রোজার নিয়ত এবং সেহরি ও ইফতারের দোয়া

রোজার নিয়ত এবং সেহরি ও ইফতারের দোয়া

প্রত্যেক আকেল বালেগ ও সুস্থ্য নর-নারীর উপর রমজানের রোজা রাখা ফরয। আর এই রমজান মাসের ফজিলতপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে রোজা, রোজার নিয়ত, সেহরির দোয়া ও ইফতারের দোয়া এইগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এই রমজান মাসকে সাইয়্যিদুশ-শুহুর বা সকল মাসের সেরা মাসও বলা হয়।

এই রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর কাছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস। কারণ, এই মাসেই পবিত্র আল-কোরআন নাজিল করা হয়েছে। আর এই রমজান মাসে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় রোজা রাখি। শুধু রোজা রাখলেই হবে না রোজার নিয়ত করতে হবে। সেইসাথে সেহরির দোয়া ও ইফতারের দোয়াও পড়তে হবে। কারণ, এইগুলো হচ্ছে রমজান মাসের ফজিলতপূর্ণ আমল। আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমি আপনাদের জানাবো রোজার নিয়ত, সেহরির নিয়ত এবং ইফতারের আগে ও পরের দোয়াগুলো সম্পর্কে।

রোজা কাকে বলে

রোজা কাকে বলে?

ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল ভিত্তির মধ্যে রোজা তৃতীয় স্তরে রয়েছে। রোজার আরবি শব্দ হচ্ছে সাওম। সাওমের শাব্দিক অর্থ বিরত থাকা বা চুপ থাকা। আল্লাহ তা’আলার নির্দেশে সুবহে সাদেক বা ভোরের মৃদু আলো থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার খাদ্য, পানাহার,পাপাচার, কামাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকে বিরত থাকার নামই রোজা। সহজভাষায় বলতে গেলে, সুব্হে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে ইচ্ছাকৃতভাবে পান, আহার ও যৌন তৃপ্তি থেকে বিরত থাকাকে রোজা বলা হয়। এবং সূর্যাস্তের পর মাগরিবের আযান শুনার সাথে সাথে খেজুর বা পানীয় দিয়ে রোজা ভঙ্গ করতে হয়।

রোজার নিয়ত কখন ও কীভাবে করবো

রোজার নিয়ত কখন ও কীভাবে করবো?

রোজার নিয়ত করা ফরজ। আর নিয়ত একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ হলো মনে মনে ইচ্ছা করা। অতএব কেউ যদি সূর্যাস্তের পরবর্তী কোনো একসময়ে মনে মনে এই ইচ্ছা করে যে, আমি আগামীকাল রমজানের রোজা রাখবো। তা হলে তার নিয়ত সংঘটিত হয়ে যাবে। নিয়ত সহিহ হওয়ার জন্য মুখে উচ্চারণ করা শর্ত নয়। তবে তা উত্তম। (ফাতাওয়া আলমগিরি-১/১৯৫)

সূর্যাস্তের পর থেকে পূর্ব অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্তের মধ্যবর্তী সময়ের আগ পর্যন্ত রমজানের রোজার নিয়ত করার অবকাশ আছে। তবে সুবহে সাদিকের আগেই নিয়ত করে নেওয়া উত্তম। (বাদায়েউস সানায়ে- ২/২২৯; আল বাহরুর রায়েক-২/২৫৯)। তবে রাতে নিয়ত করতে না পারলে দিনে সূর্য ঢলার প্রায় এক ঘণ্টা আগে নিয়ত করলেও রোজা হয়ে যাবে। (সহিহ বোখারি : ২০০৭, বাদায়েউস সানায়ে : ২/২২৯)।

রোজার আরবি নিয়ত

বাংলাদেশে একটি আরবি রোজার নিয়ত প্রসিদ্ধ- যেটা মানুষ মুখে পড়ে থাকেন। তবে এটি হাদিস ও ফিকাহের কোনো কিতাবে বর্ণিত হয়নি। তবে কেউ চাইলে পড়তে পারেন। (তবে জেনে রাখা উচিত যে, নিয়ত পড়ার চেয়ে নিয়ত করা গুরুত্বপূর্ণ।) রোজার এই আরবি নিয়তটি হলো-

نَوَيْتُ اَنْ اُصُوْمَ غَدًا مِّنْ شَهْرِ رَمْضَانَ الْمُبَارَكِ فَرْضَا لَكَ يَا اللهُ فَتَقَبَّل مِنِّى اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْم

রোজার নিয়তের বাংলা উচ্চারণঃ “নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম, মিন শাহরি রমাদানাল মুবারাক; ফারদাল্লাকা ইয়া আল্লাহু, ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নিকা আনতাস সামিউল আলিম।”

অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল পবিত্র রমজানের তোমার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণ (নিয়ত) করলাম। অতএব তুমি আমার পক্ষ থেকে (আমার রোযা তথা পানাহার থেকে বিরত থাকাকে) কবুল কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।

সেহরির নিয়ত

সেহরির নিয়ত

রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে সেহরি। রোজা রাখার উদ্দেশ্যে সুবহে সাদিকের পূর্বে শেষ রাতের খাবার বা পানাহারকেই সেহরি বলে। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন, রমজানের রোজা পালনের জন্য শেষ রাতে সেহরি খাওয়া আবশ্যক।

