৬জি নেটওয়ার্ক : কি এবং কিভাবে কাজ করে?

যদিও বর্তমানে পৃথিবীতে হাতেগোনা কয়েকটি দেশেই ৫জি নেটওয়ার্ক টেস্ট করা হয়েছে, তবে কয়েকটি দেশের কিছু টেকনোলজি কোম্পানি অলরেডি ৫জি এর পরবর্তী জেনারেশন, অর্থাৎ ৬জি নেটওয়ার্ক নিয়ে পরিকল্পনা করছে। কিন্তু কি এই ৬জি নেটওয়ার্ক এবং এটি ৫জি নেটওয়ার্ক এবং ৫জি নেটওয়ার্কের সাথে এটির ঠিক কি কি পার্থক্য থাকবে, আর কিভাবে কাজ করবে এই ৬জি নেটওয়ার্ক? চলুন আজ ধারণা নেওয়া যাক ৬জি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে, যেটা হয়তো আমি বা আপনি আমরা কেউই লাইফে কখনোই ব্যবহার করার সুযোগ পাবো না।

তবে আলোচনা শুরু করার আগে জেনে রাখা ভালো, এই পোস্টটি লেখার সময় ৬জি নেটওয়ার্ক পৃথিবীর কোথাও নেই এবং কোথাও এমনকি প্রোপার টেস্টিং এর পর্যায়েও নেই। এটি এখনও পর্যন্ত এমন একটি টেকনোলজি যা  আগামী ২০ বছরের মধ্যেও প্রোপারলি কনজিউমার লেভেলে এভেইলেবল হবে কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়না। তাই, আপনি যদি শুধুমাত্র ৬জি নেটওয়ার্ক কি এবং কিভাবে কাজ করবে এর পরিকল্পনার ব্যাপারে জানতে আগ্রহী হন, তাহলেই শুধুমাত্র এই লেখাটি পড়তে থাকুন। তবে গত বছরের নভেম্বর মাসে চীন একটি টেরাহার্জ ক্যাপেবল ৬জি স্যাটেলাইট আকাশে লঞ্চ করেছে, তবে সেটা শুধুমাত্র একটি এক্সপেরিমেন্ট।

৬জি নেটওয়ার্ক কি?

একেবারে বেসিক লেভেলে বলতে গেলে, ৬জি অবশ্যই ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনে টেকনোলজির পরবর্তী জেনারেশন, যা ভবিষ্যতে কোন একসময় এভেইলেবল হবে। যেমনটা আপনি অলরেডি ধারণা করতে পারছেন, ৬জি এর সাহায্যে বর্তমানের সেলুলার নেটওয়ার্ক ইনফ্রাসট্রাকচারকে আরও বেশি উন্নত করার এবং আরও ফাস্ট এবং রিলায়েবল ইন্টারনেট সার্ভিস নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে ৬জি কিভাবে স্পেশাল সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে গেলে প্রথমে জানতে হবে যে, ৬জি টেকনোলজি কোন কোন দিক থেকে এখনকার সময়ের নেটওয়ার্কগুলো, অর্থাৎ ৪জি বা ৫জি নেটওয়ার্কের থেকে আলাদা হবে।

যদি শুধুমাত্র আরও ফাস্ট এবং রিলায়েবল ইন্টারনেটই একমাত্র পার্থক্য হয়ে থাকে, তাহলে আমরা এই নতুন টেকনোলজিটিকে জাস্ট Faster 5G বা Enhanced 5G কিংবা 5G+ কেন বলছিনা? এর কারণ হচ্ছে, ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের জেনারেশনের নামকরনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নেটওয়ার্ক স্পিডটাই একমাত্র ফ্যাক্টর নয়। এই প্রত্যেকটি স্ট্যান্ডার্ডের জন্য হার্ডওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারারদেরকে আরও কিছু আর্কিটেকচার লেভেলের বিষয় খেয়াল রাখতে হয়।

৬জি কে আপগ্রেডেড ৫জি বা বলার কারণ হচ্ছে, ৬জি নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করার জন্য ম্যানুফ্যাকচারারদেরকে তাদের সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচার এবং তাদের প্রোডাক্টগুলোর কমিউনিকেশন স্যুট নতুন করে ডিজাইন করতে হবে। ঠিক এই একই কারণে ৫জি নেটওয়ার্ককে জাস্ট আপগ্রেডেড ৪জি বা এমন কোন স্ট্যান্ডার্ড দেওয়া হয়নি। কারণ,  ৫জি নেটওয়ার্ক প্রোভাইড করার জন্য ক্যারিয়ারদেরকে সম্পূর্ণ নতুন টেকনোলজিতে তৈরি টাওয়ার ব্যবহার করতে হয়েছে। আর এই কারণেই এখনো শুধুমাত্র হাতেগোনা কয়েকটি দেশের কিছু কিছু জায়গায় ৫জি নেটওয়ার্ক নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।

 ৬জি নেটওয়ার্কের উদ্দেশ্য

এই মুহূর্তে ৬জি নেটওয়ার্কের কোর ফিচারস এবং নতুন কি কি থাকবে সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কোন কোম্পানিই কিছু জানাতে পারেনি, তবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের টেলিকল কোম্পানিগুলো অলরেডি ৬জি নেটওয়ার্ক নতুন কি কি নিয়ে আসতে পারে সে ব্যাপারে ধারণা করছে। যদি ব্যান্ডউইথের কথা বলা হয়, ধারণা অনুযায়ী ৬জি নেটওয়ার্ক প্রায় ৯৫ গিগাবিট প্রতি সেকেন্ড ডাটা ট্রান্সফার স্পিড প্রোভাইড করতে পারবে। এছাড়া ৬জি নেটওয়ার্কে লেটেন্সি এবং নেটওয়ার্ক রিয়ালেবলিটিতেও অনেক বেশি ইম্প্রুভমেন্ট আনা হবে এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।

৫জি নেটওয়ার্কে মতোই ৬জি  নেটওয়ার্কও “ইন্টারনেট অফ থিংস” ইকোসিস্টেমের দিকে ফোকাস করেই তৈরি করা হবে। কারণ, অবশ্যই আমরা যারা বাসায় বসে ইন্টারনেটে ফেসবুক ব্রাউজ করি আর ইউটিউব ভিডিও দেখি, তাদের জন্য এই মুহূর্তে ৪জি নেটওয়ার্ক যে পরিমান ব্যান্ডউইথ প্রোভাইড করে, সেটাই যথেষ্ট। আমাদের মতো একজন ক্যাজুয়াল ইউজার স্পিডটেস্ট না করলে কখনোই ৫জি এবং ৬জি নেটওয়ার্কের স্পিডের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করতে পারবে না।  ৫জি এবং ৬জি এর মধ্যে পার্থক্য তখনই লক্ষ্য করা যাবে যখন একটি এরিয়াতে সাধারনের তুলনায় অনেক বেশি ইন্টারনেট কানেক্টেড ডিভাইসের সংখ্যা বেড়ে যাবে বা ইন্টারনেট ইউজার অনেক বেড়ে যাবে। আর এখন যে হারে পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে এমন হওয়া হয়তো আর ১০-১৫ বছরের ব্যাপার।

যাইহোক, ৬জি এর ক্যাপেবলিটি এই সিচুয়েশনেই দেখা যাবে, কারণ- এমন সিচুয়েশনে নেটওয়ার্কের কোর ব্যান্ডউইথের থেকে নেটওয়ার্কের স্কেলেবলিটি অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট। এক্ষেত্রে ইউজারদেরকে সার্ভ করার জন্য ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের পরিমানের তুলনায় রেসপন্স টাইম বা লেটেন্সি কমানো বেশি প্রয়োজনীয়। আর ৬জি নেটওয়ার্কের প্রধান উদ্দেশ্যই হবে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ বাড়ানোর পাশাপাশি লেটেন্সি এবং নেটওয়ার্ক রিলায়েবলিটি ইম্প্রুভ করা। এই কারণেই মূলত এটি অ্যান্ড টি বা স্যামসাং এর মত কোম্পানিরা ৬জি নেটওয়ার্ক নিয়ে আশাবাদী।

৬জি কিভাবে কাজ করে?

সত্যি কথা বলতে আমরা কেউই জানি না ৬জি কিভাবে তৈরি হবে এবং কিভাবে কাজ করবে। কারণ, অবশ্যই, ৬জি এখনও শুধুমাত্র একটি পরিকল্পনা। তবে নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার এবং রিসার্চাররা ৬জি কিভাবে কাজ করবে এর কিছুটা আইডিয়া দিতে পেরেছেন। সাধারন কনজিউমারদের বোধগম্য ভাষায় বলতে হলে, ৬জি মুলত আলট্রা-হাই-ফ্রিকুয়েন্সিতে ডাটা ট্রান্সমিট করবে। ইন থিওরি, ৫জি সর্বোচ্চ ১০০ গিগাহার্জ ফ্রিকুয়েন্সি পর্যন্ত যেতে পারে তবে এখনো কোন দেশেই ৫জি নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে ৩৯ গিগাহার্জের ওপরে যাওয়া হচ্ছে না। ৬জি এর ক্ষেত্রে রিসার্চাররা ধারণা করছেন যে, তারা ফ্রিকুয়েন্সি ১০০ গিগাহার্জের আরও অনেক ওপরে নিয়ে যেতে পারবেন, এমনকি টেরাহার্জ রেঞ্জেও নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে ৬জি এর ওয়েভগুলো হবে খুবই ছোট এবং বেশিদূর ট্রাভেল করতে পারবে না। এর ফলে এক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনও হতে হবে।

লিমিটেশনস

একটি সাধারন ৪জি এলটিই নেটওয়ার্ক ট্রান্সিভার সর্বোচ্চ ১০ মাইল পর্যন্ত এর সেলগুলোকে ট্রান্সমিট করতে পারে। তাই কোন অপারেটর যদি চায় যে তাদের কাস্টোমাররা সবসময়ের জন্য স্ট্যাবল ৪জি সিগনাল পেতে থাকুক, তাহলে তাদেরকে প্রতি ১০ মাইল পরপর বা এরও কম দূরত্বে একটি করে ৪জি টাওয়ার বসাতে হবে। এবার অপারেটর যদি তাদের নেটওয়ার্ক ৫জি তে আপগ্রেড করতে চায় এবং ইউজারদেরকে একইরকম সার্ভিস দিতে চায়, তাহলে এবার তাদেরকে ১০ মাইলের পরিবর্তে প্রতি ১০০০ ফুট দূরত্বে একটি করে ৫জি ট্রান্সিভার বসাতে হবে। কারণ, ৪জি এর তুলনায় ৫জি এর ওয়েভ অনেক কম দূরত্ব ট্রাভেল করতে পারে।

এটা করা অসম্ভব নয়, তবে খুবই কষ্টসাধ্য এবং এক্সপেন্সিভ। এই কারণেই এখন পৃথিবীর খুব কম জায়গায় ৫জি সিগনাল আছে। এবার যদি ৬জি এর কথা চিন্তা করেন, তাহলে নিশ্চই ধারণা করতে পারছেন যে, এক্ষেত্রে ভালো সিগনালের জন্য ট্রান্সিভারগুলোকে একে অন্যের এত কাছাকাছি বসাতে হবে যে, খরচের কথা চিন্তা করলে সেটা যেকোনো দেশের জন্যই নেক্সট টু ইম্পসিবল একটি প্ল্যাণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে রিসার্চাররা এই প্রবলেমটির বেটার কোন একটি সল্যুশন খোঁজার চেষ্টা সবসময়ের জন্যই করছেন এবং এটার কোন সল্যুশন খুঁজে পাওয়া গেলে খুব দ্রুতই ৬জি নেটওয়ার্কে প্ল্যান কার্যকর করার দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যাবে।

কবে পাওয়া যাবে ৬জি?

পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় টেক ইন্ডাস্ট্রি, স্যামসাং এর পাবলিশ করা একটি হোয়াইটপেপার অনুযায়ী, সবকিছু ঠিক থাকলে ‘Define a 6G Vision’ নামের এই প্রোজেক্টটিতে কাজ করা শুরু হতে পারে এবছরের মধ্যেই। আর স্যামসাং এর ধারন অনুযায়ী ৬জি নেটওয়ার্কের কাজ শেষ হতে পারে ২০২৮ সালে। আর তখনই আমরা ৬জি সাপোর্টেড প্রোডাক্টগুলো বাজারে আসতে দেখতে পারি। তবে স্যামসাং মনে করে, কনজিউমার লেভেলে ৬জি নেটওয়ার্ক এভেইলেবল হতে আরও কয়েকবছর সময় লেগে যাবে। সাধারন কনজিউমাররা ২০৩০ সালের দিকে ৬জি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার আশা রাখতেই পারে।

তবে আমি লেখা শুরুর আগে বলেছিলাম যে, ৬জি হয়তো এমন একটি টেকনলজি যেটা হয়তো আমি বা আপনি লাইফে কখনোই ব্যবহার করতে পারবো না। হ্যাঁ, আমার এটা মনে করার কারণ হচ্ছে, ২০৩০ সালের দিকে ৬জি কনজিউমার লেভেলে এভেইলেবল হলেও বাংলাদেশে ৬জি এভেইলেবল হতে কমপক্ষে আরও ৫০-৬০ বছর সময় লেগেই যাবে!


 

About the author

সিয়াম

1 comment

  • তাহমিদ ভাইয়ের লেখা গুলো খুব মিস করছি, ভাই আপনি কি আর লিখবেন না ওয়্যারবিডি তে ?

Categories