বাঙালির প্রিয় মাছ ইলিশ। বাঙালির সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই ইলিশ মাছ। বর্ষায় ইলিশ ভাজা, শর্ষে ইলিশ, ইলিশের ভর্তা, ভাপা ইলিশ, দই ইলিশ, পান্তা ইলিশ, ইলিশ পাতুরি, ইলিশের ডিম ছাড়া যেন বাঙালির তৃপ্তি আসে না। ইলিশ মাছ যেমন সুস্বাদু, তেমনি পুষ্টিগুণেও ভরপুর। আজকের এই আর্টিকেলে আমি চেষ্টা করবো ইলিশ মাছ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে।
ইলিশ মাছ এর পরিচিতি
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ যার ইংরেজী প্রতিশব্দ Hilsa shad, এর বৈজ্ঞানিক নাম Tenualosa ilisha এবং স্থানীয় নাম- হিলশা, ইলসা ইত্যাদি। এটি একটি সামুদ্রিক মাছ, যা ডিম পাড়ার জন্য পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের নদীতে আসে। এছাড়াও ইলিশ ভারতের বিভিন্ন এলাকা যেমন উরিষ্যা, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মাছ।
ইলিশ মাছ একটি সামুদ্রিক মাছ যা ডিম দেওয়ার জন্য নদীতে আসে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা এবং কর্ণফুলী নদীতে এই মাছ বিচরণ করে। এছাড়া পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশেও এই মাছ পাওয়া যায়, যেখানে এটি ‘পাল্লা’ নামে পরিচিত।
এই মাছের বিভিন্ন প্রকারের উপাদান এবং রন্ধন প্রণালী বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন রুপ নেয়। এটি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন পাল্লু মাছি (সিন্ধু), পোলাসা (তেলেগু), ইলিশী (গুড়িয়া), মোদেন বা পালভা (গুজরাটি) ইত্যাদি।
ইলিশ মাছের বৈশিষ্ট্য
ইলিশ মাছ বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাছ। এটি বাংলাদেশের জাতীয় মাছ বটে। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই মাছের বৈশিষ্ট্যগুলো-
- ইলিশ মাছের দেহ বেশ চ্যাপ্টা ও পুরু।
- এর মাথার উপরিতল পুরু এবং ত্বকে ঢাকা।
- ধাতব রুপালি রঙের শরীর সুবিনস্ত্য মাঝারি আকারের আঁশে আবৃত।
-
এর দৈর্ঘ সর্বাধিক ৬০ সেন্টিমিটার এবং বড় আকারের ইলিশের ওজন প্রায় ২.৫ কিলোগ্রাম হয়।
-
স্ত্রী মাছ দ্রুত বড় হয় এবং সচারচর স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছের থেকে আকারে বড় হয়।
ইলিশ মাছের পুষ্টিগুণ
ইলিশ মাছ খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি পুষ্টিগুণেও ভরপুর। অনেকগুলো খাদ্য উপাদানের এক বিশাল পুষ্টি ভাণ্ডার এ মাছ।
ইলিশ মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি। এ ছাড়াও রয়েছে আয়রন, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, জিংক, ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। এ মাছ খেয়েই আমরা শরীরে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের চাহিদা পূরণ করতে পারি।
১০০ গ্রাম ইলিশ মাছে আনুমানিক ৩১০০ ক্যালরি, ১৯ দশমিক ৫ গ্রাম ফ্যাট ও ২২ গ্রাম প্রোটিন থাকে। একইসঙ্গে মাছের তেলে রয়েছে পলিআনস্যাচুরেটেড ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, ইপিএ ও ডিএইচএ যেগুলো উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, অ্যারিথেমিয়া, ক্যান্সার, আথ্রাইটিসসহ ব্রেন ডেভেলপমেন্ট ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধে বিশেষভাবে কার্যকরী বলে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে।
এ ছাড়াও, মানবদেহের জন্য প্রতিদিনের দরকারি ২৭ ভাগ ভিটামিন সি, ২০৪ ভাগ ক্যালসিয়াম ও ২ ভাগ আয়রন ইলিশ মাছ থেকে পাওয়া যায়।
আসুন জেনে নিই ইলিশ মাছের পুষ্টিগুণ-
- ইলিশে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, যা চোখ ও মস্তিষ্কের জন্য খুব উপকারী।
- এটি রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়াও শরীরের নানা রকম ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে।
- এই মাছে প্রচুর তেল রয়েছে, যা নার্ভ সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি করে। হার্টের খারাপ কোলেস্টরল বের করে দেয়।
- ভিটামিন ডি এর ভালো উৎস এই মাছ। এই মাছ খেলে চুল ও ত্বক ভালো থাকে।
- ইলিশ থেকে প্রাপ্ত মিনারেল ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস হাড় গঠনে সাহায্য করে।
- এ মাছে বিদ্যমান ভিটামিন এ রাতকানা রোগ প্রতিরোধে করে।
- ইলিশে বিদ্যমান ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড বিষন্নতা কমাতে সাহায্য করে এবং স্মৃতিশক্তিকে শক্তিশালী করে।
ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ কেন?
ইলিশ মাছ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। ইলিশ মাছের স্বাদ, আকার এবং গুনাগুণ অন্য সব মাছের চেয়ে অন্যরকম। বাংলাদেশের মানুষের প্রাণীজ আমিষের চাহিদা মেটাতে এই মাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে ১৯৭২ সালে নদ-নদীগুলোতে অনেক ইলিশ পাওয়া যায় এবং গ্রামের দরিদ্র মানুষগুলো ওই ইলিশ খেতেন। এই সবগুলো দিক বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (উইকিপেডিয়া) এই মাছকে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ নির্বাচন করেছিলেন।
এছাড়াও বাংলাদেশে প্রায় ৭৩৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় এবং এর মধ্যে ইলিশ বিশ্বের ৮৫ শতাংশ পাওয়া যায়। এই বিষয়গুলো ইলিশকে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ করার পেছনে বড় যুক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
প্রতিদিন ইলিশ মাছ খেলে কী হয়?
বাঙালি সমাজে একটা প্রবাদ যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ‘মাছে-ভাতে বাঙালী’। আর বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় মাছ হলো ইলিশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলিশ মাছে থাকা সব পুষ্টিগুণ পেতে প্রতিদিন তা খেতে পারেন। তবে অবশ্যই পরিমাণ অনুযায়ী খেতে হবে। অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না, এতে শরীরের আরও ক্ষতি হতে পারে। আবার অনেকেরই ইলিশ মাছে অ্যালার্জি আছে, তাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া মাছটি খাওয়া উচিত নয়। ডাইঅক্সিন, পারদ বা অন্যান্য ভারী ধাতুর মতো সামুদ্রিক দূষণের ঝুঁকি থাকায় গর্ভবতী বা বুকের দুধ খাওয়ানো নারীদের ইলিশ মাছ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় না।
আমি এই আর্টিকেলটি জুড়ে চেষ্টা করেছি আপনাদের কাছে ইলিশ মাছ বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তোলার। আমি আরও জানিয়েছি ইলিশ মাছের পরিচিতি, ইলিশ মাছের বৈশিষ্ট্য এবং এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে। আশা করি পুরো আর্টিকেলটি পড়ে আপনার এই বিষয় সম্পর্কে ধারণা হয়ে গেছে।
Leave a Comment