শবে বরাতের ফজিলত ও আমল । পবিত্র শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস

শবে বরাতের ফজিলত ও আমল । পবিত্র শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস

মুসলিম বিশ্বের একটি পবিত্রময় রাত হচ্ছে শবে বরাত। শবে বরাতের এই রাতে মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা সকল বান্দার উপর রহমত দান করেন। আসমান থেকে জমিনে ফেরেশতা পাঠানো হয় বান্দাদের দুঃখ-কষ্ট জানার জন্য। সকল বান্দা এই রাতে নামাজ, আমল ও ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সাথে যোগাযোগ ও শামিল স্থাপন করে।

পাঠকবৃন্দ আপনারা যারা শবে বরাতের ফজিলত ও আমল, পবিত্র শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস জানতে চাচ্ছেন তারা আজকের এই আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

শবে বরাত কি

শবে বরাত কি

শবে বরাত একটি ফারসি শব্দ। শব মানে রাত, বরাত মানে মুক্তি। অর্থাৎ শবে বরাত শব্দের অর্থ হচ্ছে মুক্তির রাত। পবিত্র শবে বরাতের আরবি হলো, “লাইলাতুল বারাআত”। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা ‘শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী’ বলা হয়েছে। ইসলামী পরিভাষায়, আরবি শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) হলো পবিত্র শবে বরাত।

শাবান মাসের এই রাতে মহান আল্লাহ মুক্তি ও মাগফিরাতের দুয়ার খুলে দেন। সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। নিঃসন্দেহে এটি বরকতময় রাত। রাতটি শাবান মাসের মধ্যবর্তী হিসেবে হাদিসে এই রাতকে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান তথা অর্ধ শাবানের রাত বলা হয়েছে।

শবে বরাতের ফজিলত

শবে বরাতের ফজিলত

পবিত্র শবে বরাত বা লাইলাতুল বারাআত রহমত ও মুক্তির এক মহিমান্বিত রাত। এই রাতে মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা তার সকল বান্দার জন্য রহমতের দুয়ার খুলে দেন। পাপীদের উদারচিত্তে ক্ষমা করেন। মহান আল্লাহ্‌র সাথে অংশীদারি স্থাপনকারী ও অন্তরে হিংসা বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। হযরত আলি ইবনে আবি তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত;

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘যখন অর্ধ শাবানের রাত তোমাদের সামনে আসে, তখন তোমরা নামাজ আদায় করো এবং পরের দিনে রোজা রাখো। মহান আল্লাহ্‌ তাআলা এ রাতে সূর্যাস্তের পর প্রথম আসমানে অবতরণ করেন। এরপর তিনি এই বলে ডাকতে থাকেন—তোমাদের মধ্যে আছে কি কোনো ক্ষমাপ্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। তোমাদের মধ্যে আছে কি কোনো রিজিক অন্বেষণকারী? আমি তাকে রিজিক দান করব। তোমাদের মধ্যে আছে কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি তার বিপদ দূর করে দেব। ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৩৮৮)।

লাইলাতুল বারাআত এর আরেকটি ফজিলত হচ্ছে, পবিত্র এই রাতে সকল সৃষ্টি জগতের ভাগ্য নির্ধারন করা হয়। সৃষ্টি জগত তথা মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত, যা পৃথিবী সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর আগেই নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে পবিত্র এই রাতে এক বছরে ভাগ্য প্রকাশ করা হয়ে থাকে। হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত;

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘তুমি কি জানো, অর্ধ শাবানের রাতের কার্যক্রম কী?’ আয়েশা (রা.) বললেন না, হে আল্লাহর রাসুল।’ নবী (সা.) বললেন, “এ বছর যতজন সন্তান জন্মগ্রহণ করবে এবং মারা যাবে তা লিপিবদ্ধ করা হয়। এ রাতেই মানুষের আমল পৌঁছানো হয় এবং এ রাতেই তাদের রিজিক অবতীর্ণ হয়।” (মিশকাতঃ ১৩০৫)।

অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে, আতা ইবনে ইয়াসার (রহ.) থেকে বর্ণিত, শাবানের ১৫ তম রাতে মৃতদের তালিকা (মৃত্যুর দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতার কাছে) দেওয়া হয়। এমনকি কোনো লোক সফরে বের হয়, অথচ তাকে জীবিতদের তালিকা থেকে মৃতদের তালিকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। কেউ বিয়ে করে অথচ তাকে জীবিতদের তালিকা থেকে মৃতদের তালিকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭৯২৫)।

শবে বরাতের আমল

শবে বরাতের আমল

পবিত্র লাইলাতুল বরাতের রাত জাগা ইবাদতের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই রাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, দোয়া ও জিকিরে মশগুল থাকতেন। রাত জাগার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ্‌র রহমত ও বরকত লাভ করতে পারি। রাত জেগে যেকোনো ইবাদতের মাধ্যমে শবে বরাত পালন করা যাবে। লাইলাতুল বারাআত এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল গুলো হলো;

  • এই রাতে অধিক নফল নামাজ পড়া উচিত।
  • পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা । সম্পূর্ণ কোরআন তেলাওয়াত করতে না পারলে, কিছু অংশ তেলাওয়াত করা উচিত।
  • এই রাতে আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া ও জিকির করা উচিত। ক্ষমা, রহমত, বরকত, জান্নাত প্রাপ্তি, এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সুখের জন্য দোয়া করা উচিত।
  • গোনাহের জন্য তওবা ও ইস্তেগফার করা উচিত।
  • এই রাতে দান-খয়রাত করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা এবং তাদের জন্য দান করা উচিত।
  • শবে বরাতের রাতে বিশেষ কোনো নামাজ বা ইবাদত নেই।
  • এ রাতে অলীক রীতিনীতি ও কুসংস্কার থেকে দূরে থাকা উচিত।
  • মৃতদের জন্য মাগফিরাত ও দোয়া করা।
  • ইসলামের আলোকে এই রাতের আমল করা উচিত।

পবিত্র শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস

পবিত্র শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস

লাইলাতুল বারাআত সম্পর্কে অনেক হাদিস রয়েছে, যেগুলো আমাদের জানতে হবে। সিহাহ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ছয়টি হাদিসগ্রন্থের কোনো কোনো হাদিসে এই রাতের বিশেষত্ব নির্দেশক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও এই রাতের বিশেষত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। আপনাদের জন্য এই রাতের সেরা কয়েকটি হাদিস নিচে দেওয়া হলো-

  • রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্নপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন। ইবনু মাজাহ, আস- সুনান ১/৪৪৫; বাযযার, আল-মুসনাদ ১/১৫৭, ২০৭, ৭/১৮৬; আহমদ ইবনু হাম্বল)
  • এ মাসে রাব্বুল আলামীনের কাছে মানুষের কর্ম উঠানো হয়। আর আমি ভালবাসি যে, আমার রোযা রাখা অবস্থায় আমার আমল উঠানো হোক।  (নাসাঈ, আস-সুনান ৪/২০১; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৪৭)।
  • আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন : আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিয্‌ক প্রার্থনাকারী আমি রিয্‌ক দান করব। আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থ্যতা দান করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে। (ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী)
  • আমি তো তা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। (সূরা দুখানঃ আয়াত ৩-৪)
  • হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে; নবীজি (সাঃ) এ রাতে মদিনার কবরস্থান “জান্নাতুল বাকি”তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া–বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি: ৭৩৯)।
  • শবে বরাতে নবীজির আমল সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন “একবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো- তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না- হে আল্লাহর রাসূল। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। তখন নবী (সঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন ইরশাদ করলেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত (শবে বরাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ (শুআবুল ঈমান, বায়হাকি: ৩/৩৮২-৩৮৩; তাবারানি: ১৯৪)
  • আরেক হাদিসে হযরত আলি ইবনে আবু তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখন মধ্য শাবানের রাত আসে, তখন তোমরা এ রাতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ো এবং দিনে রোজা রাখো। কেননা এদিন সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর নিকটতম আসমানে নেমে আসেন এবং বলেন, কে আছো আমার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করবো। কে আছো রিজিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দেব। কে আছো রোগমুক্তি চাও? আমি তাকে সুস্থতা দেব। কে আছো এই এই চাও?” এভাবে ফজরের সময় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। (সুনানে ইবনে মাজাহ, ১৬২)।

শেষ কথা

শবে বরাত বা লাইলাতুল বারাআত, বরকতময় রজনী, ক্ষমা ও রহমতের রাত। মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা এ রাতে বান্দাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকান। এই রাতে যেকোনো ইবাদত করা যাবে। এই ইবাদতের মাধ্যমে ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। সকল মুসলিমদের শবে বরাতের ইবাদত করতে হবে। আশা করছি শবে বরাতের ফজিলত, আমল ও সম্পর্কে হাদিস জানতে পেরেছেন। এই রকম আরও ইসলামিক আর্টিকেল পেতে আমাদের এই সাইটটি ভিজিট করুন। এতক্ষণ সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *