আলো কি? | এটি কি বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে আশ্চর্যজনক জিনিষ?

আপনি কি অন্ধকারকে ভয় পান? যদি আজকের দিনেও এই ভয় আপনার মনে বসে থাকে, তবে অবাক হবার কিছু নেই। কেনোনা আমরা মানুষেরা এক এমন প্রকারের জীব, যা আমরা আলোতে থাকতে বেশি পছন্দ করি, তৃপ্তি পাই, ভয় দূর হয়। সুতরাং আলো (লাইট) আমাদের জীবনে অত্যাবশ্যকরূপে প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই লাইট সম্পর্কে জানার জন্য আপনি কতটা সময় ব্যয় করেছেন এই পর্যন্ত? কীভাবে লাইট বিভিন্ন কালারকে আমাদের চোখে ফুটিয়ে তোলে? এটি কি কণা আকারে ভ্রমন করে, না তরঙ্গ আকারে? কেন এটি এতো দ্রুতগামী হয়ে থাকে? চলুন এই সকল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি—চলুন আজ আলোর উপর কিছু আলোকপাত করা যাক 🙂

আলো বা লাইট কি?

যখন আপনি বা আমি ছোট ছিলাম, তখন এই প্রশ্নের একটি সহজ উত্তর ছিল আমাদের মনে। আমরা মনে করতাম অন্ধকার পৃথিবীকে আলোকিত করতে আমাদের ঘরের দেওয়ালে অবস্থিত সুইচই যথেষ্ট। জাস্ট সুইচ অন করলেই আলো আর অফ করলেই অন্ধকার! কিন্তু যতই আমরা বড় হতে থাকি তোতোই এই জিনিসটা বুঝতে আর দূরে থাকে না, যে আলো আমাদের ভাবনার চাইতে আরো অনেক জটিল ব্যাপার।

প্রায় ১৪৯ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পরে সূর্য থেকে লাইট আমাদের পৃথিবীতে প্রবেশ করে। লাইট প্রতি সেকেন্ডে ১৮৬,০০০ মাইল বা ৩০০,০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পারে। অর্থাৎ আপনি এখন যে আলো দেখতে পাচ্ছেন তা সূর্য থেকে প্রায় ৮ মিনিট আগে এসেছিলো। ব্যস্তবিকভাবে দেখতে গেলে আপনার এককাপ কফি বানাতে বানাতে লাইট সূর্য থেকে পৃথিবীতে চলে আসার ক্ষমতা রাখে।

আলো এক প্রকারের শক্তি

আমরা সবাই জানি যে, সূর্য হল একটি নিউক্লিয়ার আগুনের গোলা, যা এর চারিদিকে শক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর এই আলো হলো সেই শক্তিরই একটি অংশ যা সূর্য থেকে আসছে এবং আমাদের চোখ তা ডিটেক্ট করছে। যখন লাইট কোন দুইটি জায়গার মধ্যে ভ্রমন করে, অর্থাৎ সূর্য থেকে পৃথিবী পর্যন্ত অথবা আপনার ফ্ল্যাশলাইট থেকে রাতের অন্ধকার কোন কোনার দিকে, তখন এই দুটি পয়েন্টের মধ্যে এনার্জি ভ্রমন করে। এই এনার্জি তরঙ্গ আকারে ভ্রমন করে। এই তরঙ্গ সমুদ্রের তরঙ্গের মতোই, কিন্তু সমুদ্র তরঙ্গ হতে ১০০ মিলিয়ন টাইম বেশি ছোট হয়ে থাকে। তো লাইট একটি তরঙ্গ আকারে কাঁপতে কাঁপতে ইলেক্ট্রিসিটি এবং ম্যাগ্নেটিজমের প্যাটার্নে চলতে থাকে—যাকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক এনার্জি বলা হয়।

আমাদের চোখ যদি ইলেক্ট্রিসিটি এবং ম্যাগ্নেটিজমকে দেখতে পেত, তবে আমরা অবশ্যই এর ভেতরের কম্পমান রশ্মিগুলোকে দেখতে পেতাম। ইলেক্ট্রিসিটির তরঙ্গ এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ভ্রমন করে এবং ম্যাগ্নেটিজমের তরঙ্গ এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ভ্রমন করে এনার্জি বহন করে। আর এই দুই তরঙ্গ ই আলোর গতিতে পথ অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে।

আলো কি কণা, না তরঙ্গ?

শত বছর ধরে বিজ্ঞানীরা লাইট তরঙ্গ কিনা সেই ব্যাপারে বিতর্ক করে এসেছে। ১৭ শতকের দিকে ফিরে গেলে, তখনকার ইংরেজ বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন—কেবল মাত্র এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি এই ব্যাপারে সর্বাধিক পড়াশুনা করেছিলেন। তার তত্ত্ব অনুসারে, আলো “রঙ্গকণিকা” বা “কণা” আকারে প্রবাহিত হয়ে থাকে। কিন্তু পরে এক বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হুইজেন্স (Christiaan Huygens) বলেন যে, আলো তরঙ্গ আকারে প্রবাহিত হয়ে থাকে।

আর এভাবেই এক তর্কবিতর্কের জন্ম হয়, যা আজ অবধি বিদ্যমান রয়েছে। আর এই বিতর্কের পেছনে কারনও রয়েছে। কেনোনা লাইট সত্যিই তরঙ্গ আকারে প্রবাহিত হওয়ার আচরন করে। লাইট কোন আয়নাতে প্রতিফলিত হয়ে আবার উৎসের কাছে ফেরত আসে, যেমনটা সমুদ্রের ঢেউ কিনারাতে আছড়ে পড়ে আবার সমুদ্রে ফেরত যায়। আবার লাইট কণা হিসেবে প্রবাহিত হওয়ারও আচরন প্রকাশ করে থাকে, যেমনভাবে কোন বন্দুক থেকে গুলি ছোরা হলে আগুনের ফুল্কির কণা গুলো বেরিয়ে আসে।

বর্তমানের বিজ্ঞানীরা এটা বিশ্বাস করে যে, আলো একইসাথে কণা এবং তরঙ্গ উভয় মাধ্যমেই প্রবাহিত হয়। কথাটা শুনতে অনেক সাধারন মনে হলেও, একই সাথে একই সময়ে দুইটি অবস্থান কিন্তু কোন সহজ ব্যাপার নয়, এটা সর্বাধিক জটিল ব্যাপার এবং সবচাইতে আশ্চর্যজনক বিষয়।

এই সমস্যার আসল উত্তরটি কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানের চাইতে বেশি দর্শন তত্ত্ব এবং মনোবিদ্যার সাথে জড়িত। আমরা আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে ঠিক সেইভাবেই দেখি এবং বোঝার চেষ্টা করি যা আমরা চোখে দেখি এবং যা আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের বর্ণনা করে তার উপরে। আমাদের কখনো কখনো মনে হয় যে, আলো তরঙ্গ আকারে ভ্রমন করে আবার কখনো কখনো মনে হয় কণা আকারে। আর এর পেছনে এতো বিতর্কের কারন হলো—আমরা সাধারনত এমন কোন জিনিসকে দেখতে পাইনা যা একই সময়ে দুই রূপে থাকতে পারে, তাই আমাদের ভাবতে কষ্ট হয়। কিন্তু সত্যি বলে লাইট এক প্রকারের এনার্জি যা এর নিজস্ব স্টাইলে ভ্রমন করে, কিন্তু এর কাজ করার পদ্ধতি আমাদের মস্তিষ্কের সাথে খাপ খায় না। একদিন হয়তো আরো বুদ্ধিমান কোন বিজ্ঞানী আসবেন এবং আমাদের এর কাজ করার পদ্ধতি আরো ভালোভাবে বর্ণিত করতে সক্ষম হবেন।

আলোর প্রতিফলন

আলোর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এটি কোন জিনিষ থেকে প্রতিফলিত হতে পারে। আলোর প্রতিফলন সম্পূর্ণ দুটি আলাদা পদ্ধতিতে ঘটতে পারে। আপনি যদি মসৃণ এবং প্রচণ্ড পালিশ করা কোন তলকে সরু আলোকরশ্মি দ্বারা আলোকিত করেন তবে সেই আলোকরশ্মি সেই তল থেকে আবার প্রতিফলন হয়ে ফিরে আসে। এই প্রতিফলনকে স্পেকুলার প্রতিফলন (Specular Reflection) বলে—এটা ঠিক তখন ঘটে যখন আপনি ফ্ল্যাশলাইটকে আয়নাতে মারেন বা কোন লেজার বীম আয়নার উপর নিক্ষেপ করেন।

কিন্তু বেশিরভাগ অবজেক্টই মসৃণ এবং প্রচণ্ড পালিশ করা হয়ে থাকে না, তারা বেশি রুক্ষ হয়ে থাকে। যখন আপনি এমন কোন অবজেক্টকে আলোকিত করবেন তখন সেই আলো কোন একদিকে প্রতিফলিত না হয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে। আর একেই বলা হয়, বিকীর্ণ প্রতিফলন (Diffuse Reflection)।

আপনি যদি কোন অবজেক্টের উপর পরিষ্কারভাবে আপনার মুখ দেখতে পান, তবে সেটি হলো স্পেকুলার প্রতিফলন। আর যদি আপনি পরিষ্কার মুখ না দেখতে পান তবে সেটি হবে বিকীর্ণ প্রতিফলন। আবার কোন তল যদি ময়লা দ্বারা ভরপুর থাকে, তখন ময়লার প্রত্যেকটি দানা আলোকে বিক্ষিপ্ত করবে এবং আপনার মুখ অদর্শন হয়ে যাবে।

আলোর প্রতিসরণ

আলোক তরঙ্গ একদম সরল পথে স্পেস থেকে ভ্রমন করে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। কিন্তু মজাদার ব্যাপার তখনই ঘটে যখন লাইট কোন অন্য উপকরণের মধ্যদিয়ে ভ্রমন করার চেষ্টা করে। তবে এটি মোটেও কোন আশ্চর্যজনক ব্যাপার নয়, এটি আমাদের সাথেও ঘটে থাকে। আপনি কি কখনো খেয়াল করেছেন, পানির উপরদিয়ে হাঁটাচলা করার সময় আপনার চলার গতি কমে যায়? আপনি হয়তো সমুদ্রের কিনারা পর্যন্ত দ্রুত দৌড়াতে পারবেন কিন্তু যখনই আপনি পানিতে চলে যাবেন তখন আপনার গতি ধীরেধীরে কমে যাবে। জানিনা আপনি এই ব্যাপার গুলো কখনো সেইভাবে খেয়াল করেছেন কিনা, তবে আপনি বাতাসে যতো দ্রুত চলতে পারবেন ততো দ্রুত কখনোয় পানিতে চলতে পারবেন না।

ঠিক একইভাবে আপনি যখন পানির মধ্যদিয়ে বা কাঁচের মধ্যদিয়ে বা প্ল্যাস্টিকের মধ্যদিয়ে আলো আলোকিত করার চেষ্টা করবেন, তখন আলো নাটকীয় ভাবে দুর্বল এবং ধীরগতির হয়ে পড়বে। এই অবজেক্ট গুলো আলোর তরঙ্গকে বাঁকিয়ে দেয়, ফলে ধীরগতির হয়ে পড়ে। আর একেই আলোর প্রতিসরণ বলা হয়ে থাকে।

আলো কোথা থেকে আসে?

আপনি সাধারন বিজ্ঞানের বইয়ে অবশ্যই পড়েছেন যে শক্তির কোন উৎপত্তি বা শেষ নেই। এই মহাবিশ্বে এক নির্দিষ্ট পরিমানের শক্তি আগে থেকেই মজুদ রয়েছে। নতুন করে কোন শক্তি উৎপাদিতও হচ্ছে না আবার কোথাও খরচও হচ্ছে না। শক্তি শুধু এর নিজের রুপ পরিবর্তন করে কাজ করে—আর একে পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় শক্তির নিত্যতা বলা হয়। শক্তির রুপ পরিবর্তন করার তত্ত্ব সকল প্রকারের শক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সেটা আলো হোক আর অন্য কিছুই হোক। তো আলো কোথা হতে আসে, এবং কীভাবে আসে? কোন উপাদান আলো তৈরি করতে সাহায্য করে?

আলো অ্যাটমের মধ্যে তৈরি হয়, যখন অ্যাটম উত্তেজিত হয় তখন এথেকে লাইট নির্গত হয়। যখন অ্যাটম শক্তিকে শোষণ করে তখন এর ভেতরে থাকা ইলেকট্রন সর্বউচ্চ এনার্জি স্তরে প্রবেশ করে। কিন্তু এর ফলে অ্যাটমের ভেতর নড়াচড়ার সৃষ্টি হয় বা অ্যাটম  উত্তেজিত হয়ে পড়ে। যখন ইলেকট্রন তার নিজস্ব স্তরে ফেরত আসে তখন এটি তার শক্তিকে ফ্ল্যাশলাইট হিসেবে ফিরিয়ে দেয়, যা ফোটন (Photon) নামে পরিচিত।

শেষ কথা

আলো সত্যিই এক আশ্চর্যজনক বিষয়, এটি নিয়ে যতো আলোচনা করা হবে ততোই কম হবে। তারপরেও এই ছোট্ট আলোচনার মাঝে আমার সর্বউত্তম চেষ্টার মাধ্যমে বিষয়টিকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। আশা করছি আপনি এই আর্টিকেল থেকে অনেক কিছু জানতে পেড়েছেন, তাই বিনিময়ে আর্টিকেলটি শেয়ার করতে ভুলবেন না। আপনার যেকোনো প্রশ্নে আমাকে নিচে কমেন্ট করতে পারেন। আমি প্রত্যেকটি কমেন্টের জবাব দেই।

Image Credit: Shutterstock

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories