কিভাবে একটি মাইক্রো এসডি কার্ড ৪০০ জিবি পর্যন্ত ডাটা ধারণ করতে পারে?

আজকের দিনে কম্পিউটিং আমাদের কাছে সবচাইতে প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে পরিনত হয়েছে। মিনি কম্পিউটিং ডিভাইজ যেমন- স্মার্টফোন; আমাদের কম্পিউটিং চাহিদাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে কম্পিউটিং নিয়ে কথা আসে, অবশ্যই ডাটা স্টোর আর প্রসেস করার টার্মটি চলেই আসে। যদি ডাটা স্টোরেজ নিয়ে আরো গভীর আলোকপাত করতে যাই, অবশ্যই এখানে তুলনা মুলক উন্নতি দেখতে পাওয়া যায়। মাত্র ১৫-২০ বছর আগের কয়েক মেগাবাইট সাইজের হার্ড ড্রাইভ গুলোর ফিজিক্যাল সাইজ একটি মিনি কারের সমান ছিল। কিন্তু আজ সামান্য একটা কৌটার সমান সাইজের জায়গায় কয়েক টেরাবাইট ডাটা আটিয়ে ফেলার টেকনোলজি আমরা আবিষ্কার করে ফেলেছি। হার্ড ড্রাইভের পরে আমাদের সামনে এসেছে ফ্ল্যাশ নির্ভর স্টোরেজ সলিউসন, যেমন- এসএসডি বা মাইক্রো এসডি কার্ড, ফ্ল্যাশ ড্রাইভ, ইত্যাদি। হার্ড ড্রাইভ বা এসএসডি‘তে কয়েক শত বা কয়েক হাজার গিগাবাইট সহজেই আঁটানো সম্ভব, যেহেতু এই ড্রাইভ গুলোর ফিজিক্যাল আকার অনেক বড় হয়, মেমোরি কার্ডের তুলনায়। কিন্তু মাইক্রো এসডি কার্ডে কয়েকশত জিবি আঁটানো এতোটাও সহজ ব্যাপার নয়।

সম্প্রতি, এসডি কার্ড নির্মাতা কোম্পানি সানডিস্ক (SanDisk) তাদের নতুন ৪০০জিবি ক্যাপাসিটির একটি মাইক্রো এসডি কার্ড ঘোষণা করেছে। চিন্তা করে দেখেছেন, আপনার নখের সমান জায়গাতে ৪০০জিবি ডাটা অর্থাৎ প্রায় ৪০ ঘণ্টার ক্যামেরা র‍্য ১০৮০পি ভিডিও আঁটানো সম্ভব। কিন্তু আগের দিনে যেখানে কেবল মাত্র কয়েক গিগাবাইট পর্যন্তই ডাটা স্টোর করা যেতো, সেই সেম সাইজের মধ্যে কিভাবে ৪০০জিবি ডাটা স্টোর করানো সম্ভব করেছে সানডিস্ক? এর আগে স্যামসাং ২৫৬ জিবি ক্যাপাসিটি ওয়ালা  ইউএফএস কার্ড ঘোষণা করেছিলো, কিন্তু কিভাবে এতো ডাটা আটাচ্ছে এরা? এই আর্টিকেলে এই বিষয়টিই বিশ্লেষণ করতে চলেছি…

৪০০জিবি’র এসডি কার্ড

এসডি কার্ড থেকে শুরু করে যতোগুলো ফ্ল্যাশ নির্ভর স্টোরেজ রয়েছে, এমনকি কম্পিউটার র‍্যাম পর্যন্ত ট্র্যানজিস্টরে ডাটা সংরক্ষিত করে। অর্থাৎ কোন ফ্ল্যাশ মেমোরিতে যতোবেশি ক্যাপাসিটি দেওয়া হবে, মানে এতে ততোবেশি ফিজিক্যাল ট্র্যানজিসটর আটাতে হবে। স্টোরেজ নির্মাতা কোম্পানিরা তাদের ড্রাইভের সিঙ্গেল ট্র্যানজিসটর সাইজ কমিয়ে এক জায়গার মধ্যে আরো অনেক ট্র্যানজিস্টর আটিয়ে দেয়, এতে ড্রাইভের সাইজ তো একই থাকে, কিন্তু ক্যাপাসিটি বেড়ে যায়। তবে এখানে একটি প্রশ্ন রয়েছে, সেম সাইজে কতো গুলো পর্যন্ত ট্র্যানজিস্টর লাগানো সম্ভব, বা সর্বউচ্চ ক্যাপাসিটি লিমিট কতো হতে পারে? আপনি যতোই ট্র্যানজিস্টর সাইজ কমান না কেন, অবশ্যই একটি লিমিট রয়েছে, তাই না? ২০১৩ সালের দিকে ট্র্যানজিস্টর সাইজ ছিল ১৯ ন্যানোমিটার, এই ট্র্যানজিস্টর গুলোকে এক সাড়িতে বসিয়ে কেবল ৮ গিগাবাইট পর্যন্তই ক্যাপাসিটি পাওয়া সম্ভব ছিল মাইক্রো এসডি’র ক্ষেত্রে। তাহলে আরো ক্যাপাসিটি কিভাবে বাড়ানো সম্ভব হলো?

একই সাইজের এসডি কার্ড বা ড্রাইভে আরোবেশি ক্যাপাসিটি আঁটানোর জন্য ৩ডি ন্যান্ড ফ্ল্যাশ মেমোরি টেকনোলজিকে ব্যবহার করা হয়। কল্পনা করুণ আপনার কাছে ১ কাঠা জমি রয়েছে যেখানে একটি বাড়ি রয়েছে এবং বাড়িতে মোট ৪টি ঘর রয়েছে। এখন যদি আরোবেশি ঘর তৈরি করতে চান অবশ্যই আরোবেশি জায়গার প্রয়োজন হবে? তাই না? কিন্তু আরেকভাবেও একই জায়গার মধ্যে আরো ঘর তৈরি করা সম্ভব। আর এভাবেই আজকের সকল মডার্ন বিল্ডিং গুলো কাজ করে থাকে। একই জায়গার মধ্যে উঁচু করে তালার উপর তালা উঠিয়ে অনেক ঘর তৈরি করা সম্ভব। এতে জায়গার সাইজ তো একই থাকলো, কিন্তু মানুষ বসবাসের ক্যাপাসিটি অনেক বেড়ে গেলো। ২ডি এবং ৩ডি ফ্ল্যাশের মধ্যে এটিই পার্থক্য। ২ডি ফ্ল্যাশ মেমোরি’তে কোন জায়গার মধ্যে ব্যাস চিপ বসানো থাকে, কিন্তু ৩ডি ফ্ল্যাশ মেমোরিতে এই ফ্ল্যাশের লেয়ার তৈরি করে সেটাকে উলম্ব আকারে বাড়িয়ে সেখানে আরো ১ বা ০ স্টোর করার ব্যবস্থা করানো হয়। যেহেতু উচুভাবে লেয়ার তৈরি করা হয়, তাই স্টোরেজ ড্রাইভের আকার বৃদ্ধি পায় না, একই জায়গা বা সেম সাইজের মধ্যে কয়েক টেরাবাইট আঁটানো সম্ভব হয়।

এভাবেই ট্র্যানজিস্টর গুলোকে লেয়ার বাই লেয়ার সাজিয়ে ৩২জিবি, ৬৪জিবি, ১২৮জিবি ইত্যাদি মাইক্রো এসডি কার্ড তৈরি করা হয়। ১৯ ন্যানোমিটারের ক্ষেত্রে ৬৪জিবি ক্যাপাসিটি ওয়ালা মেমোরি কার্ড বানাতে একই রকম ৮টি লেয়ারের প্রয়োজন পড়বে। আর একই সাইজে ৪০০ জিবি আটাতে গেলে ৫০টি লেয়ারের প্রয়োজন পড়বে। এখন কার্ডের সাইজ তো বাড়ানো সম্ভব নয়, কেনোনা কার্ডের সাইজ বাড়াতে গেলে ডিভাইজ গুলোর স্লোট সাইজও বাড়াতে হবে, যেখানে আমরা দিনদিন মাইক্রো ইলেকট্রনিক্সের দিকে ফোকাস করছি, সেখানে সাইজ বাড়ানোর তো প্রশ্নই  আসে না।

সানডিস্ক এখানে ট্র্যানজিস্টর সাইজ আরো কমিয়ে ফেলেছে, মাত্র ১০ ন্যানোমিটারে নিয়ে চলে এসেছে। অর্থাৎ ১০ ন্যানোমিটারে প্রত্যেক লেয়ারে ১৬জিবি করে ডাটা আঁটানো সম্ভব এবং ২৫ লেয়ারেই ৪০০জিবি ক্যাপাসিটি এঁটে যাবে। ২০১৭ সালে এসে যখন আমাদের কাছে ১০ ন্যানোমিটারের ট্র্যানজিস্টর রয়েছে, তো সেদিন খুব দূরে নয়, যখন আমরা ৫ ন্যানোমিটার ট্র্যানজিস্টর দেখতে পাবো। আর তখন আর গিগাবাইট নয়, টেরাবাইট ক্যাপাসিটি ওয়ালা মাইক্রো এসডি কার্ড বানানো সম্ভব হবে। তো আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই, আরো ক্ষুদ্র ট্র্যানজিস্টর সাইজ সাথে ৩ডি ন্যান্ড ফ্ল্যাশ মেমোরি টেকনোলজিতে এই ৪০০জিবি ক্যাপাসিটির মাইক্রো এসডি কার্ডকে সানডিস্ক সম্ভব করেছে।

সানডিস্কের এই নতুন ৪০০জিবি মাইক্রো এসডি কার্ড, সর্বউচ্চ ১০০ মেগাবাইট/সেকেন্ড পর্যন্ত ট্র্যান্সফার স্পীড দিতে সক্ষম। মানে এই এসডি কার্ড প্রত্যেক মিনিটে ১,২০০ ফটো ট্র্যান্সফার করতে পারবে। ২৫৬ জিবি আইফোন থেকে এর ক্যাপাসিটি প্রায় দিগুন। এতে ৪০ ঘন্টার র‍্যো ১০৮০পি ভিডিও লোড করা যাবে, সাথে ৬৭,৭৯৬টি স্যামসাং গালাক্সি এস৭ থেকে নেওয়া ফটো স্টোর করা যাবে, অথবা আপনি নিজেই চিন্তা করে দেখুন, ৪০০জিবি স্পেসে আপনি কি কি রাখতে পারবেন!

৩ডি ন্যান্ড এর ফিউচার ড্রাইভ

ফ্ল্যাশ নির্মাতা কোম্পানি’রা বছরের পর বছর ধরে এমনই কোন টেকনিকের পেছনে ছুটছিলেন, যেখানে একই সাইজের ড্রাইভে আরো বেশি ডাটা আঁটানো সম্ভব হয়। তাই ফ্ল্যাশ টেকনোলজি’তে এই মাইক্রোস্কোপিক লেয়ার তৈরি করা হয়েছে আর বেশি ডাটা আঁটানোর লক্ষে। শুধু যে, একই জায়গার মধ্যে বেশি ডাটা স্টোর করা যাবে, সেটা কিন্তু নয়, লেয়ার ফ্ল্যাশ স্টোরেজ আর্কিটেকচারের আরো অনেক সুবিধা রয়েছে। লেয়ার বাই লেয়ার আর্কিটেকচারে ডাটা রীড রাইট স্পীড বাড়ানো সহ ফ্ল্যাশ সেলের মধ্যে লেটেন্সি কমানো সম্ভব। বিজনেস লেভেল এবং কনজিউমার লেভেল, উভয় লেভেলেই ৩ডি ন্যান্ডের ডিম্যান্ড অনেক বাড়তে চলেছে। বিজনেস গ্রেডে প্রয়োজনীয় হয়, হাই স্পীড প্রসেসিং পাওয়ার সেখানে ৩ডি ন্যান্ড তার লো লেটেন্সি’তে আরমে প্রভাইড করতে পারে। কনজিউমার লেভেলে হাই স্পীড স্টোরেজ, র‍্যাম, এসএসডি’র সাথে এর দামও অনেক কমে যাবে, যেটা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, ভি ন্যান্ডই হলো ফিউচার ফ্ল্যাশ স্ট্যান্ডার্ড!

৩ডি ন্যান্ড স্টোরেজের আমরা কেবল প্রথমের স্টেজে রয়েছি, অবশ্যই সামনের দিকে আরো অনেক উন্নতি লক্ষ্য করতে পারবো। বর্তমানে অনেক ফ্ল্যাশ স্টোরেজ নির্মাতা কোম্পানি ৩ডি ন্যান্ডের উপর কাজ করছে এবং এসএসডি’র রেগুলার সাইজ ২.৫ ইঞ্চির কমিয়ে সেখানে ১০ টেরাবাইট পর্যন্ত ডাটা আঁটানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আপনি নিজেই চিন্তা করে দেখুন, এখনো পর্যন্ত আপনি কেন আগের যুগের হার্ড ড্রাইভকে আপনার কম্পিউটারে রেখেছেন। অবশ্যই এর দুইটি কারণ, প্রথমত, দাম এবং দ্বিতীয়ত ক্যাপাসিটি। কিন্তু যদি মডার্ন এসএসডি গুলো সিঙ্গেল ড্রাইভে অনেক বেশি ক্যাপাসিটি অফার করে কিংবা দাম হার্ড ড্রাইভের মতো হয়ে যায়, তাহলে হার্ড ড্রাইভের যুগ শেষ হয়ে যাবে। হার্ড ড্রাইভ বা মুভিং পার্টস ওয়ালা স্টোরেজ সলিউসন কখনোই ফ্ল্যাশ মেমোরির স্পীড অর্জন করতে পারবে না।

সিলিকনের অনেক গুলো স্তরকে কেটে এই ৩ডি ন্যান্ড ফ্ল্যাশ সেল গুলোকে তৈরি করা হয়, ৩ডি ফ্ল্যাশ মেমোরিতে সাধারণত ৩২ লেয়ারের সেল বসানো থাকে যেখানে সেলের ঘনত্ব অনেক সুগঠিত ভাবে নিয়ন্ত্রন করা হয়, এতে সেলের মধ্যের বাঁধা কমানো সম্ভব হয় এবং ফলে লেটেন্সি কমে যায়। যদি স্টোরেজকে লেয়ার বাই লেয়ার তৈরি না করে একই জায়গার মধ্যে অনেক ক্ষুদ্র করে সেল আঁটানোর চেষ্টা করা হয়, সেক্ষেত্রে মেমোরি স্পীড কমে যাবে এবং পিং রেট বেড়ে যাবে, কেনোনা সেল গুলোর মধ্যে কানেকশন গণ্ডগোল পাকিয়ে যাবে।


তো এই আর্টিকেল থেকে আপনি বিস্তারিত জানলেন, কিভাবে ৩ডি ন্যান্ড স্টোরেজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে একই সাইজে এই দৈত্যাকার ক্যাপাসিটি আঁটানো হয়েছে। যদি কথা বলি এই ধরণের কার্ডের দাম নিয়ে, তো এখানে বলবো, এই প্রযুক্তি সম্পর্কে জেনেই শুধু আমাদের খুশি থাকা দরকার, এই দামে কেনার মতো টাকা অন্তত আমার কাছে নেই! সাথে বেশিরভাগ স্মার্টফোন হয়তো এই কার্ড সমর্থনই করবে না, কেনোনা বেশিরভাগ স্মার্টফোন গুলো ১২৮ থেকে ২৫৬ জিবি পর্যন্ত মেমোরি কার্ড সমর্থন করার জন্য রেটিং করা থাকে। —তো আপনার কি ৪০০জিবি স্পেসেই হবে, নাকি ১টেরাবাইট স্পেস লাগবে? আমাদের নিচে কমেন্ট করে জানান!

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories