এন্টেনা এবং ট্রান্সমিটার কিভাবে কাজ করে?

আপনি কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আপনার চারপাশের বাতাসে কত কথা, গান, ছবি, ভিডিও, ইন্টারনেট ডাটা ভেসে বেড়চ্ছে? আপনি হয়তো সেগুলোকে খালি চোখে দেখতে বা বুঝতে পারেন না, কিন্তু একটি ধাতুর তৈরি রড বা থালার মতো দেখতে জিনিস, যেটাকে এন্টেনা বলা হয়; এটি বাতাসে ভেসে বেড়ানো কথা, গান, ছবি, ভিডিও, ইন্টারনেট ডাটা গুলোকে ক্যাপচার করে এবং ইলেক্ট্রিক্যাল সিগন্যালে পরিণত করে রেডিও, টিভি, টেলিফোন, সেলফোনে পাচার করে। আপনার বাড়িতে লাগানো থাকা এন্টেনার পেছনে আরেকটি এন্টেনা থাকে, যেটা থেকে আপনার বাড়ির এন্টেনা সিগন্যাল গ্রহন করে; একে ট্রান্সমিটার বলা হয়। আপনার বাড়ির এন্টেনা যেহেতু সিগন্যাল রিসিভ করে, তাই একে রিসিভার এন্টেনা বলা হয়। ইন্টারনেট থেকে শুরু করে ভার্চুয়ালি যতো প্রকারের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রত্যেক ক্ষেত্রে এই এন্টেনা এবং ট্রান্সমিটার থাকা আবশ্যক। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক, এরা কিভাবে কাজ করে…


এন্টেনা

কোন রেডিও বা টিভি স্টেশনে প্রথমে সাউন্ড এবং পিকচারকে ক্যাপচার করে ইলেক্ট্রিক্যাল এনার্জিতে পরিণত করা হয়। এবার এই ইলেক্ট্রিক্যাল এনার্জিকে একটি বিশাল আকারের এন্টেনাতে পাঠানো হয়, এন্টেনাতে এই এনার্জি এসে রেডিও তরঙ্গে একটি অদৃশ্য ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের সৃষ্টি করে। এখন এই রেডিও তরঙ্গ আলোর গতিতে ছুটে এসে আপনার ঘরে লাগানো রিসিভার এন্টেনায় এসে পৌঁছায়, রিসিভার এন্টেনাটি ঠিক উল্টা কাজ করে, এবার এটি তরঙ্গ থেকে ইলেকট্রিক সিগন্যাল তৈরি করে আর রেডিও বা টেলিভিশনের কাছে পাঠিয়ে দেয়। এই সিগন্যালকে আপনার রেডিও বা টেলিভিশন শব্দ বা ছবিতে পরিণত করে।

ট্রান্সমিটার এবং রিসিভার এন্টেনা ডিজাইনের দিক থেকে অনেকটা একই রকম। কিন্তু দুইটি দেখতে বা আকারে আলাদা হতে পারে, যেমন বাড়িতে লাগানো থাকা এন্টেনাটি থালার মতো আকৃতির হয়ে থাকে, যেটাকে ডিশ এন্টেনাও বলা হয়। আর ট্রান্সমিটার রেডিও, টিভি সেন্টারে থাকা একটি বিশাল আকারের ধাতব এন্টেনা হয়, যেটা প্রচণ্ড শক্তিশালী সিগন্যাল তৈরি করে পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে আরেক প্রান্তে পাঠিয়ে দেয়। অনেক সময় ট্রান্সমিটার সিগন্যাল তৈরি করে স্যাটেলাইটে পাঠিয়ে দেয়, স্যাটেলাইট সেই সিগন্যালকে বুস্ট করে আবার পৃথিবীতে থাকা রিসিভার এন্টেনাতে সিগন্যাল পাঠায়। এক্ষেত্রে স্যাটেলাইট সিগন্যাল প্রতিফলক হিসেবে কাজ করে।

বিভিন্ন ধরনের এন্টেনা

 

সাধারন এন্টেনা ব্যাস একটি রডের তৈরি হয়ে থাকে, যেটাতে তার লাগানো থাকে, আর সেই তার টিভি বা রেডিও সেটের সাথে লাগানো থাকে। আগের রেডিও গুলোতে ডিফল্টভাবে ছোট লম্বা করা একটি এন্টেনা লাগানো থাকতো, তবে বেটার সিগন্যাল কোয়ালিটি পাওয়ার জন্য আউটডোর এন্টেনা ব্যবহার করা হয়। আগের টিভি এন্টেনা গুলো দেখতে অনেকটা বাংলার মইয়ের মতো ছিল। বিশেষ করে সিলভার দ্বারা তৈরি করা ছিল এর কাঠামো, একটি লম্বা সিলভার দন্ডের সাথে অনেক গুলো ছোট ছোট সিলভার পাইপ সাড়ি করে অনুভূমিকভাবে লাগানো থাকতো। আবার আরেক ধরনের এন্টেনাতে গোলাকার লুপ ডিজাইন থাকতো, যেটার সাথেও তার লাগানো থাকতো। আর থালার মতো ডিশ এন্টেনাকে তো আপনারা সবাই-ই চেনেন। যেখানে একই ধরনের সিগন্যালকে রিসিভ করা হতো, তাহলে এন্টেনার এই আলাদা আলাদা সাইজ কেন? —বিভিন্ন আকারের এন্টেনা সিগন্যালের উপর মনোনিবেশ করে সিগন্যালকে ডিটেক্ট করতে সাহায্য করে।

এন্টেনার সাইজ তেমন একটা ব্যাপার না হলেও, এন্টেনাতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্ট রয়েছে। একটি হচ্ছে এন্টেনাটি কোন দিক করে রাখা হয়েছে, দ্বিতীয়ত সিগন্যালের পরিমান কতোটুকু, এবং তৃতীয়ত ব্যান্ডউইথ। সাধারন রডের বা মইয়ের মতো দেখতে এন্টেনা গুলো সঠিক দিক করে রাখা এবং সেট করা প্রয়োজনীয়, আর এই জন্যই আগের দিনের টিভি এন্টেনা গুলোকে সঠিক করে আটকাতে হতো, না হলে পিকচার বা সাউন্ড কোয়ালিটি পরিষ্কার হতো না। ছোট বেলায় টিভি’তে পরিষ্কার পিকচার পাওয়ার জন্য যে কতো এন্টেনা পাকাপাকি করেছি, তার হিসেব নেই। রেডিওতে লাগানো থাকা টেলিস্কোপিক ছোট এন্টেনা তেমন করে কোন দিক তাক করে সেট করার দরকার নেই, যদি সিগন্যাল কোয়ালিটি শক্তিশালী হয়। গোলাকার লুপ এন্টেনা গুলো ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল থেকে সিগন্যাল রিসিভ করতে পারে, কিন্তু হাইলি ডিরেকশনাল এন্টেনা গুলো পাকাতে পাকাতে আপনার জীবন পানি করে দেবে।

এন্টেনাতে সিগন্যালের পরিমান বা সিগন্যাল গেইন অনেকটা মাপ যোগের ব্যাপার। আপনি কি জানেন, আপনার টিভি এন্টেনা বাদেও নিজে থেকে সিগন্যাল ক্যাচ করে, টিভি’তে থাকা বিভিন্ন যন্ত্রাংশ গুলো ডিফল্টভাবে এন্টেনার কাজ করে, কিন্তু এই ক্যাপচার হওয়া সিগন্যাল অনেক দুর্বল কোয়ালিটির হয়ে থাকে। তাই হাইলি গেইন সিগন্যাল পাওয়ার জন্য আউটডোর এন্টেনা লাগানো হয়, যেটা অনেক ভালো গেইনের সিগন্যাল ক্যাপচার করতে পারে। সিগন্যাল গেইনকে সাধারনত ডেসিবেল (dB) দ্বারা মাপা হয়। যতোবেশি গেইন পাওয়া যাবে, ততোই বেটার পিকচার এবং অডিও কোয়ালিটি পাওয়া সম্ভব। তবে সাধারন সিঙ্গেল রডের এন্টেনা থেকে কমপ্লেক্স এন্টেনাতে ভালো গেইন পাওয়া যায়।

এন্টেনাতে ব্যান্ডউইথ মানে ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জ বোঝানো হয়। যতো বৃহত্তর ব্যান্ডউইথ হবে, ততোই একাধিক পরিমানে সিগন্যাল এন্টেনাটি ক্যাচ করতে পারবে। বৃহত্তর ব্যান্ডউইথের এন্টেনা রেডিও বা টেলিভিশনের জন্য উপকারী, কেনোনা সেখানে একসাথে অনেক চ্যানেল ধরানোর জন্য আলাদা আলাদা চ্যানেল স্টেশন থেকে আলাদা আলাদা সিগন্যাল রিসিভ করাতে হয়। তবে সেলফোন, স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থাতে এন্টেনা ব্যান্ডউইথের তেমন প্রাধান্য নেই, কেনোনা এখানে কোন নির্দিষ্ট সিগন্যালের উপর কাজ করা হয়, আর সিগন্যালটিও অনেক সূক্ষ্ম হয়ে থাকে।

শেষ কথা

সত্যি কথা বলতে এন্টেনা ছাড়া মডার্ন কমুনিকেসন সিস্টেম অচল। আকাশে সিগন্যাল পাঠিয়ে আবার আকাশ থেকে সিগন্যাল গ্রহন করে এটি আমাদের সকল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করছে। আশা করছি এই আর্টিকেলটি আপনার অনেক ভালো লেগেছে, সাথে রিসিভার এবং ট্রান্সমিটার নিয়ে অনেক কিছু জানতে সক্ষম হয়েছেন। তো আপনিও কি ছোট বেলায় টিভি তে ভালো পিকচার পাওয়ার জন্য এন্টেনা পাকাপাকি করতেন? —আপনার মজার কাহিনী আমাদের নিচে কমেন্ট করে জানান।

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories