খাদ্য হিসেবে মাশরুম অতুলনীয়। এটি হাই প্রোটিনযুক্ত একটি খাবার। এই খাবারটি হজমও হয় খুব তাড়াতাড়ি। মাশরুমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ। প্রাচীনকাল থেকেই এটি পুষ্টিসমৃদ্ধ, সুস্বাদু ও দামী খাবার হিসেবে বিবেচিত। মাশরুমে রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, অ্যামাইনো এসিড, অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
বর্তমানে মাশরুম তার স্বাদ, পুষ্টি ও ঔষধিগুণের কারণে বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মাশরুম চাষ পদ্ধতি জানা থাকলে যে কেউ এটি চাষ করে অনেক লাভবান হতে পারে। এদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু মাশরুম চাষের খুবই উপযোগি। মাশরুম চাষের জন্য মাটি বা রোদ কোনোটারই প্রয়োজন হয় না।
মাশরুম কেন চাষ করবেন
মাশরুম চাষ করতে কোনো আবাদি জমির প্রয়োজন হয়না। অর্থাৎ যাদের কোনো আবাদি জমি নেই তারা তাদের বাড়ির পাশের অব্যবহৃত জায়গায় কিংবা ঘরের যেকোনো একপাশের বারান্দা ব্যবহার করে মাশরুম উৎপাদন করতে পারেন। মাশরুমের বীজ উৎপাদন করতে আপনার যেসব কাঁচামালের প্রয়োজন হবে যেমনঃ খড়, কাঠের গুঁড়া, কাগজ, গমের ভুসি ইত্যাদি এবং এসব কাঁচামাল খুবই সস্তা ও সহজলভ্য। তাই মাশরুম চাষ পদ্ধতি জানলে আপনেও এটি চাষ করে অনেক লাভবান হতে পারেন।
বাংলাদেশের আবহাওয়া মাশরুম চাষের জন্য অত্যান্ত উপযোগী। যে কেউ চাইলেই মাশরুম চাষ করতে পারেন। কারণ, মাশরুম চাষ করতে স্বল্প পুঁজির দরকার হয় এবং কিছু শ্রম ব্যয় করলেই এই মাশরুম থেকে অধিক আয় করা সম্ভব। আমরা মাশরুম চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানি না বা আমাদের তেমন কোন ভাল ধারণা না থাকার কারণে এটি চাষ করতে পারি না।
মাশরুম চাষ পদ্ধতি
বাংলাদেশে সাধারণত চার জাতের মাশরুম চাষ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে অয়েস্টার বা ঝিনুক মাশরুম বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। অয়েস্টার বা ঝিনুক মাশরুম খুব অল্প জায়গার সহজেই চাষ করা যায়। এই মাশরুম বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবেও চাষ করা হচ্ছে। আজকে আমরা জানবো মাশরুম চাষ পদ্ধতি ও এটি চাষ করতে কি কি প্রয়োজন হতে পারে:-
বর্তমানে বাংলাদেশে বানিজ্যিকভাবে অয়েস্টার বা ঝিনুক মাশরুমের চাষই বেশি হয়ে থাকে। অয়েস্টার বা ঝিনুক মাশরুম চাষের জন্য প্রধানত তিনটি উপকরণের দরকার হয়। আমরা যদি মাশরুম চাষ পদ্ধতি ভালভাবে জানি তাহলে এটি আমাদের দেশের জন্য অনেক বড় একটি অর্থনৈতিক উপাদান হতে পারে। উপকরণগুলো হচ্ছে- স্পন বা মাশরুমের বীজ, খড় ও পলিথিনের ব্যাগ।
- চাষ করার জন্য প্রথমে আধ থেকে এক ইঞ্চি মাপের খড় কেটে নিতে হবে। তারপর সেগুলো জীবাণুমুক্ত করার জন্য ফুটন্ত গরম পানিতে প্রায় ২০ মিনিট ফুটিয়ে নিতে হবে। ফোটানোর পরে পানি এমনভাবে ঝরিয়ে নেবেন, যাতে হাত দিয়ে খড় চাপ দিলে পানি না পরে কিন্তু হাতে একটা ভেজা ভেজা ভাব থাকে।
- এরপর একটি পলিব্যাগের মধ্যে প্রায় দু’ইঞ্চি পুরু করে খড় বিছিয়ে নিন। তার উপর ব্যাগের ধার ঘেঁষে বীজগুলোকে ছড়িয়ে দিন।
- বীজের উপরে খড় দিন আবার খড়ের উপরে বীজ দিন, এইভাবে প্রায় সাত-আটটা স্তর তৈরি করুন।
- এখন পলিব্যাগের মুখটা ভালো করে বন্ধ করে দিন। খড়গুলোকে বিছানোর সময় প্রতিবার হাত দিয়ে ভালো করে চেপে দিবেন, যাতে করে খড়ের ভিতর কোনো বাতাস না থাকে।
- এরপরে প্যাকেটে দশ থেকে বারোটা ছোট ছোট ছিদ্র করে তুলা দিয়ে ছিদ্রের মুখ বন্ধ করে দিন এতে করে স্বাভাবিক বাতাস চলাচল বজায় থাকবে এবং এর ভিতর কোনো ধুলাবালিও ঢুকতে পারবে না।
- এবার প্যাকেটটি সাত থেকে দশ দিনের জন্য কোনও অন্ধকার জায়গায় রেখে দিন।
- খেয়াল রাখতে হবে, জায়গাটি অন্ধকার হলেও সেখানে যাতে বাসাত চলাচল করতে পারে।
- জায়গাটি পোকা-মাকড়মুক্ত রাখতে হবে। মাছি মাশরুম চাষে অনেক ক্ষতি করে থাকে।
