সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়াল | এটা কি সম্ভব, কোন ম্যাটেরিয়াল নিজের ক্ষত নিজেই সাড়াতে পাড়বে?

কোন কিছু ভেঙ্গে যাওয়া—একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার, বলতে পারেন ভেঙ্গে যাওয়া আমাদের জীবনেরই একটি অংশ। আপনার স্মার্টফোন হাত থেকে পড়ে গেলে ভেঙ্গে যাবে, আর কারের সাথে কিছু দিয়ে আঁচর লাগলে সুন্দর কালার নষ্ট হয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। সৌভাগ্যবশত, আমাদের স্কিন কেটে গেলে বা হাড় ভেঙ্গে গেলে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের মধ্যেই আবার নিজে নিজেই সেড়ে উঠে। কিন্তু কারে দাগ পড়ে গেলে, সেটা সাড়তে রিপেয়ার শপে নিয়ে যেতে হবে আর হাজারো টাকা ডন্ডি গুনতে হবে। কিন্তু আমাদের শরীর নিজেই নিজের ক্ষত সাড়িয়ে ফেলতে পারে, আপনার শরীরে যদি কোন কাটা দাগ থাকে তো অবশ্যই আপনি আপনার শরীরের সেলফ হিলিং পাওয়ার উপলব্ধি করে থাকবেন। আপনি জেনে হয়তো অবাক হবেন, ২০০০ সালের শুরুর দিক থেকেই বিজ্ঞানীরা সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়াল (Self-healing Materials) তৈরি কাজ শুরু করে দিয়েছে।

হ্যাঁ, আপনি একদম ঠিক শুনছেন, সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়াল — মানে এমন টাইপের মেটাল, প্ল্যাস্টিক, বা যেকোনো দৈনন্দিন জিনিষ, যেটা নিজে থেকেই রিপেয়ার হওয়ার ক্ষমতা রাখে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা সেলফ হিলিং কার, ব্রিজ, বিল্ডীং ইত্যাদি দেখতে পাবো। কিন্তু এই অকল্পনীয় ম্যাটেরিয়াল কীভাবে কাজ করে? — এই আর্টিকেল থেকে আপনি সবকিছু বিস্তারিত জানতে পাড়বেন।

সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়াল

ভেঙ্গে যাওয়া স্মার্টফোন স্ক্রীন বদলানো বা কারের জানালা বা আপনার ঘরের ভেঙ্গে যাওয়া থাই গ্লাস পরিবর্তন করা এক ব্যাপার, আর যদি এগুলো নিজে থেকেই ফিক্স হয়ে যায় সেটা আরেক ব্যাপার। যদিও কোন ম্যাটেরিয়ালই সারাজীবন টিকে থাকে না, অনেকদিন ধরে ব্যবহার করার ফলে মানে বলতে পারেন বার্ধক্যগ্রস্ত হওয়ার কারণে বেশিরভাগ ম্যাটেরিয়াল নষ্ট হয়ে যায়। প্ল্যাস্টিক কয়েক বছর ব্যাবহারের ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ড্যামেজ হয়ে যায় বা আলো কিংবা তাপে অনেক ম্যাটেরিয়ালের লাইফ টাইম শেষ হয়ে যায়। অনেক ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার আর ঘর্ষণের ফলে নষ্ট হয়ে যায়। আর কিছু ম্যাটেরিয়াল অনাকাঙ্ক্ষিত চাপে বা বল প্রয়োগে নষ্ট হয়ে যায়। ম্যাটেরিয়ালে ফাটল ধরে আর সময়ের সাথে সাথে সেই ফাটল বড় হতে হতে ম্যাটেরিয়ালটি ড্যামেজ হয়ে যায়।

 

সকল সমস্যার উপর কাজ করে ম্যাটেরিয়ালকে নিজস্ব ক্ষত পূরণ ক্ষমতা দেওয়া সম্ভব নয়, কেনোনা বয়সে নষ্ট হওয়া, চাপ, কিংবা তাপে নষ্ট হওয়া বা ঘর্ষণে ড্যামেজ হওয়া, এগুলো অনেক জটিল ব্যাপার, যেগুলোর উপর নিয়ন্ত্রন সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা বিশেষ করে ফাটল রোধের উপর কাজ করছেন, আর এক টাইপ আর্টিফিশিয়াল ম্যাটেরিয়াল তৈরির চেষ্টা করছেন, যেটা মানুষের শরীরের মতো আচরণ করবে। কোথাও ফেটে গেলে নিজে থেকেই ডিটেক্ট করতে পাড়বে, তারপরে সেই ক্ষত আরো ছড়িয়ে পড়ে সম্পূর্ণ ম্যাটেরিয়ালকে ড্যামেজ করার পূর্বে নিজে নিজেই ক্ষত স্থান ফিক্স করে ফেলবে। এই টাইপের আর্টিফিশিয়াল ম্যাটেরিয়ালকেই সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়াল বলা হয়।

সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়ালের প্রকারভেদ

প্রথম সেলফ হিলিং স্মার্ট ম্যাটেরিয়াল ছিল পলিমারের তৈরি, যেটা প্ল্যাস্টিকেরই আরেকটি টাইপ। যাই হোক, অনেকভাবে সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা সম্ভব, আমি খুব বেশি সায়েন্সটিফিক বিষয় গুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করবো না, যতোটা সম্ভব সহজ ভাষায় বুঝানোর চেষ্টা করবো। স্মার্ট ম্যাটেরিয়ালের সবচাইতে কমন টাইপটি হচ্ছে, এর মধ্যে মাইক্রো ক্যাপসুল লাগানো থাকে, আর এই ক্যাপসুলের মধ্যে আঠা জাতীয় কেমিক্যাল থাকে, যখনই ম্যাটেরিয়ালটি কোনভাবে ড্যামেজ হয় তখনই ক্যাপসুলটি ফেটে গ্লু বেড়িয়ে আসে আর ফাটল রিপেয়ার করে। কিন্তু এই টাইপের সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়ালের সাথে কিছু অসুবিধা রয়েছে। যেহেতু ম্যাটেরিয়ালে মাইক্রো ক্যাপসুল লাগানো থাকে, আর এটাই ঐ ম্যাটেরিয়ালকে দুর্বল করে, লাইফ টাইম কমে যায়। তাছাড়া মাইক্রো ক্যাপসুল কেবল একবারই ব্যবহার হতে পারে, একবার ফাটল সাড়ার পরে দ্বিতীয়বার ফাটল ধরলে সেটা আর রিপেয়ার করা সম্ভব হবে না। কেনোনা ম্যাটেরিয়ালে ক্যাপসুল লাগানোর এটা সীমা রয়েছে, আন-লিমিটেড ক্যাপসুল তো আর লাগিয়ে রাখা যাবে না!

 

ম্যাটেরিয়ালের মধ্যে আগে থেকেই হিলিং এজেন্ট লাগিয়ে রাখা সবচাইতে কার্যকারী এবং সাধারণ আইডিয়া, কিন্তু উপরের প্যারাগ্রাফেই বললাম, এতে সমস্যাও রয়েছে। যাই হোক, মানুষের স্কিন কিন্তু অন্যভাবে কাজ করে। আমাদের শরীরের মধ্যে অসাধারণভাবে রসনালী থাকে, যেটা অক্সিজেন এবং রক্ত পরিবহন করে স্কিন রিপেয়ার করে। যদি স্কিনের কোথাও সমস্যা হয়, আমাদের শরীর থেকে এক্সট্রা রক্ত সেখানে পাম্প করে ড্যামেজ রিপেয়ার করার চেষ্টা করা হয়, কেবল মাত্র যখন স্কিন ড্যামেজ হয় ঠিক তখনই রক্ত পাম্প করে, এর আগে কিন্তু নয়। কিছু ম্যাটেরিয়াল ঠিক এভাবেই তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যেটা মানুষের শরীর স্টাইলে নিজেকে রিপেয়ার করবে। ম্যাটেরিয়ালের মধ্যে অত্যন্ত পাতলা সংবহনতান্ত্রিক টিউব দ্বারা নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়, যেটা মানুষের চুলের চাইতেও সামান্য পাতলা, এবং এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে প্রয়োজনে এটি হিলিং এজেন্ট মানে গ্লু ফাটল স্থানে পৌছাতে পারে। টিউব গুলো সর্বদা প্রেসারের মধ্যেই থাকবে, যখন কোন ফাটল তৈরি হবে প্রেসার রিলিজ হয়ে যাবে এবং হিলিং গ্লু এসে ঐ স্থানটি রিপেয়ার করে দেবে। তবে এই রিপেয়ার দ্রুত সম্ভব হবে না, কেনোনা রিপেয়ার করা কেমিক্যালকে টিউব বয়ে ঐ জায়গাতে পৌছাতে হবে। তাই যদি কোন ফাটল অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পরে সেটা এই টাইপের হিলিং টেকনোলজিতে কাজ হবে না। তবে যদি ফাটল ধিরে ধিরে ছড়ায়, সেক্ষেত্রে এই টেকনিক কাজে দেবে।

আরেক টাইপের ম্যাটেরিয়াল রয়েছে যেটাকে আকৃতি স্মারক ম্যাটেরিয়াল বলতে পারেন। সহজভাবে বলতে গেলে মেয়েদের চুল বাঁধার রাবার, যেটা টেনে লম্বা করে কাজে লাগাতে পাড়বেন, কিন্তু ছেড়ে দিলে আবার আগের আকৃতিতেই ফেরত আসে, একেই সেপ মেমোরি ম্যাটেরিয়াল বা আকৃতি স্মারক ম্যাটেরিয়াল বলতে পারেন। এখন আকৃতি স্মারক ম্যাটেরিয়াল তাপ, চাপ বা যেকোনো এনার্জি থেকে আগের আকৃতিতে সহজেই ফেরত আসতে পারে। যদি সেলফ হিলিং সেপ মেমোরি ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা হয়, যেখানে ড্যামেজ হবে সেখানে কোনভাবে তাপ প্রয়োগ করলেই আবার আগের অবস্থানে ফেরত চলে আসবে। তো ম্যাটেরিয়ালের মধ্যে টিউব দ্বারা পলিমার গ্লু না পরিচালনা করে, যদি ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মতো লাইট মানে টিউব দ্বারা লেজার লাইট পরিবহন করানো হয়, সহজেই ফাটলে তাপ সরবরাহ করানো যাবে এবং ড্যামেজ রিপেয়ার করা সম্ভব হবে।

ব্যবহার

সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়াল বা স্মার্ট ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার কল্পনা করা খুব একটা মুশকিলের কাজ নয়, আমি যদি এই প্যারাগ্রাফ নাও লিখতাম, তারপরেও হয়তো আপনি এর ব্যবহার কল্পনা করতে পারতেন। এই টাইপের স্মার্ট ম্যাটেরিয়াল প্রায় যেকোনো কাজেই ব্যবহার করা যাবে। চিন্তা করে দেখুন আপনার ফোনের কথা, যেটাতে আঁচর পড়ার ভয়ে আপনি কতো মোটামোটা কভার পড়িয়ে রাখেন! যদি সেখানে এই টাইপের ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয় সহজেই যেকোনো আঁচর স্বয়ংক্রিয়ভাবে গায়েব করে ফেলবে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমরা ভিন গ্রহে বসবাসের উদ্দেশ্যে বা পরীক্ষামূলক কাজে ভ্রমন করতে যাবো, যেখানে স্পেস শিপে সামান্য ড্যামেজ ধীরেধীরে অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, তো সেখানে যদি সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয় যেটা নিজে থেকেই রিপেয়ার হতে পারে, তো যতো দুত সম্ভব ড্যামেজ সমস্যা কাটানো যাবে।

তাছাড়া ব্রিজ থেকে শুরু করে বিল্ডীং পর্যন্ত সমস্ত কিছুতে এই টাইপের ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা যাবে। প্রত্যেকটি জিনিষকে অনেক বেশি গুনে দীর্ঘস্থায়ী বানানো সম্ভব হবে। সেলফ হিলিং পেইন্ট ব্যবহার করে বাড়ির দেওয়াল বা কার রঙ করা হবে, এতে আচরের আর কোনই ভয় থাকবে না। বাড়ির জানালা ভেঙ্গে গেলেও সেটা আবার আগের অবস্থানে ফেরত আসবে। প্র্যাকটিক্যাভাবে যদি এই টাইপ ম্যাটেরিয়াল সম্পূর্ণই ব্যাস্তব করা যায়, অনেক অ্যাপ্লিকেশনও বেড় হয়ে যাবে।


সত্যিই সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়াল বিশাল এবং স্মরণীয় পরিবর্তন নিয়ে আসবে, আর ভবিষ্যতে হয়তো প্রত্যেকটি স্থানে এই টেকনোলজি স্থান দখল করে নেবে। আশা করছি আজকের আর্টিকেল থেকে আপনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গুলো জেনেছেন, এই আবিষ্কার সম্পর্কে আপনার মতামত আমাদের নিচে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু!

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories