখতেও সাহায্য করে। তাছাড়া শরীরের আদ্রতার ভারসাম্য রক্ষা করতে ঘি যতেষ্ট ভূমিকা পালন করে। কেনোনা ঘি তে রয়েছে ময়েশ্চারাইজিং বৈশিষ্ট্য, যা শরীরকে ভিতর থেকে হাইড্রেট রাখে। পুষ্টিবিদদের মতে, গরমকালে ঘি খেলে শরীরে পানির অভাব অনেকটাই পূরণ হয়। এছাড়া ঘি ত্বকের ক্ষেত্রেও অনেক উপকারী।
হজমশক্তি বৃদ্ধি ও কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূর করতে ঘি
ঘি তে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে বিইটারিক অ্যাসিড (wiki) যা হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যের মত সমস্যা দূর হয়। যাদের গ্যাস্ট্রিক এবং হজমের সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য ঘি অনেক উপকারী একটি উপদান। ঘি যেকোনো কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে তার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কিছুটা হলেও কমিয়ে দেয়। ডায়াবেটিস রোগীদের ঝুঁকি কমাতেও সাহায্য করে ঘি।
ঘি ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে
ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ এর ঝুঁকি কমাতে লিনোলিক অ্যাসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লিনোলিক অ্যাসিড এর অন্যতম উৎস হচ্ছে ঘি। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ আক্রান্ত রোগীদের প্রতিদিন অল্প পরিমাণে ঘি খেলে মারাত্মক এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া ঘি মানসিক অবসাদ দূর করতেও বেশ কার্যকরী। দুশ্চিন্তা থেকে মাথা ব্যথা হলে ঘি খেতে পারেন।
শারীরিক শক্তি বৃদ্ধিতে ঘি
শক্তি বৃদ্ধিতে ঘি এর উপকারিতা অনেক। আমরা জানি, পুষ্টিকর খাবার শরীরে শক্তি বৃদ্ধি করে। স্বাস্থ্যকর প্রোটিন শরীরে পুষ্টি যোগায় এবং হরমোন তৈরি করতে সাহায্য করে। ঘিয়ে বিদ্যমান মিডিয়াম চেন ফ্যাটি অ্যাসিড শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘিয়ে ফ্যাটের পরিমাণ অনেক বেশি। তাই ওজন বৃদ্ধি করার জন্য ঘি খেতে পারেন। এছাড়া ওজন কমাতেও সাহায্য করে ঘি। কারণ এতে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড যা ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করে। ওজন কমানোর জন্য পরিমাণ মতো ঘি খেতে হবে।
হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে ঘি
ঘি তে বিদ্যমান ভিটামিন কে, যা ক্যালসিয়ামের সঙ্গে একত্রে হাড়ের স্বাস্থ্য গঠনে ভূমিকা রাখে। স্বাস্থ্যকর ইনসুলিন এবং শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ভিটামিন কে। ঘিতে উপস্থিত প্রাকৃতিক লুব্রিকেন্ট গিঁটে ব্যাথা এবং আর্থ্রাইটিসের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। ঘির ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং হাড়কে সুস্থ রাখে। তাই হাড়কে সুস্থ এবং মজবুত রাখতে প্রতিদিন পরিমাণ মতো ঘি খেতে পারেন। ঘি
ঘি মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে
মস্তিষ্কের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদান ব্রেন টনিক ঘিতে রয়েছে। এই উপদানটি মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কমানোর জন্য নিয়মিত অল্প পরিমাণে ঘি খেতে পারেন। এতে উপস্থিত ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শরীর এবং মস্তিষ্ককে চাঙ্গা রাখতে ভূমিকা পালন করে। নিউট্রিশনিস্টদের মতানুসারে, নার্ভের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সার্বিকভাবে ব্রেনের পাওয়ারের উন্নতি সাধনে ঘি কার্যকরী।
চুলের উপকারিতায় ঘি
চুলের যত্নে ঘি এর উপকারিতা অনেক। ঘি মাথার ত্বকের আদ্রতা কে লক করতে পারে। মাথায় প্রতিদিন সামান্য পরিমাণে ঘি লাগালে মাথার ত্বক মসৃন থাকে এবং চুলকে অনেক বেশি প্রাণবন্ত দেখায়। এছাড়াও ঘি ব্যবহার করার ফলে চুলে তেল কম লাগে। চুলের জন্য খালি পেটে ঘি সবচেয়ে বেশি উপকারী। শুধু চুল নয় ত্বকের যত্নেও ঘি অনেক কার্যকরী। ঘি প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে।
ঘি এর অপকারিতা
