ট্রুকলার কিভাবে কাজ করে : ক্রাউড সোর্সিং ! [বিস্তারিত]

আমরা স্মার্টফোন ইউজাররা প্রায় অনেকেই ট্রুকলার (Truecaller) অ্যাপটির সাথে পরিচিত। আপনি যদি না জেনে থাকেন এটির ব্যাপারে, তাহলে বলি, এই অ্যাপটি মূলত আপনার ফোনের সকল ইনকামিং এবং আউটগোয়িং কল এবং টেক্সট মেসেজ আইডেন্টিফাই করে। যেমন, আপনার ফোনে এইমাত্র আসা টেক্সট মেসেজটি বা কলটি আসলে কে করেছে, সেটি কোনো স্প্যাম কিনা এবং মেসেজটিকে এবং কলটিকে ট্রাস্ট করা আপনার উচিত হবে কিনা ইত্যাদি। কিন্তু ট্রুকলার অ্যাপটি কেউ প্রথম ইনস্টল করলে অনেকসময়ই এই অ্যাপটির একটি ফিচার দেখে একটু অবাক হয়। ফিচারটি হচ্ছে, আপনার ফোনে আসা কলটির নাম্বার যদি আপনার কন্টাক্ট লিস্টে সেভ না করা থাকে, তবুও ট্রুকলার অ্যাপটি আপনাকে বলে দিতে পারবে যে এই কলটি আসলে কে করেছে। তাছাড়া, আপনি নিজেও যদি এমন কোনো নাম্বারে ফোন করেন যেটি আপনার কন্টাক্ট লিস্টে সেভ করা নেই, তাহলেও ট্রুকলার অ্যাপটি আপনাকে সাথে সাথে জানিয়ে দিতে পারে যে আপনি কলটি আসলে কাকে করছেন। ট্রুকলার এর এই ফিচারটির পেছনের প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ এবং স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড, তবে আপনার এই বিষয়ে যদি ধারণা না থাকে, তাহলে এটা আপনার কাছে বেশ অবাক করার মতো ব্যাপার মনে হতে পারে। কিন্তু এটি কিভাবে কাজ করে? আজকে এই সম্পূর্ণ বিষয়টি নিয়েই সহজভাবে ছোট করে আলোচনা করবো।


ট্রুকলার এবং ক্রাউড সোর্সিং

ট্রুকলারের কিভাবে কাজ করে তা জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে ক্রাউড সোর্সিং নিয়ে। কারণ, ট্রুকলারের এই ফিচারতীর পেছনের মূল প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে এই ক্রাউড সোর্সিং প্রযুক্তি। ক্রাউড সোর্সিং বলতে মূলত বোঝায়, ইউজারদের কাছ থেকেই ডেটা কালেক্ট করে সে ডেটাকে ইউজারদের সুবিধার জন্যই ব্যবহার করা। আরেকটু স্পেসিফিকভাবে বলতে হলে, বিপুল পরিমান ইউজার এর থেকে ডেটা কালেক্ট করে সেই ডেটাকে প্রত্যেকটি ইন্ডিভিজুয়াল ইউজারদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করা। এই ক্রাউড সোর্সিং এর সম্ভবত সবথেকে বড় উদাহরণ হচ্ছে ট্রুকলার। কিন্তু এই ক্রাউড সোর্সিং প্রযুক্তি কিন্তু ট্রুকলার একই ব্যবহার করেনা এবং এই প্রযুক্তি ট্রুকলারের তৈরীও নয়। ক্রাউড সোর্সিং এর আরেকটু ভালো উদাহরণ হচ্ছে গুগল ম্যাপসের লাইভ ট্রাফিক আপডেট। কিন্তু এটি কিভাবে কাজ করে?