- অল্প কয়দিনের মধ্যেই সেই প্যাকেটে বীজের জায়গায় সাদা আস্তরণ দেখা দেবে, যাকে বলা হয় মাইসেলিয়াম (wiki)। পুরো ব্যাগটাই যখন মাইসেলিয়ামে ভরে যাবে তখন তুলো গুলোকে সরিয়ে আবারোও কয়েকটি ছিদ্র করে ব্যাগটিকে কিছুটা আলোর মধ্যে রাখতে হবে।
- ব্যাগটিকে সরাসরি রোদের মধ্যে রাখা যাবে না। ব্যাগটিকে ঘরের মধ্যেই রাখতে হবে সেখানেই যতটুকু আলো পাওয়া যায়।
- মাঝে মাঝে প্যাকেটের উপরে পানি স্প্রে করে দিবেন। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখবেন মাশরুম ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিচ্ছে।
- মাশরুম সাধারণত ২৫-৩০ দিনের মধ্যেই খাওয়ার উপযোগী হয়ে যায়।
- একটি ব্যাগ থেকে তিনবার ফলন পাওয়া যায়।
মাশরুমের পুষ্টিমাণ
মাশরুমের মধ্যে অনেক পুষ্টি রয়েছে। কারণ, আমরা প্রতিদিন যে খাবারগুলো খেয়ে থাকি তার চেয়ে মাশরুমের পুষ্টিগুণ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এটি পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি খাবার। এটি শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ সহ শরীরকে সুস্থ রাখতে খুবই সহায়ক। মাশরুমে ভরপুর প্রোটিন রয়েছে এবং এতে কোনো প্রকার ক্ষতিকর চর্বি নেয় যার ফলে এটি নিয়মিত খেলে শরীর ভালো থাকার পাশাপাশি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়।
- মাশরুম প্রোটিন সমৃদ্ধ সবজি হওয়ায় একে সবজি মাংসও বলা হয়। ১০০ গ্রাম শুকনো মাশরুমে ২০-৩০ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যায়।
- মাশরুমে রয়েছে ভিটামিন সি, বি, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম ও লৌহের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
- মাশরুমে কোনো কোলেষ্টরল নেই এবং এতে চর্বির পরিমাণও অত্যন্ত কম।
- মাশরুমে রয়েছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড ও লিনোলোয়িক এসিড।
- মাশরুমে শর্করার পরিমাণ কম থাকায় এই খাবারটি বহুমূত্র রোগীদের জন্য আদর্শ খাবার।
- মাশরুমে চর্বির পরিমাণ কম থাকায় এটি হৃদরোগীদের জন্যও খুব উপকারী।
মাশরুমের ঔষধিগুণ ও নানাবিধি ব্যবহার
মাশরুম ক্লোরোফিলবিহীন ছত্রাক জাতীয় উদ্ভিদ এবং নতুন ধরনের সবজি যা সম্পূর্ণ হালাল, সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও উচ্চ খাদ্যশক্তি এবং ভেষজগুণে ভরপুর। এটি একটি ঔষধিগুণ সম্পূর্ণ খাবার। এর মধ্যে রয়েছে ২৫-৩০% প্রোটিন যা অত্যন্ত উন্নত ও নির্ভেজাল। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে এটি বিভিন্ন জটিল রোগের প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে থাকে। এটির রয়েছে নানাবিধ ব্যবহার যেমন:-
- বিভিন্ন রোগব্যধিতে মাশরুম ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমনঃ বাত, ব্যথা, জন্ডিস, কৃমি কিংবা রক্ত বন্ধ হওয়ার কাজে মাশরুম ব্যবহার করা হয়।
- মাশরুম খেলে রক্তচাপ কমে এবং এটি টিউমার কোষের বিরুদ্ধে কাজ করে।
- নিয়মিত মাশরুম খেলে শারিরীক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং সেই সাথে রক্ত সঞ্চালণ বৃদ্ধি পায় এবং সর্দি, কাশি দূর হয়।
- মাশরুমে যথেষ্ট পরিমাণ আঁশ রয়েছে। যার ফলে শরীর স্লীম রাখতে সহায়তা করে।
- যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে এবং বহুমুত্র রোগী যারা আছেন তাদের জন্য মাশরুম খুবই উপকারী।
- মাশরুম কৌষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
আশাকরি মাশরুম চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আপনার অনেক ভাল ধারণা হয়েছে। এখন, আপনি চাইলে ঘরে বসেই মাশরুম চাষ করে সাবলম্বী হতে পারবেন। যারা বেকার রয়েছেন তারাও এই মাশরুম চাষ করতে পারেন। এই মাশরুম চাষ করে অনেক নারীই এখন সাবলম্বী হচ্ছেন। মাশরুম চাষ করার ফলে এটি আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখতে পারে।
Leave a Comment