মহরম কেন পালন করা হয়? - মহরম এর ইতিহাস

মহরম কেন পালন করা হয়? – মহরম এর ইতিহাস

মহরম ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। মুসলমানদের ইসলাম ধর্মের ক্যালেন্ডার অনুসারে এটি বছরের প্রথম মাস। এই দিনে সারা বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা সর্বশেষ নবী, হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর নাতি এবং হযরত আলী (রাঃ) এর পুত্র ইমাম হোসেনের শাহাদাৎ এ শোক প্রকাশ করেন। এছাড়াও মহরম মাসের ১০ তারিখে অনেক গুলো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। তাই এই দিনটি কে ইসলামে আশুরা নামে অভিহিত করা হয়। মহরম কেন পালন করা হয়? – মহরম এর ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগে জেনে নেই মহরম কি-

মহরম কি

মহরম কি

মহরম হল ইসলামিক ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস। এটি একটি দুঃখের উৎসব যা মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ শোক পালন করেন। এই দিনটি প্রার্থনা এবং আত্ম দর্শন বা প্রায়শ্চিত্তের দিন হিসেবেও পালন করা হয়। মহরম শব্দটি আরবি শব্দ যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে মহরম মাস পবিত্র হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। মহরমের ১০ তারিখ কে আশুরা বলা হয়ে থাকে। বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষি এই মাসটি।

মহরম কেন পালন করা হয়

নতুন চাঁদের আগমনই সূচনা করে মহরম মাসের। ইসলামিক বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং পবিত্র মাসগুলির মধ্যে একটি অন্যতম মাস হল মহরম, যা ইসলামিক নববর্ষ, হিজরি নববর্ষ বা আরবি নববর্ষ নামেও পরিচিত। মহরম হলো ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্রতম মাসের মধ্যে এটি একটি। আর এই মাসেই ঘটেছিলো কারবালার ঘটনা। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) নাতি এবং মা ফাতিমা (রাঃ) পুত্র ইমাম হোসেন ঐতিহাসিক কারবালার ময়দানে ইসলামের জন্য শহিদ হন।

ইসলাম ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী ইরাকের ইয়াজিদ নামে একজন নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী বাদশা ছিল। তিনি ছিলেন ইসলামের ঘোর শত্রু। তিনি নিজেকে খলিফা দাবি করলেও তার মধ্যে আল্লাহর প্রতি কোন বিশ্বাস ছিল না। ইয়াজিদ মনে প্রানে চেয়েছিল হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) নাতি ইমাম হোসেন তার দলে যোগদান করুক। তিনি ইমাম হোসেন তার দলে আসার প্রস্তাব দিলে তাৎক্ষনিক ইমাম হোসেন তা খারিজ করে দেন। ফলে ইয়াজিদ ক্রোধে অন্ধ হয়ে গিয়ে ইমাম হোসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

কারবালা যুদ্ধ

ইরাকের রাজধানী বাগদাদ শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে কারবালার প্রান্তরে মুখোমুখি হয় ইমাম হোসেন ও ইয়াজিদের দুই সেনা। সেখানে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে নামাজ পড়ছিলেন ইমাম হোসেন। তখনই অতর্কিত হামলা চালায় ইয়াজিদের সৈনিকরা। যাতে প্রাণ হারান অন্তত ৭২ জন। শুধু তাই নয়, কারবালার রণাঙ্গনে মরুভূমির মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন ইমাম হোসেন।

শেষমেশ তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পরিবারের সঙ্গে মৃত্যু হয় তার। কথিত আছে যে হুসেনের ঘাড়ে মাটিতে পড়ে গেলেও তা সেজদার অবস্থায় ছিল। মহরম মাসের ১০ তারিখের দিনে ঘটেছিল ওই ঘটনা। যাকে মনে রেখে বিশ্বজুড়ে আজও পালিত হয় আশুরা বা মহরম।

ইসলাম ধর্মের দুই সম্প্রদায় শিয়া ও সুন্নিরা আলাদা আলাদা ভাবে পালন করে আশুরা বা মহরম উৎসব। শিয়া সম্প্রদায়রা এই দিলে কাল পোশাক পরিধান করে রাস্তায় তাজিয়া নিয়ে মিছিল বের করে এবং বিশেষ নামাজের ব্যবস্থা করে। অন্যদিকে সুন্নিরা মহরম মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা পালন করেন।

মহরম এর ইতিহাস

মহরম এর ইতিহাস

প্রায় ১৪৪৪ বছর আগে হজরত মহম্মদ ও তার অনুগামীরা মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশে রওনা হতে বাধ্য হন। ওই দিনটি ছিল মহরমের প্রথম দিন। তাকে মক্কায় ইসলামের বার্তা প্রচার করায় বাধা দেওয়া হয়। মহরমের দশম দিনটি অশুরা হিসেবে পালিত হয়, এদিন ইমাম হুসেনের মৃত্যুর শোক পালন করা হয়। ইমাম হুসেন ছিলেন হজরত মোহাম্মাদ (সাঃ) পৌত্র এবং হজরত আলির (রাঃ) পুত্র। ৬৮০ খ্রিষ্টপূর্বে কারবালার যুদ্ধে প্রাণ ত্যাগ করেন।

ইসলামের অন্যান্য উৎসব থেকে মহরমের পৃথক, কারণ এই মাসটি হল শোকজ্ঞাপন ও প্রার্থনার মাস। এ সময় কোনও উৎসব পালিত হয় না। শিয়াদের জন্য এই মাসটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। শিয়ারা এদিন একটি শৃঙ্খল তৈরি করে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন। একে ততবীর বা কামা জানি বলা হয়। আবার সুন্নিরা এদিন উপবাস পালন করেন ও ‘ইয়া হুসেন’ অথবা ‘ইয়া আলি’ উচ্চারণ করে থাকেন।

মহরম এর তাৎপর্য

হিজরি বছরের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহরম মাসকে সম্মানিত ও হারাম মাস বলা হয়েছে। কারণ এই মাসে সকল প্রকার যুদ্ধ-বিগ্রহ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আরবি বছরের চারটি মাস কে উত্তম বলা হয়েছে এর মধ্যে মহরম মাস অন্যতম। এ মাসে ১০ তারিখে পবিত্র আশুরা। এই দিনে ইসলামিক ইতিহাসে অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা হলো-

  •  মহরম এর ১০ তারিখে মহান আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি, স্থিতি, ও পৃথিবীতে অবতরণ সব কিছুই ঘটেছিল।
  • আসমান-জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে মহররম মাসেই।
  • মহরম এর এই দিনেই মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা, হযরত মূসা (আ.) তার সঙ্গী বনী ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন ও ফেরাউন তার দলবল সহ নীলনদে ডুবে মারা যান।
  • এই দিনেই হযরত নূহ (আ.) নৌযানে করে যাত্রা আরম্ভ করেছিলেন এবং বন্যা ও প্লাবন এর সমাপ্তিও হয়েছিল।
  • হযরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘ ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগের পর সুস্থ হয়ে উঠেন এই মহরম বা আশুরাতেই।
  • হযরত মূসা (আ.) এবং আল্লাহপাকের মধ্যে কথোপকথোন ও তাওরাত কিতাব নাজিল হয়েছিল এই আশুরাতেই।
  • মহরম মাসেই এই দিনেই হযরত ইসা (আ.) কে আল্লাহপাক সশরীরে চতুর্থ আসমানে তুলে নেন।
  • হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে বের হয়ে আসেন আশুরাতেই।
  • নবী মোহাম্মদ-এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন এই দিন কারবালার ময়দানে ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন।

উপরোক্ত ঘটনা ছাড়াও আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে এই মহরম মাসের ১০ তারিখ বা আশুরাতে।

মহরম এর ফজিলত ও আমল

মহরম এর নামকরণ থেকেই প্রতীয়মান হয় এ মাসের ফজিলত সম্পর্কে। মহরম অর্থ মর্যাদাপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ। যেহেতু অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রহস্যময় তাৎপর্য নিহিত রয়েছে এ মাসকে ঘিরে, সঙ্গে সঙ্গে এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল, এসব কারণেই এ মাসটি মর্যাদাপূর্ণ। তাই এ মাসের নামকরণ করা হয়েছে মহররম বা মর্যাদাপূর্ণ মাস।

মহরম সম্পর্কে (যা আশহুরে হুরুমের অন্তর্ভুক্ত তথা নিষিদ্ধ মাস) পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২। যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না”(সূরা তওবা আয়াত-৩৬)।

মহরম বা আশুরার রোজা

মহরম বা আশুরার রোজা

মহরম মাসে রোজা রাখা সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত রয়েছে। একটি হাদিস থেকে প্রতিয়মান হয়, রমজান মাসে রোজা ফরজ হওয়ার আগে মহরমের বা আশুরার রোজা উম্মতে মোহাম্মাদীর উপর ফরজ ছিল। পরবর্তি সময়ে ওই রোজা ফরজ থেকে বাদ হয়ে নফল হয়ে যায়।

হাদিস শরিফে হজরত জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। এ বিষয়ে নিয়মিত তিনি আমাদের খবরাখবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না এবং নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবরাখবরও নিতেন না। -সহিহ মুসলিম শরিফ: ১১২৮

অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) মহরমের আশুরা ও রমজানের রোজা সম্পর্কে যেরুপ গুরুত্ব প্রদান করতেন অন্য কোন রোজা সম্পর্কে সেরুপ গুরুত্বরোপ করতেন না।

মহরম এর রোজার ফজিলত

মহরম এর রোজার ফজিলত

একবার এক ব্যক্তি আলী (রা.)-কে প্রশ্ন করেছিল যে, রমজানের পর আর কোনো মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তখন তিনি বললেন, এই প্রশ্ন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর নিকট জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তার খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, “রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।” (জামে তিরমিজি, হাদিস : ১/১৫৭)

অন্য আরেকটি হাদিসে নবী কারিম (সা.) বলেন আমি আশাবাদী যে, “আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগিরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১/৩৬৭; জামে তিরমিজি, হাদিস : ১/১৫৮)

শেষ কথা

আশা করি এই আর্টিকেলে আমি আপনাদের কাছে মহরম কেন পালন করা হয়? – মহরম এর ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ধারনা দিতে পেড়েছি। যদি আর্টিকেলটি আপনার কাছে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে তথ্যবহুল মনে হয় তাহলে আপনি আপনার আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে শেয়ার করতে পারেন যাতে তারা মহরম কেন পালন করা হয়, মহরম এর ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ধারনা লাভ করতে পারে। এই রকম আরও ইসলামিক আর্টিকেল পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।

মহরম এর ইতিহাস সম্পর্কে আরও জানুনঃ- wikipedia.org

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রোজা সম্পর্কে হাদিস ও গুরুত্বপুর্ণ কিছু আলোচনা