আপনারা প্রায় সবাই জানেন যে, ট্রুকলার এর বিপুল পরিমান ইউজার রয়েছে। গুগল প্লে স্টোরে ১০০ মিলিয়নেরও বেশিবার ডাউনলোড হয়েছে এই অ্যাপটি। তাহলে নিশ্চই ধারণা করতে পারছেন যে ট্রুকলারের ইউজার এর পরিমান কত বেশি। আর এই প্রত্যেকটি ইউজার এর অবশ্যই একটি স্মার্টফোন আছে এবং স্মার্টফোন যেহেতু আছে, তাই তাদের কন্টাক্ট লিস্টে অনেক রিলেটিভ এবং আরো অনেক মানুষের ফোন নাম্বার তাদের নামসহ সেভও করা আছে। এখানে ট্রুকলার যে কাজটি করে তা হচ্ছে, এই অ্যাপটি যতজন ইউজার এর স্মার্টফোনে ইনস্টল করা আছে, তাদের পারমিশন নিয়ে তাদের প্রত্যেকের কন্টাক্ট লিস্ট ট্রুকলারের নিজের সার্ভারের সাথে সিংক করে নেয়। যার ফলে, ওই ইউজারের কন্টাক্ট লিস্টে কোন কোন নাম্বার আছে এবং ওই নাম্বারটির মালিক (যে নামে কন্টাক্ট সেভ করা আছে) কে এটা ট্রুকলার এর সার্ভার জেনে যায়। এবার চিন্তা করুন, ট্রুকলার যদি তাদের কোটি কোটি ইউজার এর প্রত্যেকের কন্টাক্ট লিস্টের প্রত্যেকের নাম এবং ফোন নাম্বার জেনে যায়, তাহলে সব মিলিয়ে তারা কত বিপুল পরিমান ডেটা পেয়ে যাবে?

এবার এই বিপুল পরিমান ইউজারদের থেকে কালেক্ট করা ডেটাগুলোই তারা প্রত্যেকটি ইন্ডিভিজুয়াল ইউজারদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করে। যখন আপনার ফোনে একটি আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে বা এমন একটি নাম্বার থেকে ফোন আসে যেটি আপনার কন্টাক্ট লিস্টে সেভ করা নেই, তখন এর অনেক বড় একটা চান্স থাকে যে ওই নাম্বারটি পৃথিবীর অন্য কারো ফোনে অবশ্যই সেভ করা আছে তার নামে। আর যেহেতু ট্রুকলার এর ইউজার বেস অনেক বড় তাই এরও অনেক বড় একটা চান্স থেকে যায় যে ওই নাম্বারটি ট্রুকলারের কোটি কোটি ইউজার এর মধ্যে কারো না কারো ফোনে সেভ করা আছে। আর ট্রুকলারের কোনো ইউজারের ফোনে সেই নাম্বারটি সেভ করা আছে মানেই ওই নাম্বারটির মালিকের ডিটেইলস ট্রুকলারের সার্ভারে সিংক করা আছে। আপনার ফোনে যখন এমন একটি নাম্বার থেকে ফোন আসে, তখন আপনার ফোনে যদি ট্রুকলার ইনস্টল করা থাকে, তখন ট্রুকলার সাথে সাথে যে নাম্বার থেকে কল এসেছে ওই নাম্বারটি তাদের সার্ভারে খোঁজা শুরু করবে। যদি ওই নাম্বারটির সাথে ম্যাচ করে নাম্বারটির মালিকের নাম পেয়ে যায় সার্ভারে, তাহলে সাথে সাথে আপনাকে দেখাবে যে কলটি আসলে কে করেছে। একই ব্যাপার ঘটবে যখন আপনি কোনো অজানা নাম্বারে কল করতে যাবেন। আর এই কারণেই ওই ফোন নাম্বারটি আপনার কন্টাক্ট লিস্টে সেভ করা থাকতে হবেনা।

এবার আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, ট্রুকলার স্প্যাম কল এবং স্প্যাম মেসেজ আইডেন্টিফাই করে কিভাবে? এটার প্রক্রিয়াও খুবই সহজ। আপনার ফোনে যদি ট্রুকলার ইনস্টল করা থাকে এবং আপনার ফোনে একটু স্প্যাম কল বা স্প্যাম মেসেজ আসে এবং আপনি শিওর থাকেন যে এটি একটি স্প্যাম, তাহলে আপনি চাইলে সাথে সাথে ট্রুকলারের কাছে ওই নাম্বারটিকে স্প্যাম হিসেবে রিপোর্ট করতে পারবেন। আপনি রিপোর্ট করার পর থেকে পৃথীবিতে ট্রুকলারের অন্যান্য যত ইউজার আছে, তাদের কারো কাছে যদি ওই সেম নাম্বার থেকে কোনো কল বা কোনো টেক্সট মেসেজ যায়, তাহলে ট্রুকলার আগে থেকেই তাকে জানিয়ে দেবে যে এটি একটি স্প্যাম কল বা স্প্যাম মেসেজ। এই একই বিষয়টি আপনার ক্ষেত্রেও ঘটবে।

সুবিধা এবং অসুবিধা

ট্রুকলার এবং ক্রাউড সোর্সিং প্রযুক্তির সুবিধা নিশ্চই আপনি এতক্ষনে বুঝে গিয়েছেন। তাই এটির সুবিধা নতুন করে ব্যাখ্যা করার আর দরকার হবেনা। তবে ক্রাউড সোর্সিং এবং বিশেষ করে শুধুমাত্র ট্রুকলার এর একটি বড় অসুবিধাও আছে। এটি যেহেতু ইউজারদের কন্টাক্ট লিস্ট থেকে ডেটা কালেক্ট করে, তাই ট্রুকলারের ডেটা অধিকাংশ সময় সঠিক হলেও ১০০% সময় সঠিক হয়না। যেমন ধরুন, আমার নাম সিয়াম। এখন আমার নামটি সবার কন্টাক্ট লিস্টে “সিয়াম” নামেই সেভ করা থাকবে এমন কোনো কথা নেই। আমার নামটি অনেকের ফোনে সিয়াম নাম সেভ করা থাকতে পারে, আমার বোনের ফোনে “ভাইয়া” নামে সেভ করা থাকতে পারে, আমার মায়ের ফোনে আমার অন্য কোনো নিকনেমে সেভ করা থাকতে পারে এবং এমন আরো অনেক নামে সেভ করা থাকতে পারে। তখন তারা যদি ট্রুকলার ইউজার হয়, তখন তাদের প্রত্যেকের ফোন আমার নাম্বারের আলাদা আলাদা রকম নাম ট্রুকলারের সার্ভারে সেন্ড করবে। তখন দেখা যাবে আমার নাম বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম দেখাচ্ছে। তবে এই সমস্যাটি আর থাকেনা যদি আপনি ট্রুকলারে আপনার নাম এবং ফোন নাম্বার অনুযায়ী একটি ইউজার আইডি বা ট্রুকলারের ভাষায় কলার আইডি (Caller ID) তৈরী করেন। তখন আপনার নাম্বারটি এবং আপনার অরিজিনাল নামটি ট্রুকলার ভেরিফাইড মার্ক দিয়ে সেভ করে রাখবে এবং ওই একটি নামই সবাইকে দেখাবে।

আর আমার মতে ট্রুকলারের আরেকটি অসুবিধা হচ্ছে, প্রাইভেসি কনসার্ন। আপনি যদি আপনার প্রাইভেসি নিয়ে খুব বেশি খুঁতখুঁতে হন, তাহলে সম্ভবত আপনি চাইবেন না যে আপনার নাম এবং ফোন নাম্বার ট্রুকলার এর সার্ভারে সিংক করা হোক। যদিও, ট্রুকলার এর সার্ভার থেকে আপনার নামসহ ফোন নাম্বার লিক হওয়ার ভয় খুব কম। কারণ, কোনো ট্রুকলার ইউজারই আপনার ফোন নাম্বার না জানলে আপনার নাম বের করতে পারবে না। ট্রুকলার ইউজারদেরকে ফোন নাম্বার ইন্টার করে ওই নাম্বারটির মালিকের নাম বের করার সুযোগ দেয়, কিন্তু নাম ইন্টার করে ইউজারের ফোন নাম্বার বের করার সুযোগ কাউকেই কখনো দেয়না এবং ভবিষ্যতেও কখনো দেবে না। তবুও যদি আপনি প্রাইভেসি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত থাকেন, তাহলে আপনি ট্রুকলারের সার্ভার থেকে আপনার নাম মুছে ফেলতেও পারবেন। এর জন্য আপনাকে শুধুমাত্র https://truecaller.com এ গিয়ে আপনার ফোন নাম্বার সার্চ করে তারপরে আপনার নাম মুছে ফেলার জন্য রিকুয়েস্ট করতে পারবেন যদি আপনার নাম আগে থেকেই সার্ভারে থেকে থাকে। আর হ্যা, আপনি চাইলে ট্রুকলারের নিজের এই ওয়েবসাইট থেকে যেকারো ফোন নাম্বার লিখে তার নামও দেখতে পারবেন যদি তা সার্ভারে এভেইলেবল হয়।

আপনি যদি ট্রুকলার ইউজার না হয়ে থাকেন, ট্রুকলার ডাউনলোড করতে চাইলে নিচের Get it on Google Play বাটনে ক্লিক করবেন।


আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। আশা করি আজকের আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লেগেছে। কোনো ধরণের প্রশ্ন বা মতামত থাকলে অবশ্যই কমেন্ট সেকশনে জানাবেন।

Images: Shutterstock.com

About the author

সিয়াম

Add comment

Categories