আপলোড স্পিড কেন ডাউনলোড স্পিডের থেকে কম হয়?

যদি কখনো আপনার ইন্টারনেট স্পিডের উপর কোনো টেস্ট করে থাকেন তাহলে দেখবেন যে সবসমই আপনার আপলোডের থেকে ডাউনলোড স্পিড বেশি রয়েছে । কিন্তু কখনো মনে প্রশ্ন এসেছে কি এটা কেন হয়? আর এই সমস্যা কি শুধু আপনার সাথেই ঘটছে? জ্বি না। এটা বিশ্বব্যাপীই ছড়িয়ে রয়েছে। যেমন Speedtest এর একটি রির্পোট অনুযায়ী ২০২১ সালের মার্চ মাসের বিশ্বের গড় ইন্টারনেট ডাউনলোড স্পিড (ফিক্সড ব্রডব্যান্ড) হলো 98.67 Mbps অন্যদিকে গড় আপলোড স্পিড হলো 53.22 Mbps ।

মানে প্রায় অর্ধেকের চেয়ে একটু বেশি। আপলোড স্পিড কেন ডাউনলোড স্পিডের থেকে কম হয় এটা যদি আপনি আপনার ISP (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) কে জিঙ্গেস করেন তাহলে তারা বলবে যে আপলোডের থেকে ডাউনলোড স্পিডের ডিমান্ড বেশি থাকে কাস্টমারদের কাছে। এবং এখানে একটি টেকনিক্যাল লিমিটও রয়েছে। আজ আমি আপনাদেরকে সহজ ভাষায় এই বিষয়টি বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করবো।


আপলোড স্পিড কম হবার কারণ

ইন্টারনেট থেকে ইউজার কম্পিউটারে যে রেটে ডাটা টান্সফার হয় তাকে বলা হয় ডাউনলোড স্পিড। এর উল্টো করলে আপনি পেয়ে যাবেন আপলোড স্পিড; মানে ইউজার কম্পিউটার থেকে ইন্টারনেটে যে রেটে ডাটা টান্সফার করা হয় তাকে বলে আপলোড স্পিড। ইন্টারনেট কোম্পানি (মোবাইল নেটওর্য়াক সহ) গুলো ডিফল্ট ভাবে আমাদের ডাউনলোড স্পিড কে আপলোডের থেকে অনেক বেশি ফাস্ট করে রাখে। এর মূল কারণ হচ্ছে ৯০% গ্রাহকের আপলোডের থেকে ডাউনলোড স্পিড বেশি হবার প্রয়োজন পড়ে।

এই ফিচারের কারণেই আমরা কোনো কিছু আপলোড করার থেকে তুলনামূলক ভাবে বেশি গতিতে ডাউনলোড করতে পারি। আবার কিছু কিছু বড় সড় বিজনেস প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের একটু বেশি পরিমাণের আপলোড স্পিডের দরকার হয়ে থাকে। তারা এখানে ইন্টারনেট কোম্পানির সাথে আলাপ করে তাদের ডাউনলোড এবং আপলোড স্পিড সমান করে নেয় কিংবা ডাউনলোডের থেকে আপলোড স্পিড একটু বেশি করে থাকে। টেকনিক্যাল ভাষায় একে বলা হয় “symmertrical”। symmertrical টার্ম হচ্ছে ওই সিচুয়েশনকে বলা হয় যেখানে আপলোড এবং ডাউনলোড স্পিডের গতি একই হয়ে থাকে, এবং বলা বাহুল্য যে এই ইন্টারনেট কনফিগারেশন খুবই কম ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

অন্যদিকে আমাদের অধিকাংশ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট লাইন কোম্পানিগুলো টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে ইন্টারনেট সার্ভিস দিয়ে থাকে, একে বলা হয় ADSL (Asynchronous Digital Subscriber Line) টেকনোলজি আর এখানে ডাউনলোড স্পিড অনেক বেশি থাকে আপলোডের স্পিডের থেকে। ধরুণ আপনি ইন্টারনেট লাইন ব্যবহার করবেন; এখন যে প্রতিষ্ঠানের লাইন ব্যবহার করবেন তাদের ইন্টারনেট প্যাকেজগুলোর দিকে লক্ষ্য করুন। তাহলে দেখবেন যে তারা বিভিন্ন স্পিডের ভিক্তিতে তাদের লাইনের নাম এবং চার্জ সেটিং করে থাকে; এদের মধ্যে থাকে Main Speed, BDIX speed, youtube speed, ftp speed ইত্যাদি। এখানে সকল স্পিডই কিন্তু ডাউনলোড স্পিড। যেমন- মেইন স্পিডে আপনার প্যাকেজের মূল স্পিড দেওয়া থাকে, যেমন আপনি যদি 3Mbps লাইন ব্যবহার করে তাহলে এই মেইন স্পিডে আপনি পাবেন ৩ মেগাবিট ডাউনলোড স্পিড, BDIX speed মানে বাংলাদেশের ভেতরে আপনি এই সাইটগুলো থেকে বেশ দ্রুত গতিতে “ডাউনলোড” করতে পারবেন।

অন্যদিকে youtube এবং ftp এগুলোর যে স্পিড উল্লেখ থাকে সেটাও কিন্তু ডাউনলোড স্পিড। যেমন ইউটিউব দেখার সময় ভিডিওগুলো কিন্তু আপনার ডিভাইসে অটো ডাউনলোড হয়ে থাকে আপলোড নয়। তাই ইউটিউব থেকে ডাউনলোড স্পিড আপনি খুব বেশি পাবেন  কিন্তু ইউটিউবে ভিডিও আপলোড কিন্তু তুলনামূলক ভাবে কম হয়। তাই ইন্টারনেট প্যাকেজগুলোতে সাধারণত ডাউনলোড স্পিড দিয়েই সাজানো হয়। আপলোড স্পিড দেওয়া থাকে না। আপলোড স্পিড যদি দেওয়া থাকতো তাহলে নেট প্যাকেজগুলোর নাম হতো এরকম:

  • 5/1 Mbps
  • 6/1.5 Mbps
  • 10/2 Mbps

এই রকম স্পিড প্যাকেজ দিলে সাধারণ আমজনতা বিভ্রান্ত হবে এবং এটাই স্বাভাবিক। এখানে ৫ মেগাবিট স্পিড লাইনে আপনি আপলোড স্পিড পাবেন ১ মেগাবিট প্রতি সেকেন্ডে। একই ভাবে 10Mbps গতির লাইনে আপনি পাচ্ছেন 2Mbps গতির আপলোড স্পিড কিন্তু ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো এটা উল্লেখ করে না।

Asymmetry ইস্যু

ডাউনলোড এবং আপলোড সার্ভিস দেবার জন্য DSL, cable এবং Fiber কানেক্টশনগুলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে স্ট্রিম করতে হয়। আর কতটুকু ইনফরমেশন তারা প্রদান করতে পারবে এখানে লিমিট থাকায় আপলোডের থেকে ডাউনলোড স্পিডকে নেট কোম্পানিরা বেশি দিয়ে রাখে।

একটি ৩ তলা বিল্ডিংয়ে প্রতি ঘরে ইন্টারনেট সার্ভিস দেবার জন্য ইন্টারনেট কোম্পানিরা একটি coax ক্যাবল ব্যবহার করে থাকে এবং ধরুন উক্ত বিল্ডিংয়ে টোটাল ৫০ মেগাবাইট গতির নেট সার্ভিস দেওয়া হয়। এখন পিক টাইমে সবাই যাতে গড়ে একই নায্য স্পিডের ইন্টারনেট সেবা উপভোগ করতে পারে সেজন্যই বিল্ডিংটির আপলোড স্পিড কমিয়ে ডাউনলোড স্পিডকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। তাই ডাউনলোড এবং আপলোড স্পিডের অনুপাত হয় ২:১।

DSL লাইন

ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার সবথেকে পুরোনো প্রযুক্তির লাইন হচ্ছে এই DSL বা Digital Subscriber Line । এই লাইনে সরাসরি টেলিফোনের কপার লাইন ব্যবহার করা হয়ে থাকে আর এই লাইনে আপনি সরাসরি বেশি স্পিড পাবেন না। আর বর্তমানে ব্যবহার করা হয় ADLS লাইন যেখানে A হচ্ছে Asymmertric মানে এই লাইন বর্তমান যুগে কিছুটা মানানসই ভাবে স্পিড সরবরাহ করতে পারে।

কপারযুক্ত এই সকল লাইনে ব্যান্ডউইথ খুবই থাকে তাই এই লাইনের ৯০% স্পিড ডাউনলোডের দিকে দেওয়া হয়ে থাকে। আপনার ISP যদি এই লাইন (ADSL) ব্যবহার করে আপনাকে নেট সংযোগ দিয়ে থাকে তাহলে আমি বলবো শীঘ্রই আপনি লাইন পরিবর্তন করে ফেলুন এবং সুযোগ থাকলে ISP কেই পরিবর্তন করে ফেলুন।

ক্যাবল লাইন

এটা হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ড ব্রডব্যান্ড লাইন সিস্টেম। এটা অনেকটা ডিশ লাইনের মতোই আমাদের কে সার্ভিস দিয়ে থাকে। আপনি যদি ফাইবার অপটিক লাইন না নেন তাহলে ইন্টারনেট কোম্পানি আপনাকে এই ক্যাবল লাইন দিবে। তবে এই ক্যাবল লাইনের কয়েকটি ভাগ রয়েছে, আর আমি আজ লাইনের ভাগ নিয়ে কথা বলতে আসিনি। যাই হোক, ক্যাবল লাইনেও আপনি ডিফল্ট ভাবে তুলনামূলক কম আপলোড স্পিড পাবেন।

ক্যাবল লাইনে যদি আপনি 20Mbps গতির নেট প্যাকেজ নিয়ে থাকেন তাহলে এখানে আপনি আপলোড স্পিড পাবেন গড়ে 5Mbps । মানে এখানে ডাউনলোড এবং আপলোডের গড় অনুপাত থাকে 5:2।

ফাইবার অপটিক লাইন

ফাইবার অপটিক লাইনে সাধারণত তুলনামুলক ভাবে বেশি ব্যান্ডউইথ দেওয়া থাকে। এছাড়াও বিদ্যুৎ চলে গেলেও ল্যাপটপে আপনি ফাইবার ক্যাবল লাগিয়ে নেট সার্ভিস উপভোগ করতে পারবেন। তাই অনান্যের চেয়ে এই ফাইবারের লাইনের সেটআপ করার খরচ বেশি। আর ব্যক্তিগত ও বিজনেস ফাইবার লাইনগুলো ডিফল্ট ভাবে symmertric সেটিংয়ে দেওয়া থাকে। symmertric মানে ডাউনলোড আর আপলোডের সমান স্পিড।

মানে হলো 5Mbps ফাইবার লাইনের নেটের সংযোগে আপনি 5Mbps ডাউনলোড এবং 5Mbps এর আশেপাশের আপলোড স্পিড পাবেন। তবে এটা সবর্ত্র সমান নয়, প্যাকেজের দামের ভিক্তিতে স্থান বিশেষে এটার পার্থক্য রয়েছে।

কিভাবে আপনি আপলোড স্পিড ফাস্ট করবেন?

এই প্রশ্নের সবথেকে সোজা এবং সহজ সরল উত্তর হচ্ছে “ইন্টারনেট প্যাকেজ পাল্টান!”। শুধুমাত্র ফাইল আপলোড করার জন্যেই কিন্তু আপনার আপলোড স্পিডের প্রয়োজন হচ্ছে না, অনলাইনে স্ট্রিমিং করতে গেলে কিংবা অনলাইন গেম খেলতে গেলে “ping” ইস্যুটা স্ট্যাবল রাখার জন্যেও কিন্তু আপনার “স্ট্যাবল” আপলোড স্পিডের দরকার হবে।  প্রথমে আগে আপনার ইন্টারনেট কোম্পানিকে ফোন দিয়ে জেনে নিন আপনার প্যাকেজে “সঠিক” আপলোড স্পিডটি কত। ধরুণ আপনার প্যাকেজে আপলোড স্পিড ২ মেগাবিট কিন্তু আপনি নিজে টেস্ট করে দেখলেন যে এই আপলোড স্পিড ঠিকমত আপনি পাচ্ছেন না। তাহলে নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারেন:

  • আপনার মোডেম এবং রাউটারের ফার্মওয়্যার (firmware) আপডেট করুন, হয়তো এর জন্য isp এর আপগ্রেডের সাথে আপনি খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন না। তবে লক্ষ্য রাখবেন এই ফার্মওয়্যার বিষয়ে ধারণা না থাকলে এগুলো নিজে থেকে ঘাঁটাঘাটি না করাটাই উত্তম। এক্ষেত্রে ISP কে ফোন কে তাদের কোনো পিসি এক্সপার্ট কে আনিয়ে আপনার রাউটারের ফার্মওয়্যার আপডেট দিয়ে নিতে পারেন।
  • Wireless থেকে Wired প্রযুক্তিতে চলে আসতে পারেন। মানে ওয়াইফাই থেকে ক্যাবলে। সহজ ভাষায় একই রাউটারের ওয়াইফাইয়ের থেকে ক্যাবল লাইনে আপনি তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি আপলোড স্পিড পাবেন
  • আপনার পিসি বা ল্যাপটপের ব্যাকগ্রাউন্ড প্রোগ্রামগুলো সম্পর্কে সচেতন হন। চেক করে দেখুন syncing photos, ক্লাউড সার্ভারে ডাটা ব্যাকআপ, ফাইল শেয়ারিং এবং অনান্য অ্যাপস আপনার ব্যান্ডউইথ চুষে নিচ্ছে কিনা
  • ভিন্ন ডিভাইসে স্পিড চেক করুন। যদি অন্য ডিভাইসে স্পিড তুলনামুলক ভাবে বেশি পান তাহলে বুঝবেন আপনার আগের ডিভাইসে ইন্টারনেট সমস্যার নেই বরং কোনো সফটওয়্যার কিংবা হার্ডওয়্যার ইস্যু রয়েছে।

আশা করবো আজকের পোষ্টটি পড়ে আপনি জানতে পেরেছেন ডাউনলোড স্পিড আমাদের আপলোড স্পিডের থেকে কেন বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু এটা হচ্ছে পুরোনো লাইফ। নতুন ডিজিটাল লাইফে কিন্তু আমাদের ডাউনলোডের পাশাপাশি আপলোড স্পিডও কিন্তু বেশ দরকার হবে। কারণ ইতিমধ্যেই উন্নত বিশ্বে AI ফিচারের Cloud ভিক্তিক ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদান পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু হয়ে গিয়েছে। আর ক্লাউড ভিক্তিক ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদানের মূল ভিক্তি হচ্ছে উন্নত আপলোড স্পিড।

Image: Shutterstock

About the author

ফাহাদ

Add comment

Categories