বাংলা নববর্ষের ইতিহাস ও বাংলা নববর্ষ আমরা কেন পালন করি

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস ও বাংলা নববর্ষ আমরা কেন পালন করি

পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশ সহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা নববর্ষ হিসেবে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে পালিত হয়। পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতির জিবনে একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্যাপিত হয় বাংলা নববর্ষ। আপনারা যারা বাংলা নববর্ষের ইতিহাস ও বাংলা নববর্ষ আমরা কেন পালন করি জানতে চান, তারা এই আর্টিকেলটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন-

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস বা গোড়াপত্তনের খোঁজ নিতে চাইলে ফিরে যেতে হবে অনেক অনেক আগে অবাংলা অধ্যূষিত এলাকায়। প্রাচীন ভারতের রাজা বিক্রমাদিত্যের নাম অনুসারে হিন্দু বিক্রমী পঞ্জিকা প্রণয়ন করা  হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে। হিন্দু বিক্রমী পঞ্জিকা অনুযায়ী ভারতের পূর্বাঞ্চল, উত্তর পূর্বাঞ্চল ও নেপালের বিভিন্ন অংশে বসবাসরত গ্রামীণ বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে নিছক একটি “ঋতু উৎসব” হিসেবে প্রচলিত ছিলো পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ।

“ঋতু উৎসব” এর আমেজ বাংলা অব্দি পৌছতে চলে এসেছিলো ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে। ৭ম শতকে বাংলা বর্ষের প্রমাণ সময়ে বেশ পরিবর্তন এনে বাংলার বুকে বাংলা দিনপঞ্জির উদ্ভব ঘটান বাংলার প্রথম স্বাধীন নৃপতি গৌড়েশ্বর মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক মহাদেব

ভারত উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুঘল সম্রাটরা আরবি হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদের কে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর সর্ব প্রথম বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন।

মুঘল সম্রাট আকবরের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, তারপরে “বঙ্গাব্দ” এবং সর্বশেষ বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।

মূলত মুঘল সম্রাট আকবরের আমল থেকেই বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখনকার সময়ে প্রত্যেক বাঙালিরা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। বাংলা নববর্ষের দিন বা ১লা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।

তখনকার সময়ে এই দিনের প্রধান আকর্ষণ ছিল হালখাতা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। বাঙালি সমাজে এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে।

বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা নববর্ষ

বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা নববর্ষ

বাংলা সনের প্রবর্তনের সাথে সাথে যুগপৎ ভাবে শুরু হয় হালখাতার প্রথা। পুরানো বছরের হিসাব গুটিয়ে নতুন হিসাব খোলার খাতাকে নাম দেওয়া হয় হালখাতা। সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে তৎকালীন ঢাকার সুবেদার ইসলাম খান চিশতি ১৬১০ সালে নিজ বাসভবনের সামনে প্রজাদের মিষ্টি বিতরণ করেন। খাজনা আদায় ও হিসাব নিকাশের সাথে সাথে চলতো নানান উৎসব ও হালখাতার অনুষ্ঠান। ব্রিটিশ শাসন আমলে কার ফরাশগঞ্জের রূপলাল হাউস, মিটফোর্ডের নলগোলার ভাওয়াল রাজার কাচারি বাড়ি, এবং পাটুয়াটুলীর সামনে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে এই রকম আয়োজন হতো পুণ্যাহ নামে।

কৃষি নির্ভর সমাজ হাতে নগদ পয়সা আসার একমাত্র মাধ্যম ছিলো ফসল বিক্রি। ফলনের মৌসুমে ফসল বিক্রির টাকা হাতে পাওয়া না গেলে কৃষকসহ ব্যবসায়ীদের সকলেই খালি হাতে থাকতেন। ফলে সারা বছর তাদের বাকিতে জিনিসপত্র কিনতে হতো। এই পয়লা বৈশাখই ছিলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন তারা নিজেদের বাকির টাকা পরিশোধ করতেন। কেউ কেউ কিছু পরিশোধ করে নতুন বছরের জন্য নতুন হিসেবের খাতা খুলতেন। বিপণীরা তখন বাকিতে এদের কাছে পণ্য বিক্রি করতেন। কেউবা আসন্ন বছরের জন্য অগ্রিম অর্থ দিয়ে লেনদেন চালু রাখতেন। সবাই সবার পরিচিত ছিলো বলে পরস্পরের ভেতর অগাধ বিঃশ্বাস কাজ করতো।

