রোজা সম্পর্কে হাদিস ও গুরুত্বপুর্ণ কিছু আলোচনা

রোজা সম্পর্কে হাদিস ও গুরুত্বপুর্ণ কিছু আলোচনা

রোজা সম্পর্কে হাদিসঃ যে পাঁচটি ভিত্তি ইসলামের স্তম্ভ গঠন করে তার মধ্যে রোজা একটি। প্রত্যেক মুসলমানের জন্য এই পাঁচটি স্তম্ভ এর ওপর বিশ্বাস রাখা আবশ্যক। রোজা রাখার মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা। এছাড়াও পাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্যই জানা উচিত যে রমজান মাসে রোজা রাখা বাধ্যতামূলক।

যেমনটি আল্লাহ তাঁর কিতাবে নির্দেশ করেছেনঃ রমজান হল সেই মাস যে মাসে মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কুরআন মজিদ অবতীর্ণ হয়েছে। যা মানুষের দিশারি এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। সুতরাং যারা এ মাসে উপস্থিত থাকবে তারা যেন রোজা রাখে। তবে যে অসুস্থ বা সফরে আছে, তারা যেন রমজানের পর সমান সংখ্যক দিন রোজা রাখে। আজকের আর্টিকেলে থাকছে,  রোজা সম্পর্কে হাদিস ও গুরুত্বপুর্ণ কিছু আলোচনা। এই আর্টিকেল থেকে রোজা সম্পর্কিত সকল হাদিস জানতে পারবেন। আশা করি, ফজিলত-মর্যাদা সম্পর্কিত হাদিস আপনাদের কাছে ভালো লাগবে।

রোজা সম্পর্কে হাদিস

রোজা কি?

রোজা এর আরবি শব্দ হল সাওম (wiki)। সওম বা সিয়ামের শাব্দিক অর্থ বিরত থাকা, চুপ থাকা। ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল ভিত্তির মধ্যে রোজা তৃতীয় স্তরে রয়েছে। আল্লাহ তাআলা নির্দেশে সুবহে সাদেক বা ভোরের মৃদু আলো থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার খাদ্য, পানাহার,পাপাচার, কামাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকে বিরত থাকার নামই রোজা। সূর্যাস্তের পর মাগরিবের আযান শুনার সাথে সাথে খেজুর বা পানীয় দিয়ে রোজা ভঙ্গ করতে হয়। খেজুর দিয়ে রোজা ভঙ্গ করা সুন্নত। রমজান মাসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সাথে তারাবির নামাজ যুক্ত হয়।

রোজার ফজিলত

রোজার ফজিলত

রমজান হল বরকতময় মাস। এই মাস একজন ব্যক্তিকে তার অতীতের সকল পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে সহায়তা করে। এই মাসে সম্পাদিত ভাল কাজগুলি পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের দ্বারা নোট করেন।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহর মর্জি হলে আদম সন্তানের প্রতিটি সৎকাজের প্রতিদান দশ গুণ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। আল্লাহ্ বলেনঃ তবে রোযা ব্যতীত, তা আমার জন্যই (রাখা হয়) এবং আমিই তার প্রতিদান দিবো। সে তার প্রবৃত্তি ও পানাহার আমার জন্যই ত্যাগ করে। রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দঃ একটি আনন্দ তার ইফতারের সময় এবং আরেকটি আনন্দ রয়েছে তার প্রভু আল্লাহর সাথে তার সাক্ষাতের সময়। রোযাদার ব্যক্তির মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট কস্তুরীর ঘ্রাণের চেয়েও অধিক সুগন্ধময়।

আবূ হুরাইরাহ্‌ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “শাইতান ও দুষ্ট জিনদেরকে রামাযান মাসের প্রথম রাতেই শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয় এবং এর দরজাও তখন আর খোলা হয় না, খুলে দেওয়া হয় জান্নাতের দরজাগুলো এবং এর একটি দরজাও তখন আর বন্ধ করা হয় না। (এ মাসে) একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেনঃ হে কল্যাণ অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে পাপাসক্ত! বিরত হও। আর বহু লোককে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ হতে এ মাসে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং প্রত্যেক রাতেই এরূপ হতে থাকে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন রোজা ও কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমি তাকে পানাহার ও যৌনকর্ম থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন।’ কোরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন।’ মহানবী (সা.) আরও বলেন, ‘অতএব উভয়ের সুপারিশ গৃহীত হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, সহিহ তারগিব, হাদিস: ৯৬৯)

রোজা সম্পর্কে হাদিস

রোজা সম্পর্কে হাদিস

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে যা ধর্মের ভিত্তি এবং গঠন তৈরি করে। রমজানের রোজা ইসলামের এই পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি। অতএব, রমজানের রোজা রাখা কখনই বাদ দেওয়া উচিত নয়। রোজার ফজিলত-মর্যাদা সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে। নিচের অংশে আমরা রোজা সম্পর্কে ফজিলতপূর্ণ হাদিস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্যে সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া বা আল্লাহ ভীরুতা অবলম্বন করতে পারো। (সূরা বাকারাহ-১৮৩)

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ঈমানের সাথে ছাওয়াবের আশায় যে ব্যক্তি রোযা পালন করে তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়।

হজরত হুজায়ফা (রা.) বলেন, আমি মহানবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘মানুষের পরিবার, ধন-সম্পদ ও প্রতিবেশীর ব্যাপারে ঘটিত বিভিন্ন ফেতনা ও গুনাহর কাফফারা হলো নামাজ, রোজা ও সদকা।’ (বুখারি, হাদিস: ১৮৯৫)

সিয়াম নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে অথবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূর্ণ করবে। যাদের জন্য অতিশয় কষ্টদায়ক হয় তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদইয়া-একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্যে অধিকতর কল্যাণকর যদি তোমরা তা জানতে। (সূরা বাকারাহ-১৮৪)

হজরত আবু সাইদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে বান্দা আল্লাহর পথে একদিন মাত্র রোজা রাখবে, সেই বান্দাকে আল্লাহ বিনিময়ে জাহান্নাম থেকে ৭০ বছরের পথ পরিমাণ দূরত্বে রাখবেন।’ (বুখারি, হাদিস: ২৮৪০)

হজরত উসমান বিন আবুল আস থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘রোজা জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য ঢালস্বরূপ; যেমন যুদ্ধের সময় নিজেকে রক্ষা করার জন্য তোমাদের ঢাল থাকে।’ (মুসনাদে আহমাদ, সহিহুল জামিউস সাগির, হাদিস: ৩৮৭৯)

আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “সিয়াম এবং কুরআন বান্দার জন্য শাফা‘আত করবে। সিয়াম বলবে, হে রব! আমি তাকে দিনে খাবার গ্রহণ করতে ও প্রবৃত্তির তাড়না মিটাতে বাধা দিয়েছি। অতএব তার ব্যাপারে এখন আমার শাফা‘আত কবূল করো। কুরআন বলবে, হে রব! আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে এখন আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবূল করা হবে।

প্রিয় নবীজি (সা.) এর প্রিয় সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। (বুখারী, মুসলিম)

অপর হাদিসে এসেছে, হযরত সাহ্ল ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) এরশাদ করেছেন, বেহেশতের ৮টি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে ১টি দরজার নাম রাইয়ান। রোজাদার ব্যতিত আর কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলিম)

হজরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে এমন কোনো আমলের আজ্ঞা করুন; যার বিনিময়ে আল্লাহ আমাকে লাভবান করবেন।’ (অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘যার মাধ্যমে আমি জান্নাত যেতে পারব’) তিনি বললেন, ‘তুমি রোজা রাখো। কারণ, এর সমতুল্য কিছু নেই।’ পুনরায় আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে কোনো আমলের আদেশ করুন।’ তিনি পুনরায় একই কথা বললেন, ‘তুমি রোজা রাখো। কারণ, এর সমতুল্য কিছু নেই।’ (নাসায়ি, সহিহ্ তারগিব, হাদিস: ৯৭৩)

রোজাদারের খুশির বিষয় ২টি- যখন সে ইফতার করে তখন একবার খুশির কারণ হয়। আর একবার যখন সে তার রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোজার বিনিময় লাভ করবে তখন খুশির কারণ হবে। (বুখারী)।

হজরত হুজায়ফা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) আমার বুকে হেলান দিয়ে ছিলেন। তখন তিনি বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পর যে ব্যক্তির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে একদিন রোজা রাখার পর যে ব্যক্তির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় কিছু সদকা করার পর যে ব্যক্তির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে, সেও জান্নাত প্রবেশ করবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, সহিহ্ তারগিব, হাদিস: ৯৭২)

আল্লাহ তায়ালা এ মাসে বহু ব্যক্তিকে দোযখ থেকে মুক্তি দেন। আর এটা এ মাসের প্রতি রাতেই হয়ে থাকে। (তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, যখন রমজান মাস উপস্থিত হতো রাসুল (সা.) সমস্ত কয়েদিকে মুক্তি দিতেন এবং প্রত্যেক প্রার্থনাকারীকে দান করতেন। (বায়হাকী)

রমজানের এই হাদিস সমূহ

২য় হিজরীর শাবান মাসে মদীনায় রোজা ফরজ সংক্রান্ত আয়াত নাজিল হয় “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো যেভাবে তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা সংযমী হও”। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)।

সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেই মাসকে পায় সে যেন রোজা রাখে।

নবী করীম (সা.) বলেছেন, কেউ যদি (রোজা রেখেও) মিথ্যা কথা বলা ও খারাপ কাজ পরিত্যাগ না করে তবে তার শুধু পানাহার ত্যাগ করা (অর্থাৎ উপবাস ও তৃষ্ণার্ত থাকা) আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী)

শেষ কথা

আশা করছি, আজকের আর্টিকেল থেকে রোজা সম্পর্কে হাদিস গুলো দেখে নিয়েছেন। রমজানের এই হাদিস সমূহ একজন মুসলমান ব্যক্তিকে ভালো ও আধ্যাত্মিক উপায়ে ইসলামকে শিখতে ও বুঝতে সাহায্য করে। আমাদের এই আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই আপনার আতীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

আরও পরুনঃ- মহরম কেন পালন করা হয়? মহরম এর ইতিহাস।

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রোজা নিয়ে উক্তি, স্ট্যাটাস ও বাংলা ক্যাপশন

মহরম কেন পালন করা হয়? – মহরম এর ইতিহাস

গরমে ইফতারে কি খাওয়া উচিত ও কি খাওয়া উচিত নয়