তাই সুর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা যেমন সুন্নত ও বরকতময়, তেমনি রাতের শেষ ভাগে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে সেহরি খাওয়াও সুন্নত এবং কল্যাণের। সেহরির জন্য নির্দিষ্ট কোনো নিয়ত নেই। কিন্তু শেষ রাতে আমরা যখন পানাহার করি তখন খাবারের দোয়া পড়া সুন্নত। আর অন্যান্য সময় আমরা যেমন খাবারের জন্য দোয়া পড়ি তেমনি সেহরি খাওয়ার সময় এই দোয়াগুলো পড়তে হয়।

সেহরি খাবার শুরুর দোয়া

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ): সেহরি সহ অন্যান্য সময় যখন খাবার খেতেন তখন খাবার শুরু করার আগে তিনি এই দোয়াগুলো পড়তেন। দোয়াগুলো নিম্নে লেখা হলো-

আরবিঃ بسم الله وعلى بركة الله

বাংলা উচ্চারণঃ “বিস-মিল্লাহি ওয়া-আলা বারকাতিল্লাহ।” (সাআলাবী)

অর্থঃ আল্লাহ তা’আলার নামে খাওয়া শুরু করছি এবং আল্লাহর বরকত প্রার্থনা করছি।

সেহরি খাবার আগে দোয়া পড়তে ভুলে গেলে যে দোয়া পড়তে হয়

আমরা অনেকেই সেহরি কিংবা অন্যান্য সময় খাবার শুরু করার আগে বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে যায়। এতে করে আমাদের গুনাহ হয়। কিন্তু খাবার খাওয়ার সময় যদি তৎক্ষণাৎ আমাদের মনে পড়ে যে বিসমিল্লাহ বা খাবারের দোয়া পড়ি নি তাহলে খাবারের মাঝখানে পরবর্তীতে অন্য একটি দোয়া পাঠ করতে হয়। দোয়াটি হলোঃ

আরবিঃ بسم الله اوله واخره

বাংলা উচ্চারণঃ “বিস-মিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আখেরাহ্।” (আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ)

বাংলা অর্থঃ মহান আল্লাহ তা’আলার নামে খাওয়া শুরু করছি। আদিতে (প্রথমেও) মহান আল্লাহর নাম, অন্তেও (শেষেও) মহান আল্লাহর নাম।

ইফতারের দোয়া

ইফতারের দোয়া

ইফতারের বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাহাবীদেরকে নিয়ে ইফতার করতেন। যারা রোজাদার রয়েছেন তাদের জন্য ইফতারের মুহূর্ত অনেক আনন্দের। সারা দিন রোজা রাখার পর যে পানাহারের মাধ্যমে রোজার সমাপ্তি করা হয় সেটাকে ইফতার বলে। ইফতারের আগে এবং পরে দুই সময়ে দোয়া পরতে হয়।

ইফতারের আগে দোয়া

ইফতার করার আগে রোজাদার ব্যক্তির দোয়া কবুল হয়। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তিন ব্যক্তির দোয়া কখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয় না: ন্যায়পরায়ণ শাসক, রোজাদার ব্যক্তি যখন সে ইফতার করে এবং অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৭৫২)

আরবিঃ بسم الله اَللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَ عَلَى رِزْقِكَ اَفْطَرْتُ

বাংলা উচ্চারণঃ “আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিযক্বিকা ওয়া আফতারতু বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন।”

অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমারই দেয়া রিজিজের মাধ্যমে ইফতার করছি। (মুআজ ইবনে জাহরা থেকে বর্ণিত, আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৫৮)

ইফতারের পরের দোয়া

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন ইফতার করতেন, তখন এই দোয়াটি বলতেন-

আরবিঃ ذَهَبَ الظَّمَاءُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَ ثَبَتَ الْأَجْرُ اِنْ شَاءَ اللهُ

বাংলা উচ্চারণঃ “জাহাবাজ্ জামাউ, ওয়াব-তালাতিল উ’রুকু, ওয়া ছাবাতাল আঝরু ঈন-শা-আল্লাহ।”

অর্থঃ পিপাসা দূর হলো (ইফতারের মাধ্যমে), শিরা-উপশিরা সিক্ত হলো এবং যদি আল্লাহ চান সাওয়াবও স্থির হলো।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৫৭)

শেষ কথা

প্রিয় বন্ধুরা, আশা করি এই আর্টিকেলে আপনারা রোজার নিয়ত, সেহরির নিয়ত এবং ইফতারের আগে ও পরের দোয়াগুলো জেনে অনেক উপকৃত হয়েছেন। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে রমজান মাসের রোজা রাখার তৌফিক দান করুন। সেই সাথে আমরা যেন রোজার নিয়ত সহীহভাবে করে রোজা রাখতে পারি এবং আমাদের সাহরি ও ইফতারের দোয়া কবুল করুক, আমিন।

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রোজা সম্পর্কে হাদিস ও গুরুত্বপুর্ণ কিছু আলোচনা

রোজা নিয়ে উক্তি, স্ট্যাটাস ও বাংলা ক্যাপশন

গরমে ইফতারে কি খাওয়া উচিত ও কি খাওয়া উচিত নয়