অ্যাপেলের নতুন ফেস আইডি কিভাবে কাজ করে? — বিস্তারিত!

কয়েকদিন আগে অ্যাপেল তিনটি নতুন আইফোন উন্মুক্ত করেছে, আইফোন ৮, আইফোন ৮ প্লাস, এবং আইফোন ১০। আইফোন ১০ এ নতুন এক ফেস রিকগনিশন সিস্টেম উন্নতি করা হয়েছে, অ্যাপেল যার নাম দিয়েছে ফেস আইডি। ফেস আইডি দিয়ে অ্যাপেল তাদের আইফোন ১০ মডেলে ট্যাচ আইডিকে রিপ্লেস করে দিয়েছে। এই ব্যাপারে অনেকে অনেক মতামত প্রকাশ করছেন, বলতে পারেন ইন্টারনেট এ সমালোচনায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে। কেউ বলে এটি নতুন টেক, আবার কেউ বলে ট্যাচ আইডি বাদ দেওয়া অ্যাপেলের সবচাইতে বাজে সিদ্ধান্ত। যাই হোক, আমরা সেই সমালোচনা এখানে চালু করতে যাবো না, আমরা এই আর্টিকেলে জানবো, অ্যাপেলের নতুন ফেস আইডি কিভাবে কাজ করে? দেখুন ফেস আইডি নতুন কোন টেকনোলজি নয়, এমনকি কয়েক বছরের ইতিহাস থেকে অ্যাপেল নতুন কোন টেকের সাথে আমাদের পরিচয়ই করিয়ে দিতে পারে নি। এখানে ফেস আইডি টেকনোলজি নতুন না হলেও অ্যাপেল এখানে কিছু নতুন বিষয় যুক্ত করে দিয়েছে, আর যেটার সম্পর্কে অবশ্যই আপনার জানা প্রয়োজনীয়।

প্রথমেই বলে রাখি, ফেস আইডি হলো এমন এক সিস্টেম, যেটা আপনার ফোন আনলক করতে আপনাকে সাহায্য করে। আপনি ফোনের দিকে তাকাতেই ফোন আনলক হয়ে যায়। তত্ত্বটি শুনতে নিঃসন্দেহে চমৎকার, তাই না?  কিন্তু এটি কিভাবে কাজ করে? চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক…


ফেস আইডি কিভাবে কাজ করে?

ফেস আইডি কাজ করার জন্য যেসকল যন্ত্রাংশের সাহায্যের প্রয়োজন, সেই যন্ত্রাংশ গুলো ফোনের উপরের দিকে রয়েছে। সাধারণ ফোনের উপরদিকে সামনের ক্যামেরা, স্পীকার, প্রক্সিমিটি সেন্সর, অ্যাম্বিয়েন্ট লাইট সেন্সর তো থাকেই, কিন্তু অ্যাপেল এখানে আরো কিছু সেন্সর যুক্ত করে দিয়েছে, যেমন- ইনফ্রারেড ক্যামেরা, ফ্লোড ইল্যুমিনেটর, এবং ডট প্রোজেক্টর। আর এই সম্পূর্ণ সিস্টেমকে অ্যাপেল নাম দিয়েছে “ট্রু ডেফথ ক্যামেরা সিস্টেম”।

তো সর্ব প্রথমে কি হয়, যখন আপনি আপনার ফেস দেখিয়ে ফোন আনলক করার চেষ্টা করেন? প্রথমে অবশ্যই আপনার চোখ খোলা থাকতে হবে এবং ফ্লোড ইল্যুমিনেটর আপনার ফেসে আলো ছুঁড়ে মারে। এতে ইনফ্রারেড লাইট বীম সেন্ড করা হয়, যেটা আমরা মানুষেরা চোখে দেখতে পারিনা। তো এই লাইট আপনার ফেসের অবস্থান নির্ণয় করে নেওয়ার পরে পরবর্তী কাজ শুরু করে ডট প্রোজেক্টর। ডট প্রোজেক্টর আপনার ফেসের উপর ইনফ্রারেড ৩০,০০০ ডট তৈরি করে এবং আপনার ফেসের একটি ইউনিক ৩ডি ম্যাপ তৈরি করে। যেহেতু এই প্রসেস ইনফ্রারেড টেকনোলজির উপর কাজ করে, তাই লো লাইট বা অন্ধকারেও এটি সমস্যা ছাড়ায় কাজ করতে পারে। এবার ফোনের সামনের উপরে থাকা ইনফ্রারেড ক্যামেরা ডট প্যাটার্নকে ক্যাপচার করে এবং আপনার ফেসের একটি ম্যাথমেটিক্যাল মডেল তৈরি করে। যখন আপনি ফোন আনলক করার জন্য ফোনের দিকে তাকান, আপনার ডিভাইজ আবার আপনার ফোনের ম্যাথমেটিক্যাল মডেল তৈরি করে এবং পূর্বের মডেলটির সাথে ম্যাচ করানোর চেষ্টা করে। যদি ডিভাইজটি পূর্বের ফেসের সাথে আপনার ফেস ম্যাচ করাতে পারে তবেই আপনার ফোন আনলক হয়ে যায় এবং আপনি যেকোনো অ্যাকশন নিতে পারেন। এই সম্পূর্ণ জবকে সম্ভব করতে অনেক প্রসেস প্রয়োজনীয় হয়, কিন্তু অ্যাপেল বলেছে এই সম্পূর্ণ প্রসেস একদম রিয়াল টাইমের উপর হয়, তাই যতো গুলো প্রসেসই ভেতরে থাকুক না কেন, আপনার চিন্তার কোন কারণ নেই।

ফেস আইডি কাজ করানোর জন্য অনেক সেন্সর একত্রে কাজ করে গেলেও এই সিস্টেমটির মেরুদন্ড কিন্তু ফোনের ভেতরের দিকে রয়েছে—অ্যাপেলের এ১১ ব্যায়োনিক চিপ; যেটি একটি ৬৪-বিট সিপিইউ সাথে ৬টি কোর রয়েছে, ২টি কোর হাই পারফর্মেন্সের জন্য এবং চারটি কোর পাওয়ার সেভিং করার জন্য। যাই হোক, এটা কোন স্পেশাল ব্যাপার নয়, স্পেশাল ফিচার হচ্ছে এর মধ্যে থাকা নিউরাল হার্ডওয়্যার।

এই প্রসেসর সেকেন্ডে ৬০০ বিলিয়ন নিউরাল প্রসেস চালাতে পারে এবং মেশিন লার্নিং টেকনোলজির সাহায্যে ফেস আইডি’কে নতুন টেকে চালাতে সাহায্য করে। এই সিস্টেমের এটাই সবচাইতে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, এটা শুধু আপনার ফেস চিনতে পারে সেটা কিন্তু নয়, বরং সময়ের পরিবর্তনের সাথে এটি আপনার ফেসের পরিবর্তন গুলোকেও বুঝতে পারে। ফলে আপনি ফেসে চশমা পড়ে থাকে, মাথায় টুপি দিয়ে থাকেন, এমনকি চুলের স্টাইল পরিবর্তন করার পরেও নিউরাল ইঞ্জিন সিস্টেম আপনার ফেস চিনতে পারে। আর অ্যাপেলের দাবী অনুসারে আপনার ফেসের ডাটা গুলো এনক্রিপটেড করিয়ে এ১১ চিপের মধ্যে লোকালভাবে সংরক্ষিত রাখা হয়, ক্লাউডে রাখা হয় না যাতে কোন হ্যাকিং রিস্ক না থাকে।

ফেস আইডি কতোটা সিকিউর?

অ্যাপেলের অনুসারে তাদের এই ফেস আইডি কমপ্লিট সিস্টেমকে বোকা বানানো এতোটা সহজ কাজ নয়, এতে ট্রু ডেফথ ক্যামেরা সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে, তাই হ্যাকার কোন ব্যাক্তির ছবি দেখিয়ে কিংবা ৩ডি মাস্ক দেখিয়ে ফোন আনলক করতে পারবে না। যদিও এখনো ৩ডি মাস্ক সেভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু তারপরেও ইনফ্রারেড লাইট মানুষের আসল ফেস সঠিকভাবে চিনতে সক্ষম, এই লাইট ফেসের ভেতর পর্যন্ত যেতে পারে, আর ফেসের হুবহু ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে মাস্ক তৈরি করা অনেকটা অসম্ভব।

তারপরেও ট্রু ডেফথ ক্যামেরা সিস্টেমকে বোকা বানানো এতোটা সহজ টাস্ক না। তাছাড়া ট্যাচ আইডি বা ফিঙ্গার প্রিন্টের মতো ফেস আইডির ম্যাথমেটিক্যাল মডেল চিপের মধ্যে এনক্রিপটেড অবস্থায় এমন জায়গায় থাকে যেটা অ্যাক্সেস করা সম্ভব নয়, কোন অ্যাপস সেই ডাটা অ্যাক্সেস করতে পারবে না, এবং পূর্বেই বলেছি এই ডাটা আই ক্লাউডের সাথেও সিঙ্ক হবে না। হ্যাকার কোন ভাবেই ঐ ডাটা অ্যাক্সেস করতে পারবে না। তাছাড়া অ্যাপেলের অনুসারে ফেস আইডির এরর রেট ১০ লাখে ১ বার আর ট্যাচ আইডির এরর রেট ৫০ হাজারে ১ বার। তাই অ্যাপেলের অনুসারে অবশ্যই এটি ফিঙ্গার প্রিন্ট থেকে অনেকবেশি সিকিউর সিস্টেম।

অবশ্যই এটা প্রথমবারের মতো নয়, যখন স্মার্টফোনে প্রথম ফেস আইডি টেক দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আইফোন ১০ অবশ্যই প্রথম ফোন যেটাতে ফেস আইডি সিস্টেম সম্পূর্ণ করার জন্য ৩ডি মডেল টেক এবং নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহৃত হয়েছে। আপনারা হয়তো দেখেছেন অ্যাপেল ইভেন্টে ফেস আইডি ফোন আনলক করতে ব্যর্থ হয়েছিলো, কিন্তু সেটার কারণ হচ্ছে আলাদা মানুষেরা ফোনটির দিকে তাকিয়েছিল যার ফলে ফোনটি তাদের ফেস চেনার চেষ্টা করে, কিন্তু বারবার ভুল হওয়ার ফেস আইডি লক হয়ে যায় এবং পাসওয়ার্ড প্রয়োজনীয় হয়। যেমনটা ফিঙ্গার প্রিন্টের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, ৪ বার বা অধিকবার ভুল ফিঙ্গার দিলে ফোন আনলক হওয়ার জন্য পাসওয়ার্ড চাওয়া হয়, তো টেকনিক্যালি এটি কোন সিস্টেম সমস্যা নয়। তাহলে কি ভবিষ্যতে ফিঙ্গার প্রিন্ট রিপ্লেস হয়ে যাবে? এই উত্তর নির্ভর করবে আমাদের চাহিদা এবং ব্যাবহারের সুবিধার উপর। আর অ্যাপেলের মতে ফেস আইডিই তো বেস্ট!

তো আপনার কি মতামত? অবশ্যই আমাদের নিচে কমেন্ট করে জানান

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories