বর্তমান বাংলাদেশে হারিয়ে যাওয়া একটি কৃষি শিল্প হচ্ছে রেশম চাষ। আর এই হারিয়ে যাওয়া কৃষি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান তালে অবদান রাখছেন। আজকাল মহিলারাও রেশম চাষ করে নিজেদের স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি দেশের এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামের শত শত নারী এখন রেশম চাষে ঝুঁকছেন।
রেশম চাষ কাকে বলে?
রেশম সুতা উৎপাদনের উদ্দেশ্যে কৃত্রিমভাবে রেশম পোকা প্রতিপালন করাকে রেশম চাষ বলে। রেশম চাষের ইংরেজি শব্দ Sericulture. যার আভিধানিক অর্থ Culture of Sericin. যার অর্থ সেরিসিন নামক এক ধরনের প্রোটিনের লালন। বর্তমানে আমরা রেশম থেকে বিভিন্ন ধরনের পরিধেয় বস্ত্র তৈরি করে থাকি। মূলত সুতা তৈরির উদ্দেশ্যে রেশম পোকা প্রতিপালন করাকেই রেশম চাষ বলা হয়।
রেশম তুলা মূলত রেশম পোকার গুটি থেকে তৈরি সুতা দিয়ে বোনা একপ্রকার সূক্ষ্ম ও কোমল তন্তু। এ দেশে দীর্ঘদিন যাবৎ রেশম তুলা তৈরি হয়ে আসছে। রেশম সুতা মূলত চার ধরনের হয়ে থাকেঃ মালবেরি, এন্ডি, মুগা এবং তসর। মালবেরি তৈরি হয় বমবিকস বর্গের রেশম পোকার গুটি থেকে, যে পোকাটি তুত গাছের পাতা খায়। এন্ডি তৈরি হয় ফিলোসেমিয়া বর্গের রেশম পোকার গুটি থেকে, যে পোকাটি ক্যাস্টর গাছের পাতা খায়। মুগা তৈরি হয় আসমেনসিন বর্গের রেশম পোকার গুটি থেকে, যে পোকাটি তেজপাতা, কুল ও কর্পুর গাছের পাতা খায়। চতুর্থ গাছ অর্থাৎ তসর তৈরি হয় অ্যান্থেরি বর্গভুক্ত রেশম পোকার গুটি থেকে, যারা ওক গাছের পাতা খায়। আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
রেশম চাষ কিভাবে হয়?
রেশম চাষ মূলত রেশম পোকা দিয়ে হয়। রেশম পোকা প্রতিপালন করা হয় মূলত রেশম সুতা উৎপাদনের লক্ষ্য। এই রেশম পোকার থেকেই রেশম চাষ করা হয়। এটি ফলিত প্রাণিবিজ্ঞান এর অন্যতম একটি শাখা। রেশম ইংরেজি শব্দ Sericulture থেকে এসেছে যার অর্থ সেরিসিন নামক এক ধরনের প্রোটিনের লালন। এই সেরিসিন হলো রেশমের মূল গাঠনিক পদার্থ।
রেশম চাষ করার পদ্ধতি
আপনি যদি রেশম চাষ করতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে এটি চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হবে। তবেই আপনি এটি চাষ করতে পারবেন। এই আর্টিকেলে আমরা আপনাদের রেশম চাষ করার পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবো। আপনার যদি এই পদ্ধতি অনুসরণ করেন তাহলে একজন সফল উদ্যেক্তা হতে পারবেন, এবং এটি চাষ করে আপনি মুনাফা অর্জন করতে পারবেন। চলুন তবে শুরু করা যাক-
- তুত পাতা সংগ্রহ করাঃ রেশম চাষ করতে হলে প্রথমে আপনাকে তুত পাতা সংগ্রহ করতে হবে। আরোও ভালো হয় আপনি যদি নিজেই তুত গাছ লাগাতে পারেন। আর যদি গাছ লাগাতে না পারেন তাহলে পাতা বাগান থেকে তুত পাতা ক্রয় করতে পারেন। মূল কথা হলো যেভাবেই হোক আপনাকে তুত পাতা সংগ্রহ করতে হবে। কারণ, তুত পাতা ছাড়া আপনি রেশম চাষ করতে পারবেন না।
- রেশমের লার্ভা সংগ্রহ ও প্রতিপালনঃ রেশম চাষ করতে চাইলে আপনাকে ভালো মানের রেশমের লার্ভা সংগ্রহ করতে হবে এবং সেগুলোকে পালন করতে হবে। আপনি যদি শীতকালে রেশমের লার্ভা পালন করেন সেক্ষেত্রে আপনাকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেমন, শীতকালে ঘরের তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য আপানাকে রুম হিটার কিংবা চুলা ব্যবহার করতে হবে। থার্মোমিটার দিয়ে পরীক্ষা করে নিবেন ঘরের তাপমাত্রা ঠিক আছে কিনা।
- বাসস্থান জীবাণুমুক্ত করাঃ আপনি যেখানে রেশমের লার্ভা পালন করবেন সে জায়গাটিকে অবশ্যই জীবাণুমুক্ত করে নিবেন। রেশমের লার্ভা প্রতিপালনের কাজে আপনি যে জিনিপত্রগুলো ব্যবহার করবেন সেগুলো অবশ্যই ভালোভাবে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিবেন। এরপর ঘরে ফর্মালিন যুক্ত পানি দিয়ে স্প্রে করে নিবেন। স্প্রে করার পর ঘর অবশ্যই ২৪ ঘন্টার জন্য বন্ধ রাখতে হবে।
- ডিম ফোটানোঃ সবসময় চেষ্টা করবেন ভালো ডিম সংগ্রহ করতে। আপনি যদি ভালো ডিম সংগ্রহ করতে পারেন তাহলে সেই ডিমগুলো থেকে ১০ থেকে ১১ দিনের মধ্যেই লার্ভা বের হবে। ভালো মানের ডিম সংগ্রহ করার পর ২৫ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ৮০% আদ্রতায় রেখে দিতে হবে। ডিমগুলো শোধন করার জন্য ৫ মিনিট ফর্মালিন যুক্ত পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। ৮/৯ দিনের মাথায় ডিমগুলোর উপরে কালো সিট পরবে এবং ১০/১১ দিনের মধ্যেই ডিম ফেটে লার্ভা বের হবে।
- লার্ভাঃ ডিম থেকে লার্ভা বের হওয়ার ২০ থেকে ২৫ দিন ওই অবস্থাতেই লার্ভা দেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে তুত গাছের পাতা খেতে দিতে হবে। এই সময়ের মধ্যে তারা ৪ বার খোলস বদলায় এবং ৫ বাড়ে গিয়ে তারা পুত্তলি তৈরি করে।
- পুত্তলিঃ পুত্তলির মধ্যে পিউপা চলাফেরা করতে পারে না এ অবস্থায় তার দেহ ছোট হয়ে যায় এবং খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে মাথা নাড়ে। ৯/১৪ দিনের মধ্যে খোকনের আক্রান্ত ছিদ্র করে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি বের হয়ে আসে।
- গুটি সংগ্রহঃ টোকা চন্দ্র খেতে যাওয়ার পরের ৩/৪ দিন পর পরীক্ষা করে নিতে হবে যে গুটি তৈরি হয়েছে কিনা। সাধারণত এই সময়ে খটখট শব্দ শোনা যায়। গুটি পরিপূর্ণতা লাভ করার পর এটিকে গরম তাপের মাধ্যমে ভিতরের পোকা মেরে ফেলে তারপর রেশম গুটি সংগ্রহ করতে হয়।
রেশম চাষ পদ্ধতি কোথায় আবিষ্কৃত হয়?
রেশম চাষ পদ্ধতি সর্বপ্রথম চীনে আবিষ্কৃত হয়। রেশম শব্দটি এসেছে ফরাসি ভাষা থেকে। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ হাজার বছর আগে এই চাষ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। এটি চীনে আবিষ্কৃত হওয়ার পর তারা প্রায় ২০০০-২৫০০ হাজার বছর পর্যন্ত গোপনভাবে রেশমি সুতা ও কাপড় তৈরি করতো। ৫০০ খ্রিস্টাব্দের পর ইউরোপের ২ জন পাদ্রি এটি চুরি করে নেয় এবং রেশমি সুতা উৎপাদন করার পদ্ধতি রপ্ত করে নেয়।
সেই সাথে তারা রেশম উৎপাদনের জন্য রেশম পোকার ডিম ও তুত গাছের বীজ সংগ্রহ করে রেশমের চাষ করা শুরু করে দেয়। বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই এখন রেশম পোকার চাষের মাধ্যমে রেশমি সুতা থেকে রেশমি কাপড় তৈরি করে থাকে।
বাংলাদেশের কোন জেলায় রেশম চাষ হয়?
বাংলাদেশের শিল্পগুলোর মধ্যে রেশম অন্যতম একটি প্রাচীন শিল্প। বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা রেশম চাষের জন্য বিখ্যাত এবং তারা সবচেয়ে এগিয়ে আছে। বর্তমানে রংপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলেও রেশম চাষ শুরু ক্রা হয়েছে। রংপুরের ওই অঞ্চল্গুলোতে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫ টন রেশম সুতা উৎপাদন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের শিল্পখাতে রেশম শিল্পের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপর্ণ। দেশে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রেশম উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এটি বিদেশেও রপ্তানি করার মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
রেশম চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
বর্তমানে চাষীরা রেশম চাষ করার মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ অর্থ উপার্জন করছেন। এটি করতে খুব বেশি টাকা বিনিয়োগ করতে হয় না। অল্প কিছু টাকা বিনিয়োগ করলেই অনেক বেশি লাভবান হওয়া যায়। রেশমের গুটি তৈরি করার জন্য ১-৪ হাজার টাকায় যথেষ্ট।
আবার ৪-১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলেই আপনি রেশমের সুতা তৈরি করতে পারবেন। এর সাথে আরো ৫-১০ হাজার টাকা বেশি বিনিয়োগ করলে আপনি রেশমের গুটি তৈরি করা থেকে শুরু করে সুতা তৈরি এবং সেই সুতা দিয়ে পোশাক তৈরি করে বাজারজাত করতে পারবেন।
রেশম চাষ বর্তমান সময়ের একটি লাভজনক ব্যবসা। অল্প পুঁজি দিয়েই আপনি এই ব্যবসা করতে পারবেন। অল্প পুঁজি ব্যবহার করে ব্যবসা শুরু করার জন্য এটিই একমাত্র লাভজনক ব্যবসা।
Leave a Comment