ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার কিভাবে কাজ করে? ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার কিভাবে আপনাকে চিনতে পারে?

কোন সিকিউরিটি ব্যাবস্থায় ১০০% নিরাপদ নয় — তালা খুলে ফেলা যায়, সিন্দুক ভেঙ্গে ফেলা যায়, অনলাইন পাসওয়ার্ডের উপর যথেষ্ট সময় আর টেক প্রয়োগ করলে দ্রুত বা দেরীতে সেটাও ক্র্যাক করা সম্ভব। তাহলে কিভাবে কিছু নিরাপদ করা যেতে পারে? ওয়েল, আমাদের কাছে বায়োমেট্রিক সলিউশন রয়েছে, যেমন- ফিঙ্গারপ্রিন্ট, আইরিস স্ক্যান, ফেস স্ক্যান, এবং আরো পার্সোনাল ইনফরমেনশন যেগুলো দ্বারা ডাটা লক করা যেতে পারে। [ফেস, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, পাসওয়ার্ড নাকি পিন? — ফোন লক করার কোনটি সবচাইতে বেস্ট পদ্ধতি?]

পূর্বে পুলিশ স্টেশনে কেবল চোর চামার আর বড় অপরাধীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া হতো, কিন্তু বর্তমানে বহু নিরপরাধ মানুষ প্রতিনিয়ত ফোন আনলক করতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ইউজ করেন। বর্তমান সময়ে সব ক্ষেত্রেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার দেখতে পাওয়া যায়; স্মার্টফোনে, ল্যাপটপে, এটিএম মেশিনে, হাই সিকিউরিটি বিল্ডিং এ, এমনকি সিম কার্ড কিনতে ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার ইউজ করতে হয়!

তো ব্যাপারটা সত্যিই জানা অনেক জরুরী যে এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার কিভাবে কাজ করে? চলুন, বেসিক ব্যাপার গুলো বিস্তারিত ভাবে জেনে নেওয়া যাক!


কেন ফিঙ্গারপ্রিন্ট?

আমি নিশ্চিত যে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট রয়েছে, মানে আঙ্গুলের এক পাশে বিশেষ এক নকশা বা ছাপ রয়েছে। এই ছাপ বিশেষ করে কোন কিছু ধরতে সাহায্য করে এতে হাতে ভালো ঘর্ষণ ক্ষমতা পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের প্রত্যেকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট থাকে আর সেটা মায়ের গর্ভে থাকার ৭ মাস বয়সের মধ্যেই আপনার হাতে অঙ্কিত হয়ে যায়। যদি কোন দুর্ঘটনা না ঘটে তবে সারাজীবনই আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেইম থাকবে! আর যেহেতু এই আঙ্গুলের ছাপ প্রত্যেক মানুষের ইউনিক হয়ে থাকে তাই ছাপের সাহায্যে আপনাকে চিনতে পারা অনেক সহজ কাজে পরিণত হতে পারে।

আপনার ডিএনএ তে থেকে কোড অনুসারে আপনার বা প্রত্যেকটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ সম্পূর্ণই ইউনিক হয়ে থাকে। তাছাড়া মায়ের গর্ভের ভেতরের পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা টাইপের হয়ে থাকে, তাই যমজ ভাই/বোনেরও ফিঙ্গারপ্রিন্ট আলাদা হয়ে থাকে। যদিও এটা সম্ভব কারো আঙ্গুলের ছাপ অন্যের সাথে মিলে যাওয়া, কিন্তু সেটা অনেক দুর্লভ কেস!

যেহেতু ভার্চুয়ালি সকলের আঙ্গুলের ছাপ আলাদা হয়ে থাকে তাই কম্পিউটার সিস্টেমে পাসওয়ার্ড বা পিনের বদলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ইউজ করা অনেক সুবিধার হয়ে যায়। কেনোনা এতে আপনাকে কিছু মনে রাখতে হবে না, পাসওয়ার্ড হিসেবে আপনার নিজেকেই ইউজ করা হচ্ছে এখানে!

ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচায় ও সংরক্ষণ

প্রাথমিক পর্যায়ে দুইটি আলাদা আলাদা পদ্ধতিতে বায়োমেট্রিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট কাজ করে। প্রথম প্রসেসটির নাম Enrollment, যেখানে সিস্টেম ফিঙ্গারপ্রিন্ট থেকে ধারণা অর্জন করে মানে ইউজারের ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যান করে তারপরে সেই প্রিন্টকে ডিজিটাল কোডে এনকোড করে সিকিউরড ডাটাবেজে স্টোর করে। স্ক্যানার বিশেষ করে হাফ সেকেন্ডের ও কম সময়ের মধ্যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট তথ্য প্রথমবার স্ক্যান করে স্টোরড করতে পারে আর পরবর্তী সময়ে ৯৯% সময় সঠিকভাবে ম্যাচ করানোর ক্ষমতা রাখে।

একবার Enrollment প্রসেস শেষ হলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার কাজ করার জন্য রেডি — এবার সঙ্ঘটিত হবে দ্বিতীয় স্টেপ, যেটার নাম Verification, এবার সিস্টেমে যারা আক্সেস পেতে চাইবে তাদের আঙ্গুলকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার এর উপর ধরতে হবে তারপরে রিডারটি আঙ্গুলের ছাপ স্ক্যান করবে ও ডাটাবেজে থাকা ছাপের সাথে মেলানোর চেষ্টা করবে, যদি মিলে যায় তবে সাথে সাথে সিস্টেম আনলক হয়ে যাবে।

১৯০০ সালের দিকে প্রথম অপরাধের তদন্ত করার লক্ষে ফিঙ্গারপ্রিন্টের ব্যবহার শুরু হয়, কিন্তু তখনকার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম সম্পূর্ণই আলাদা ব্যাপার ছিল। একটি আঙ্গুলের ছাপের সাথে আরেকটি আঙ্গুলের ছাপ ম্যানুয়ালভাবে আতশ কাঁচ ব্যবহার করে মেলানোর চেষ্টা করা হতো। প্রথমে ক্রাইম লোকেশন থেকে আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করা হতো তারপরে সন্দেহভাজন কারো আঙ্গুলের সাথে মেলানো হতো। আর ম্যানুয়ালভাবে কারো ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলানো মোটেও সহজ কোন জব নয়, তাই অনেক সময় এই কাজ ফরেনসিক সায়েন্টিস্টরা করে থাকতো!

যখন কম্পিউটার সিস্টেম ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচ করানোর চেষ্টা করে, কম্পিউটারের ভেতরে কিন্তু কোন ছোট মানুষ হাতে করে আতশ কাঁচ নিয়ে বসে থাকেনা। বরং সিস্টেম যেকোনো ফিঙ্গারপ্রিন্টকে হাজারো বা লাখো ফিঙ্গারপ্রিন্টের ডাটাবেজের সাথে ম্যাচ করানোর চেষ্টা করে। এনরোলমেন্ট ও ভেরিফিকেশন সিস্টেমের সময় আঙ্গুলের ছাপে থাকা বিশেষ রেখার একে অপরের থেকে দূরত্ব গুলো মেপে রাখে। রেখা গুলোর দূরত্ব এবং অ্যাঙ্গেল মনে রাখার পরে বিশেষ কম্পিউটার অ্যালগোরিদম ব্যবহার করে এই তথ্য গুলোকে বিশেষ ইউনিক কোডে পরিণত করা হয়। এখন কোন ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচ করানো মানে হচ্ছে স্টোরড থাকা ইউনিক কোড ম্যাচ করানো, ব্যাস কোড ম্যাচ করলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ম্যাচ হয়ে যাবে!

ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার কিভাবে কাজ করে?

পুলিশ স্টেশনে প্রথমে ইঙ্ক প্যাডের উপর আপনার আঙ্গুল রাখতে বলা হয় তারপরে একটি সাদা কাগজের উপরে আঙ্গুলের ছাপ বসাতে বলা হয়। সাদা কাগজের উপরে আঙ্গুলের ইম্প্রেশন গুলোকে জমা করে রাখা হয় এবং পরবর্তীতে কম্পিউটারে ও স্টোরড করা হয়। কিন্তু যখন ফিঙ্গারপ্রিন্ট ইউজ করে কোন বিল্ডিং এর দরজা খুলবেন বা মোবাইলের লক স্ক্রীন আনলক করবেন সেক্ষেত্রে অনেক ফাস্ট ম্যাথড দরকার পড়বে যেটা মিলি-সেকেন্ডের মধ্যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ভেরিফাই করতে সক্ষম হবে! — তাহলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার কিভাবে কাজ করে?

