জলবাহিত রোগ কি? এর লক্ষণ, কারণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

জলবাহিত রোগ কি? এর লক্ষণ, কারণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

পানির অপর নাম জীবন। বিশুদ্ধ পানি খেলে যেমন আমাদের শরীর ভালো থাকে তেমনি অপরিশুদ্ধ পানি পান করলে আমাদের শরীরে এক ধরনের রোগ দেখা দেই যাকে বলা হয় জলবাহিত রোগ। পানিতে ক্ষতিকারক অণুজীব এবং দূষিত পদার্থের কারণে জলবাহিত রোগের সৃষ্টি হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে প্রত্যেক বছর পৃথিবীতে প্রায় দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হল জলবাহি জনিত রোগ। প্রতি বছর, লক্ষ লক্ষ জীবন এই রোগের দ্বারা প্রভাবিত হয়। ইউনিসেফের অনুমান অনুসারে সমস্ত অসুস্থতার 80% এবং সমস্ত মৃত্যুর এক তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী এই জলবাহিত রোগ। তাই আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানবো জলবাহি জনিত রোগ কি, কিছু জলবাহি জনিত রোগের নাম, এই রোগের কারণ কি, এই রোগ হলে কি কি লক্ষণ দেখা দেই এবং জলবাহিত রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে।

জলবাহিত রোগ কি

জলবাহিত রোগ কি?

অপরিশুদ্ধ পানি পান করার মাধ্যমে অথবা সেই পানি রন্ধন ইত্যাদি কার্যে ব্যবহার করার ফলে যে ধরনের ব্যাধি সংক্রামিত হয়ে থাকে তাকেই পানিবাহিত রোগ বা জলবাহিত রোগ বলে। এই রোগগুলি হল দূষিত জল খাওয়ার কারণে বা এটি দিয়ে তৈরি খাবারের মাধ্যমে সৃষ্ট অসুস্থতা। জল দূষণ ঘটতে পারে যখন খাবার খাওয়ার জন্য জল একটি সংক্রামিত ব্যক্তির দ্বারা বা পৃষ্ঠের দূষণের মাধ্যমে দূষিত হয়, যার ফলে সংক্রমণ হয়।

এই ধরনের সংক্রমণ ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া সহ ক্ষতিকারক প্যাথোজেন দ্বারা সৃষ্ট হতে পারে। এই ধরনের দূষিত উৎসের সংস্পর্শে আসা বিভিন্ন জলবাহি জনিত রোগের কারণ হতে পারে এবং ছড়াতে পারে। অর্থাৎ যে-সকল রোগের জীবাণুগুলি অপরিশোধিত পানীয়জলের মাধ্যমে বাহিত হয়ে মানুষের দেহে প্রবেশ করে এবং মানুষের দেহে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে সেগুলিকে জলবাহিত রোগ বলে। যেমন—ডায়রিয়া, কলেরা ইত্যাদি।

সাধারণ জলবাহিত রোগ

সাধারণ জলবাহিত রোগ

জলবাহিত রোগ বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। এ রোগ সম্পর্কে ভালোভাবে জানার ফলে এবং বোঝার ফলে এই রোগগুলি থেকে সচেতন হতে এবং এগুলি এড়াতে সতর্কতা অবলম্বন করতে সহায়তা করতে পারে। নিম্নে বিভিন্ন ধরণের জলবাহিত রোগ সম্পর্কে লেখা হলো-

  • টাইফয়েডঃ টাইফয়েড জ্বর দূষিত খাবার এবং পানির মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। এবং এটি সাধারণ জলবাহিত রোগগুলির মধ্যে অন্যতম। এটি অত্যন্ত সংক্রামক এবং সংক্রামিত ব্যক্তির দ্বারা দূষিত পানির সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ যেই সব জায়গায় বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যকর পানির অভাব মূলত সেখানে বসবাসকারী লোকেরা টাইফয়েড জ্বরে বেশি আক্রান্ত হয়।
  • কলেরাঃ কলেরা হল একটি জলবাহি জনিত রোগ। এটি সাধারণত গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলিতে ঘটে যেখানে লোকেরা সর্বদা সঠিক স্যানিটেশন পায় না। কলেরা অত্যন্ত সংক্রামক। এটি খুব সহজেই একটি প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারে এবং সংক্রমণের কয়েক দিন বা এমনকি কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রাণঘাতী হতে পারে।
  • আমাশয়ঃ সাধারণ জলবাহিত রোগের মধ্যে আমাশয় একটি। এটি শিগেলা ব্যাকটেরিয়া বা অ্যামিবা দ্বারা সৃষ্ট হতে পারে। আমাশয় দূষিত খাবার এবং পানীয়ের মাধ্যমে ছড়ায়। বিশেষ করে যে জায়গায় ভাল স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা হয় না। আমাশয়-সৃষ্টিকারী রোগজীবাণু ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবী দ্বারা দূষিত খাদ্য এবং জল দ্বারা বা মানুষের মলের সাথে সরাসরি সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে ছড়াতে পারে।
  • হেপাটাইটিসঃ হেপাটাইটিস একটি পানিবাহিত রোগ। এটি ছড়ায় দূষিত খাবার ও পানীয় খাওয়ার মাধ্যমে কিংবা সংক্রামিত ব্যক্তির কাছাকাছি থাকার কারণে। এই রোগটি বেশি দেখা যায় অনুপযুক্ত স্যানিটেশন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নেই এমন জায়গায়।
  • জিয়ার্দিয়াঃ জিয়ার্দিয়া একটি স্বল্প পরিচিত পানিবাহিত রোগ। এটি বীভার জ্বর নামেও পরিচিত। এটি সাধারণত দূষিত খাবার, পানি এবং মানুষের সংস্পর্শে ছড়িয়ে পড়ে। এটি কারোও শরীরে সংক্রমিত হলে সংক্রমণ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিজেই চলে যেতে পারে, তবে অন্ত্রের উপর ক্ষতিকর প্রভাবগুলি অনেক বেশি সময় ধরে চলতে পারে, কখনও কখনও এমনকি বছরের পর বছরও।

জলবাহিত রোগের কারণ কি

জলবাহিত রোগের কারণ কি?

পানিবাহিত বা জলবাহিত রোগ ছড়ানোর প্রধান কারণ হলো সঠিক পরিচ্ছন্নতা ও স্যানিটেশন মেনে চলার অভাব। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, এই রোগ সংক্রমণের মূল কারণ হল উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অপরিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং পরিচ্ছনতার অভাব। এর ফলে আক্রান্তদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই বেশি লক্ষ্যণীয়। নিম্নে জলবাহি জনিত রোগের কারণগুলো লেখা হলো-

অপর্যাপ্ত স্যানিটেশনঃ অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধা, যেমন টয়লেটের অভাব এবং যথাযথ বর্জ্য জল ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা, জলের উৎস দূষণে অবদান রাখে। মানব বর্জ্যের অনুপযুক্ত নিষ্পত্তি এবং চিকিৎসা সুবিধার অনুপস্থিতি প্যাথোজেনগুলিকে জল সরবরাহে প্রবেশ করতে দেয়।

মাইক্রোবিয়াল দূষণঃ পানি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং পরজীবী দ্বারা দূষিত হতে পারে। এতে করে কলেরা, টাইফয়েড জ্বর, হেপাটাইটিস এ, গিয়ারডিয়াসিস এবং ক্রিপ্টোস্পোরিডিওসিসের মতো রোগের সৃষ্টি হয়। এই অণুজীবগুলি মানুষ এবং প্রাণীর পয়ঃনিষ্কাশন এবং মল পদার্থ দিয়ে জলের উৎসগুলিতে অনুপ্রবেশ করে।

দূষিত পানীয় জলঃ পানীয় জল যা অপর্যাপ্ত চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যায় বা যথাযথ জীবাণুমুক্তকরণের অভাবে ক্ষতিকারক অণুজীবকে আশ্রয় করতে পারে।

শিল্প নিঃসরণঃ শিল্প থেকে নির্গত রাসায়নিক দূষক পানিকে দূষিত করতে পারে, যা জলবাহি জনিত রোগের বিকাশে অবদান রাখে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়: বন্যা, হারিকেন এবং অন্যান্য বিপর্যয়কর ঘটনাগুলির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলি রোগজীবাণু এবং দূষকগুলির সাথে জলের উৎস দূষিত হতে পারে। ফলে জলবাহিত রোগের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

জলবাহিত রোগের লক্ষণ

জলবাহিত রোগের লক্ষণ

বিভিন্ন জলবাহিত রোগের বিভিন্ন কারণের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন উপসর্গ থাকতে পারে, তবে তাদের মধ্যে কিছু লক্ষণ রয়েছে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট রোগ এবং ব্যক্তির ইমিউন সিস্টেমের উপর নির্ভর করে জলবাহি জনিত রোগের লক্ষণ পরিবর্তিত হতে পারে। নিম্নে জলবাহি জনিত রোগের লক্ষণগুলি লেখা হলো-

টাইফয়েড জলবাহিত রোগের লক্ষণ

  • পেশী ব্যথা এবং দুর্বলতা সহ জ্বর
  • অতিসার
  • বমি বমি ভাব
  • অবিরাম ক্লান্তি

আম জলবাহিত রোগের লক্ষণ

  • জ্বর
  • বমি বমি ভাব
  • মল দিয়ে রক্ত ​​নিঃসরণ সহ ডায়রিয়া
  • মারাত্মক ডিহাইড্রেশন
  • পেটের পেশীতে বাধা এবং ব্যথা

হেপাটাইটিস জলবাহিত রোগের লক্ষণ

  • নেবা
  • আকস্মিক উচ্চ জ্বর
  • অনিয়মিত অন্ত্রের গতিবিধি
  • অবসাদ
  • পেটে ব্যথা
  • ক্ষুধা হ্রাস অথবা ওজন হ্রাস

কলেরা জলবাহিত রোগের লক্ষণ

  • ডায়রিয়া ডিহাইড্রেশনের দিকে পরিচালিত করে
  • বমি বমি ভাব
  • গুরুতর পেশী ক্র্যাম্প

জিয়ার্দিয়া জলবাহিত রোগের লক্ষণ

  • অতিসার
  • স্ফীত হত্তয়া
  • বমি বমি ভাব
  • ক্রমাগত পেটে খিঁচুনি এবং ব্যথা
  • ওজন হ্রাস

জলবাহিত রোগ প্রতিরোধ

জলবাহিত রোগ প্রতিরোধ

বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে- “প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম” এই প্রবাদটি পানিবাহিত রোগজীবাণু দ্বারা সৃষ্ট অবস্থার জন্য একদম উপযুক্ত। জলবাহিত রোগের প্রভাব কমাতে প্রতিরোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিম্নে জলবাহিত রোগ প্রতিরোধ করার কিছু উপায় সমূহ সম্পর্কে লেখা হলো-

ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখাঃ জলবাহি জনিত রোগ থেকে নিজেকে দূরে রাখা যায় বা বাঁচানো যায় তা নিশ্চিত করার সর্বোত্তম উপায় হল প্রতিবার খাওয়ার আগে সাবান এবং পরিষ্কার জল দিয়ে হাত ধোয়া। সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা এবং পরিষ্কার পোশাক পরিধান করে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা।

কলের পানি এড়িয়ে চলাঃ সম্ভব হলে সরাসরি কল থেকে পানি এড়িয়ে চললে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সরাসরি সংস্পর্শে আসা রোধ করতে সাহায্য করতে পারে। কলের পানির পরিবর্তে, বোতলজাত পানি পান করলে এই ধরনের পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধ করা যায়।

শাকসবজি ধোয়াঃ যেকোনো শাকসবজি রান্না করার আগে তা অবশ্যই ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। এতে করে ওই শাকসবজিতে যদি কোন ক্ষতিকারক অণুজীব থেকে থাকে তা হলে তার বিস্তার রোধ করা যাবে। তাই ফল ও শাকসবজি খাওয়ার আগে তা অবশ্যই পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুলে এ ধরনের রোগ প্রতিরোধ করা যায়।

কম রান্না করা বা কাঁচা খাবার এড়িয়ে চলাঃ কম রান্না করা বা কাঁচা খাবারে বিভিন্ন ক্ষতিকারক প্যাথোজেন এবং পরজীবী থাকে। আর এই খাবারগুলো খেলে শরীরে অনেক রোগ জীবাণু বাসা বাঁধে। তাই কম রান্না করা খাবার বা কাঁচা খাবার কখনোই খাওয়া উচিত নয়। সম্ভব হলে গরম খাবার খান।

ভ্যাকসিনঃ হেপাটাইটিস এবং টাইফয়েডের মতো রোগ প্রতিরোধে টিকা দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই উপযুক্ত সময়ে টিকা দিলে রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।

 

শেষ কথা

প্রিয় পাঠক, আশা করি আজকের এই আর্টিকেল পড়ে আপনারা অনেক উপকৃত হয়েছেন। এখানে আমি পানিবাহিত বা জলবাহিত রোগের যাবতীয় কিছু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি। যেমনঃ জলবাহিত রোগ কি, কিছু জলবাহি জনিত রোগের নাম, এই রোগের কারণ কি, এই রোগ হলে কি কি লক্ষণ দেখা দেই এবং জলবাহি জনিত রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে। তাই নিজে এই রোগ থেকে সচেতন থাকি এবং অন্যকেও সচেতন রাখি। ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন।

জলবাহি জনিত রোগ সম্পর্কে আরও জানতেঃ- carehospitals.com

Author

More Reading

Post navigation

Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার । টাইফয়েড জ্বর কিভাবে ছড়ায়?