ছায়ানটের বর্ষবরণ

ছায়ানটের বর্ষবরণ

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্র বিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহবান। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানান। স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃত পক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয় সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ । ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা।

মঙ্গল শোভাযাত্রা

মঙ্গল শোভাযাত্রা

ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় দারুণ ফুটিয়ে তোলা হয় গ্রামীণ জীবণ এবং আবহমান বাংলাকে। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় বিভিন্ন রং-বেরঙের মুখোশ ও নানান প্রাণীর প্রতিলিপি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ।

বাংলা নববর্ষ আমরা কেন পালন করি

বাংলা নববর্ষ আমরা কেন পালন করি

বাঙালির বারো মাসে তের পার্বণ। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসব হল বাংলা নববর্ষ। কথায় বলে ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’। তাই বছরের প্রথম দিনটা বিশেষ ভাবে উদযাপন করেন সকলে। যে অঞ্চলগুলি সৌর বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে, বৈশাখ মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসাবে বিবেচনা করে, তাদের নতুন বছরটি এই মাসের প্রথম দিনেই উদযাপিত হয়। যদিও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে ও আলাদা রীতিতে নববর্ষ উদযাপিত করে। বৈশাখের সঙ্গে বাঙালিদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক যেমন নিবিড়, তেমনি অর্থনৈতিক সম্পর্কও তাৎপর্যপূর্ণ। পহেলা বৈশাখ ও নববর্ষ বাঙালির বিজয় পতাকা আকাশে তুলে ধরে। বাঙালির এ বিজয় হচ্ছে সংস্কৃতির বিজয়। এ সাংস্কৃতিক বিজয়ের ফল ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালির এ সর্বজনীন উৎসব।

বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাঙালির প্রাচীনতম একটি ঐতিহ্য। পহেলা বৈশাখে নতুনকে গ্রহণ করার, পুরনোকে মুছে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা গ্রহণ করা হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির এই নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে সর্বজনীন উৎসবে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে উপলব্ধি এবং এর নিরন্তর চর্চা করা যে কোনো জাতির জন্যই গৌরবের। এ গৌরব বাঙালি জাতিরও রয়েছে। হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি আমাদের ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্যের ধারক-বাহক বাঙালি। এই বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত রূপ ফুটে ওঠে বাংলা নববর্ষের দিন। বাংলা নববর্ষ বাঙালির সমগ্র সত্তা, অস্তিত্ব ও অনুভবের সঙ্গে মিশে আছে। এটা বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জ্বল দিক।

পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আমাদের প্রাণের অনুষ্ঠান। পহেলা বৈশাখ আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। এ জাতি তার দেশকে ভালোবাসে, ভালোবাসে তার সংস্কৃতিকে। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে নববর্ষ বরণ বাঙালি জাতিসত্তাকে উজ্জ্বল করে। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও এ জাতি তার স্বাধীনতা রক্ষা করবে, রক্ষা করবে প্রাণের চেয়ে প্রিয় এ ভাষা, হাজার বছরের সংস্কৃতি। আবহমানকাল ধরে বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হচ্ছে বর্ষবরণের এ উৎসব। বাংলা নববর্ষ আমরা পালন করি মূলত বাঙালি জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে হাজার হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রাখার জন্য।

শেষ কথা

আশা করি আজকের এই বাংলা নববর্ষের ইতিহাস ও বাংলা নববর্ষ আমরা কেন পালন করি সম্পর্কিত আর্টিকেলটি আপনাদের অনেক ভালো লেগেছে। তথ্যবহুল এই আর্টিকেল থেকে যদি ভাল লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই আপনি আপনার বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের মাঝে শেয়ার করতে পারেন। এতক্ষণ ধরে আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। পরবর্তিতে কোন ধরণের আর্টিকেল পড়তে চান, কমেন্ট করে জানিয়ে দিতে পারেন। ধন্যবাদ।

আরও পড়ুনঃ- পহেলা বৈশাখ । বাঙালির সর্বজনীন উৎসব ও পহেলা বৈশাখের ইতিহাস

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পহেলা বৈশাখ । বাঙালির সর্বজনীন উৎসব ও পহেলা বৈশাখের ইতিহাস