ঘি এর উপকারিতা অনেক। মানবদেহের নানাবিধ উপকার করা এই খাবার কি তাহলে খেতেই থাকবো? এর উত্ত হলো না। সব খাবারের মতো এটিও অতিরিক্ত খেলে দেহের উপকারের বদলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তাই এটি পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়া উচিৎ। ঘি পর্যাপ্ত পরিমাণে না খেয়ে অতিরিক্ত খেলে যা যা ক্ষতি বা অপকার হতে পারে তা নিচে দেওয়া হলো-
- প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ঘি খেলে পরিপাকতন্ত্র কাজ করা কমিয়ে দেয়। এতে হজম সমস্যা আরও প্রকোট হয়।
- বেশি ঘি খেলে বদ হজম সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
- দুগ্ধজাত খাবার হওয়ায় অতিরিক্ত ঘি খেলে এসিডিটি ও পেট ফাঁপা বা ফুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- অতিরিক্ত খেলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পেটে পারে।
- ঘি তে যে পরিমাণ চর্বি থাকে তা স্বাভাবিক কিন্তু অতিরিক্ত গ্রহণে তা মাত্রাতিরিক্ত ফ্যাট জনিত সমস্যার সৃষ্টি করে।
- অতিরিক্ত ঘি খেলে শরীরে চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে ওজনও বৃদ্ধি পাবে।
ঘি খাওয়ার নিয়ম ও উপযুক্ত সময়
ঘি এর উপকারিতা জানলেও আমরা ঘি খাওয়ার নিয়ম ও উপযুক্ত সময় সম্পর্কে জানি না। তাই আমাদের ঘি খাওয়ার নিয়ম ও উপযুক্ত সময় সম্পর্কে জানাটা খুবই জরুরী। কারণ প্রত্যেকটা জিনিসের উপকারিতার পাশাপাশি অপকারিতাও রয়েছে। ঘি এমন একটি পুষ্টিকর খাবার যা মানব শরীরের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করে, এবং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঘি এর উপকারিতা মোটামুটি আমরা সবাই জানি কিন্তু ঘি খাওয়ার নিয়ম ও উপযুক্ত সময় সম্পর্কে জানি না। চলুন জেনে নেই ঘি খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে-
ঘি খাওয়ার নিয়ম
ঘি একটি শক্তিবর্ধক এবং উপকারি খাদ্য। বাঙালির খাদ্যভ্যাসে ঘি অনেক বড় জায়গা দখল করে আছে। রান্নায়, খাবারের মান ও স্বাদ বাড়াতে ঘি ব্যবহার করা হয়। নিচে ঘি খাওয়ার কয়েকটি নিয়ম দেওয়া হলো-
- এক গ্লাস গরম দুধের সাথে এক চামুচ ঘি মিশিয়ে খেতে পারেন। এতে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য উপাদান বজায় থাকবে।
- গরম ভাপ উঠানো ধোয়ার সাথে ঘি খেতে পারেন। এতে বেশ উপকার পাবেন।
- কখনো ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা থেকে আপনার শরীরকে সুস্থ রাখতে চাইলে আপনি এক চামচ ঘি এর সাথে সামান্য গোল মরিচ মিশিয়ে খেতে পারেন। এতে বেশ উপকার পাবেন।
- গরম ভাতের সাথে এক চামচ ঘি খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে দেয় দ্বিগুন হারে।
- যেকোনো অনুষ্ঠানে রান্নায় খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় ঘি।
- আপনি যদি অর্থাইটিস কিংবা চুল পড়ার সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি রোজ সকালে খালি পেটে এক গ্লাস গরম পানির সাথে এক চামচ ঘি মিশিয়ে খেতে পারেন। এর আধা ঘন্টা কিংবা চল্লিশ মিনিট পর সকালের নাস্তা খেয়ে নিবেন।
- সকালের নাস্তার ক্ষেত্রে কিংবা বিকেলের স্ন্যাক্স আইটেম এর ক্ষেত্রে রুটি কিংবা চাপাতির উপর সামান্য ঘি মিশিয়ে দিলে খাবারে যেমন বাড়তি স্বাদ যুক্ত হয় ঠিক তেমনি করে খাবার বেশ সুস্বাদু হয়।
ঘি খাওয়ার উপযুক্ত সময়
চিকিৎসকদের মতে, ঘি খাওয়ার উপযুক্ত সময় শীতকাল। তবে সারা বছরই ঘি খেতে পারবেন। ঘি শরীরকে ভেতর থেকে হাইড্রেট রাখে। তাই গরমকালে পানির অভাব অনেকটাই পূরণ হয় ঘি খেলে। পরিমাণ মতো ঘি সুস্বাস্থ্য রক্ষা করতে অনেক সাহায্য করে।
শেষ কথা
প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, আমরা এতক্ষণ ঘি এর উপকারিতা ও অপকারিতা, ঘি খাওয়ার নিয়ম ও উপযুক্ত সময় সম্পর্কে আপনাদের বিস্তারিত জানাতে পেড়েছি। ঘি এর উপকারিতা এই আর্টিকেলটি আপনাদের যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন এবং এই আর্টিকেলটি যদি তথ্যবহুল মনে হয় তাহলে আপনি আপনার সোস্যাল সাইটে শেয়ার করতে পারেন যাতে অন্যরা ঘি এর উপকারিতা সম্পর্কে জানতে পারে।
Leave a Comment