সাধারণত দুই টাইপের ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার দেখতে পাওয়া যায়! একটি হচ্ছে অপটিক্যাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার, যেটা আপনার আঙ্গুলের উপর উজ্জ্বল আলোর বীম ছুড়ে মারে তারপরে ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডারে থাকা একটি ইমেজ সেন্সর আপনার আঙ্গুলের একটি ডিজিটাল ফটো ক্যাপচার করে। আপনার হাত কোন ফটোকপি মেশিনের উপরে রাখলে যা হবে আর কি, সম্পূর্ণ হাতের ছাপ একটি কাগজে ফটোকপি হয়ে বের হয়ে আসবে। ঠিক এভাবেই অপটিক্যাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার গুলো কাজ করে। আপনার আঙ্গুলের ডিজিটাল ফটোগ্রাফ তৈরি করে তারপরে কম্পিউটার সেই ইমেজকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যানালাইজ করে শুধু ফিঙ্গারপ্রিন্ট সিলেক্ট করে তারপরে প্যাটার্ন ম্যাচিং সফটওয়্যার সেই ফিঙ্গারপ্রিন্টটিকে ডিজিটাল কোডে পরিণত করে। আর তারপরের প্রসেস তো উপরেই বর্ণিত করলাম!

আরেক টাইপের ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার কে ক্যাপাসিটিভ স্ক্যানার বলা হয়। এই টাইপের স্ক্যানার আপনার আঙ্গুলের ছাপ ইলেকট্রিক্যালভাবে ক্যাপচার করে। ক্যাপাসিটিভ স্ক্যানারের সার্ফেসে যখন আঙ্গুল রাখা হয় এটি আঙ্গুলের রেখা থেকে সহজেই আঙ্গুলের ছাপের একটি ইমেজ তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে স্মার্টফোনের পেছনের দিকে বা হোম বাটনে ইন্সটল থাকা রিডার গুলো ক্যাপাসিটিভ রিডার হয়ে থাকে। বর্তমানে মডার্ন স্মার্টফোন গুলোতে ইন-ডিসপ্লে ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার ইউজ করা হয়, যেটা অপটিক্যাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারের উদাহরণ। তবে কিছু আরো উন্নত ডিভাইজে আলট্রাসনিক সাউন্ড ইউজ করেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট ক্যাপচার করা হয়!

ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারের ব্যবহার

দুনিয়ার সকল বায়োমেট্রিক সিকিউরিটির মধ্যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সিকিউরিটি সবচাইতে বহুল ব্যবহৃত বায়োমেট্রিক সিকিউরিটি সিস্টেম। আর এর জনপ্রিয়তার কারণ ও রয়েছে। বর্তমানে আমরা সকল ডাটা গুলোকে কম্পিউটারে স্টোর করছি। আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যেকোনো প্রোফাইল কম্পিউটারে স্টোরড থাকে। কেউ আপনার পিন বা পাসওয়ার্ড জেনে গেলে দূর লোকেশন থেকেই সহজেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা বের করে নিতে পারবে।

তবে বর্তমানে সেলফোন ও ল্যাপটপ এবং এরকম আরো ডিভাইজ গুলোতে বায়োমেট্রিক সিকিউরিটি সিস্টেম ব্যবহারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক ব্যাংকের অ্যাপে সিকিউরিটি ফিচার হিসেবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট অ্যাড করা হয়েছে। দ্রুতই হয়তো এটিএম মেশিন গুলোতেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার ইউজ করতে শুরু হয়ে যাবে। এমনকি হতে পারে কারের চাবির বদলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার লাগানো থাকবে।


একদম আর্টিকেলের শুরুতেই বলেছি কোন সিকিউরিটি সিস্টেমই ১০০% নিরাপদ নয়, বায়োমেট্রিক সিস্টেমেরও অপকারিতা রয়েছে, অনেক বিশেষজ্ঞগনের মতে বায়োমেট্রিক সিকিউরিটি সিস্টেম থেকে পাসওয়ার্ড/পিন বেশি নিরাপদ। কিন্তু অপরদিকে বায়োমেট্রিক সিকিউরিটি সিস্টেমের সুবিধা গুলোকেও ভুলে গেলে কিন্তু চলবে না। তো অবশেষে আপনি বিস্তারিত জানতে পারলেন, কিভাবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার কাজ করে!

Image Credit: Shutterstock

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories