অনলাইনে জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করার নিয়ম

অনলাইনে জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করার নিয়ম

জমির যে সকল কাগজপত্র থাকে তার মধ্যে জমির খতিয়ান একটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট। জমির তথ্য জানার জন্য খতিয়ান নাম্বার প্রয়োজন হয়। অনেক সময় জায়গা জমি ক্রয় বিক্রয়ের সময় মালিকানা যাচাই এর জন্য খতিয়ান অনুসন্ধান করার প্রয়োজন হয়।

বর্তমানে অনলাইন থেকে জমির খতিয়ান বের করা একদম সহজ। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে আপনি জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করতে পারবেন। কিভাবে করবেন তার পদ্ধতি দেখাবো এই আর্টিকেলে।

জমির খতিয়ান কি

আর্টিকেলটির সূচিপত্র

জমির খতিয়ান কি

অনেকেই জমির খতিয়ান কি সেটা জানে না, বা খতিয়ান কি সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নেই। তাই চলুন আগে জমির খতিয়ান কি সে বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক।

খতিয়ান শব্দের অর্থ হল ‘হিসাব’। সাধারণভাবে স্বত্ব সংরক্ষণ ও রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে জরীপ বিভাগ প্রত্যেক মৌজার ভূমির/জমির মালিক বা মালিকগণের নাম, পিতা/স্বামীর নাম, ঠিকানা, হিস্যা (অংশ) এবং তাদের স্বত্ত্বাধীন দাগসমূহের নম্বরসহ ভূমির/জমির পরিমাণ, শ্রেণী, খাজনা ইত্যাদি বিবরণ সহ ক্রমিক সংখ্যা অনুসারে স্বত্ব তালিকা বা স্বত্ত্বের রেকর্ড তৈরি করে। এই স্বত্ব তালিকা বা স্বত্ত্বের রেকর্ডের প্রত্যেকটিকে খতিয়ান বলা হয়।

খতিয়ান বলতে যা বুঝায় পর্চা বলতেও তাই বুঝায়। খতিয়ান এবং পর্চা একই জিনিস। সহজ ভাষায় বললে- জমির মালিকানা প্রমাণ করার জন্য সরকারি যে দলিল আছে তাকেই খতিয়ান বলা হয়। বাংলাদেশে ৪ ধরনের খতিয়ান প্রচলিত আছে-

  1. সিএস খতিয়ানঃ- ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ সরকার জরিপ করে যে খতিয়ান তৈরি করেছিল তাকেই সি. এস খতিয়ান বলা হয়। এটিই আমাদের দেশে প্রাথমিক খতিয়ান হিসাবে বিবেচিত হয়।
  2. এসএ খতিয়ানঃ- পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের চতুর্থ অধ্যায়ের (১৭ হতে ৩১ ধারা) মতে ১৯৫৬-৬০ সালের দিকে যে খতিয়ান তৈরি করা হয়েছিল তাকে এস. এ (State Acquision) খতিয়ান বলে।
  3. আরএস খতিয়ানঃ- বাংলাদেশ সরকার পূর্বের তৈরিকৃত খতিয়ানের ভুল ত্রুটি সংশোধন করার জন্য নতুনভাবে উদ্যোগ নিয়ে যে খতিয়ান তৈরি করেন তা আর. এস (Renisional Survey) খতিয়ান নামে পরিচিত।
  4. বিএস/বিআরএস/সিটি খতিয়ানঃ- ১৯৯৮-৯৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চলমান জরিপকে বি. এস খতিয়ান বা সিটি জরিপ বলা হয়। এই খতিয়ান তৈরি করার কার্যক্রম এখনো চলছে।

খতিয়ানে কি কি বিষয় থাকে?

ভূমির/জমির খতিয়ানে কি কি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে সে সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় অর্জন বিধিমালার ১৮ নম্বর বিধিতে উল্লেখ করা আছে, এগুলো হলো-

  • প্রজা/দখলদারের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা, তারা কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, অধিকৃত জমির অবস্থান শ্রেণী পরিমাণ ও সীমানা।
  • প্রজার/জমির মালিকের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা।
  • খতিয়ান প্রস্তুতের সময় খাজনা এবং ২৮, ২৯, ৩০ বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত খাজনা। যদি খাজনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে তাহলে যে সময় ও যে পদ্ধক্ষেপে বৃদ্ধি পায় তার বিবরণ। যে পদ্ধতিতে খাজনা ধার্য হয়েছে তার পুরো বিবরণ।
  • গোচরণ ভূমি, বনভূমি ও মৎস্য খামারের জন্য ধারণকৃত অর্থ। কৃষি কাজের উদ্দেশ্যে প্রজা কর্তৃক পানির ব্যবহার ও পানি সরবরাহের জন্য যন্ত্রপাতি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কিত প্রজা ও জমির মালিকের বর্ণনা।
  • নিজস্ব জমি হলে তার বিবরণ।
  • পথ চলার অধিকার এবং জমির সংলগ্ন অন্যান্য ইজমেন্টের অধিকার।
  • খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, বাট্টা নম্বর, মৌজা নম্বর, এরিয়া নম্বর ও জে. এল নম্বর, জেলার নাম, উপজেলা/থানা/ইউনিয়ন ইত্যাদি।

জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করার নিয়ম

আগে জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করার জন্য তফসিল অফিসে গিয়ে সিরিয়াল দিয়ে বের করতে হতো, তবুও পাওয়া দুষ্কর ছিলো। বর্তমানে সবকিছু ডিজিটাল হওয়ার কারণে জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করতে সিরিয়াল দিতে হয়না। অনলাইনের মাধ্যমে খুব সহজেই যেকোনো জমির খতিয়ান বের করা যায়।

অনলাইনে জমির খতিয়ান/পর্চা অনুসন্ধান ও দাগের তথ্য যাচাই করার জন্য কিছু বিষয় জানা থাকতে হবে, যেমন-

  • জমি যে ঠিকানায় অবস্থিত সেটি পূর্ণাঙ্গভাবে জানা থাকতে হব। যেমন – বিভাগের নাম, জেলার নাম, উপজেলার নাম , মৌজার নাম।
  • খতিয়ান নাম্বর, দাগ নম্বর, জমির মালিকের নাম, পিতা ও স্বামীর নামের যেকোনো একটি তথ্য জানা থাকতে হবে।

যদি এই বিষয় গুলো জানা থাকে তাহলে আপনি যেকোনো জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করতে পারবেন, তাহলে চলুন ধাপগুলো দেখে নেই-

  • প্রথমে ভূমি মন্ত্রণালয় খতিয়ান অনুসন্ধান ওয়েবসাইট eporcha.gov.bd ভিজিট করুন। তাহলে নিচের মত একটি পেইজ দেখতে পাবেন।

জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করার নিয়ম

  • এরপরে আপনার বিভাগ, জেলা ও উপজেলা খতিয়ানের ধরন নির্বাচন করুন। খতিয়ানের ধরণ অপশনে যে ধরণের খতিয়ান যাচাই করতে চান সেটি সিলেক্ট করে দিতে হবে, যেমন- আর এস খতিয়ান অনুসন্ধান করার জন্য খতিয়ানের ধরণ অপশন থেকে আর এস সিলেক্ট করে দিন। এরপরে মৌজা ও যার জমি তার নাম/খতিয়ান নাম্বার দিলে জমির দাগ নাম্বার ও জমির মালিকের নাম দেখতে পাবেন।

অনলাইনে জমির খতিয়ান

  • খতিয়ান পাওয়ার পর বিস্তারিত বাটনে ক্লিক করে খতিয়ান নং, মালিকের নাম ও জমির দাগ নং দেখতে পাবেন।

অনলাইনে জমির খতিয়ান

  • অনলাইনে জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করার নিয়ম তো জানলাম। চলুন, কিভাবে অনলাইনে খতিয়ানের সারটিফাইড কপি নেওয়ার জন্য কিভাবে আবেদন করবেন তা দেখে নেই।
  • খতিয়নের অনলাইনের কপির আবেদন করার জন্য উপরের ছবির নিচের অংশের “খতিয়ন আবেদন” এর উপর ক্লিক করলে আপনার সামনে নিচের ফরমটি চলে আসবে। আবেদন ফরমটি যথাযথভাবে পূরন করতে হবে।
  • ফরমটিতে যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে পূরণ করে “যাচাই করুন” বাটনে ক্লিক করতে হবে। যদি আপনার তথ্য সঠিক থাকে তাহলে যাচাই বাটনে ক্লিক করলেই “সঠিক হয়েছে” লেখা চলে আসবে।

অনলাইনে জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করার নিয়ম

  • এরপর পেমেন্ট অপশন থেকে ফি পরিশোধ করার পরে, পেমেন্ট সফলভাবে সম্পন্ন হলে আপনার সামনে কাঙ্খিত খতিয়ান/পর্চা চলে আসবে। এখান থেকে আপনি চাইলে ডাউনলোড করতে পারেন।

অনলাইনে জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করার নিয়ম

উপরের নিয়ম যথাযথভাবে ফলো করলে আপনি সহজেই যেকোনো জমির খতিয়ান অনুসন্ধান করে বের করতে পারবেন।

খতিয়ান বা মৌজা মানচিত্রের মূল্য

খতিয়ানের সার্টিফাইড কপির আবেদনের জন্য অফিস কাউন্টার থেকে ডেলিভারি চাইলে কোর্ট ফি ৫০ টাকা এবং ডাকের মাধ্যমে নিজের ঠিকানায় ডেলিভারি চাইলে ডাকের ফি ৪০ টাকা অর্থাৎ কোর্ট ফি ও ডাক ফি মিলিয়ে ৯০ টাকা পেমেন্ট করতে হবে। দেশের বাইরে খতিয়ান ডেলিভারি নিতে চাইলে দেশ ভিত্তিক ডাক মাশুল এর চার্জ যুক্ত হবে।

মৌজা ম্যাপ বা নকশার কপির আবেদনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ডাকে আবেদন করা যাবে। ডাকের মাধ্যমে মৌজা মানচিত্র আপনার ঠিকানায় পৌছে যবে। এক্ষেত্রে মৌজা ম্যাপ বা নকশার জন্য ৫২০ টাকা ও ডাক ফি ১১০ টাকা, মৌজা মানচিত্র ফি ও ডাক ফি মিলিয়ে ৬৩০ টাকা পেমেন্ট করতে হবে। দেশের বাইরে মৌজা ম্যাপ ডেলিভারি নিতে চাইলে দেশ ভিত্তিক ডাক মাশুল এর চার্জ দিতে হবে।

খতিয়ান/ই-পর্চা সংক্রান্ত সাধারন প্রশ্ন ও উত্তর

খতিয়ান/ই-পর্চা সংক্রান্ত সাধারন প্রশ্ন ও উত্তর

আর্টিকেলের উপরের অংশে আমি জমির খতিয়ান অনুসন্ধান সংক্রান্ত মোটামুটি সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। তারপরেও অনেকের মনে কিছু সাধারণ প্রশ্ন থাকতে পারে। চলুন খতিয়ান/ই-পর্চা সংক্রান্ত সাধারন প্রশ্ন কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর দেখে নেই-

খতিয়ানের অনলাইন কপি পাওয়া যাচ্ছে না কেন?

ক্রমাগত অনলাইনে খতিয়ান যুক্ত করা হচ্ছে। খুব দ্রুতই সকল খতিয়ান অনলাইনে যুক্ত হবে।

একজন ব্যাক্তি তার এনআইডি কার্ড দিয়ে দৈনিক কতটি আবেদন করতে পারবে?

একজন ব্যাক্তি তার এনআইডি ব্যবহার করে দৈনিক সর্বোচ্চ ৫ টি আবেদন করতে পারবে।

খতিয়ান আবেদন করেছি, আবেদনের স্ট্যাটাস কই থেকে চেক করব?

নাগরিক কর্নার থেকে আবেদন আইডি দিয়ে ট্র্যাকিং করা যাবে/আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা থেকেও আবেদনের আইডি দিয়ে ট্র্যাকিং করা যাবে।

আবেদনের পর টাকা কেটে নিচ্ছে কিন্তু আবেদনের রিসিট পাওয়া যাচ্ছে না, এক্ষেত্রে করণীয় কি?

আবেদনের সময় দেয়া মোবাইল নম্বরে এসএমএস এর মাধ্যমে ইউজার ও পাসওয়ার্ড দেয়া হয়। সেই ইউজার পাসওয়ার্ড দিয়ে “নাগরিক লগইন” থেকে নাগরিক তার রিসিট পুনরুদ্ধার করতে পারবে।

খতিয়ানের অনলাইন কপি না পাওয়া গেলে করনীয় কি?

অনেক সময় খতিয়ান নষ্ট হয়ে গেলে অনলাইনে পাওয়া যায় না, তবে এক্ষেত্রে সার্টিফাইড কপির জন্য আবেদন করতে পারবেন।

খতিয়ানের হার্ড কপিতে তথ্য সঠিক থাকলেও অনলাইনে তথ্য ভুল দেখাচ্ছে, সেক্ষেত্রে করনীয় কি?

এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেকর্ড রুম শাখায় যোগাযোগ করতে হবে।

জমির পর্চা হারিয়ে গেলে কী করতে হবে?

জমির পর্চা হারিয়ে বা নষ্ট করে ফেললে অনলাইনে eporcha.gov.bd ওয়েবসাইট থেকে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে উক্ত পর্চার অনুরূপ সত্যায়িত কপি সংগ্রহ করতে পারবেন।

খতিয়ানে জমির পরিমাণ কম দেখাচ্ছে, এক্ষেত্রে করনীয় কি?

সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেকর্ড রুমে যোগাযোগ করতে হবে। যদি খতিয়ান লিপিবদ্ধ করতে ভুল হয়ে থাকে তাহলে রেকর্ড রুম থেকে সংশোধন করা যাবে।

জমির খতিয়ান অনুসন্ধান সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য-

  • কল করুন- ১৬১২২
  • কারিগরি সহায়তার জন্য কল করুন- ০১৫৮১২৭৪৮৬৯, ০১৭২১৪৬১০০৪, ০১৮৯৬০০২৫৬৯ | সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ঃ০০ পর্যন্ত (সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত)
  • ইমেইল করুন- [email protected]

শেষকথা

আশা করি এই আর্টিকেল থেকে জমির খতিয়ান অনুসন্ধান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পেরেছেন। তারপরেও যদি জমির খতিয়ান অনুসন্ধান সংক্রান্ত কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন।

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

জমির খাজনা চেক করবেন কিভাবে? অনলাইনে জমির খাজনা দেওয়ার নিয়ম