মোবাইল ফোন জ্যামার কিভাবে কাজ করে? — সেল ফোন সিগন্যাল জ্যামার নিয়ে সবকিছু!

আমি জানি, বর্তমানে সেল ফোন এমন এক প্রয়োজনীয় ডিভাইজে পরিণত হয়েছে, আপনি বাইরে যাওয়ার সময় যদি ভুল করে শার্ট পরতেও ভুলে যান, তারপরেও হাতে হয়তো মোবাইল ফোন রাখতে ভুলবেন না। মাত্র কয়েক দশক আগে এরকম কোন জিনিষ কল্পনাও করা যেতো না, অথচ বর্তমানে সেল ফোন ব্যবহার করে আপনি দুনিয়ার যেকোনো স্থানে যেকোনো সময় বিন্দাস কল করতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, মসজিদ, মুভি থিয়েটার সহ ইত্যাদি জায়গা গুলো প্রায়ই সেল ফোনের কারণে ভোগান্তির শিকার হয়, কেননা অনেক মানুষই এটা খেয়াল রাখেন না কোথায় কথা বলা উচিৎ আর কোথায় উচিৎ নয়। মসজিদ গুলোতে “অনুগ্রহ করে সেল ফোন বন্ধ করুণ” — নোটিশ টাঙ্গিয়ে রাখার পরেও কাজ হয় না, অনেকেই তা তোয়াক্কাই করেন না। আর এই সময়ই সেল ফোন বা মোবাইল ফোন জ্যামার বেশ কাজের ডিভাইজ হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে।

মোবাইল ফোন রেডিও তরঙ্গের উপর কাজ করে, আর যেহেতু রেডিও তরঙ্গকে সহজেই বিঘ্নিত বা জ্যামড করা যেতে পারে তাই এভাবেই সেল ফোন জ্যামারকে কাজে লাগানো হয়। এই আর্টিকেলে আমি বর্ণনা করেছি, রেডিও সিগন্যাল জ্যামার কিভাবে কাজ করে, এর ব্যবহার কোথায় কোথায় করা হয় এবং এটি বৈধ নাকি অবৈধ। — তো বিস্তারিত জানার জন্য অবশ্যই আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন!


মোবাইল ফোন জ্যামার

মোবাইল জ্যামার হচ্ছে একটি যন্ত্র যেটা আপনার মোবাইল ফোনে মোবাইল টাওয়ার থেকে সিগন্যাল আসাকে প্রতিরোধ করে। বুঝতেই পারছেন, এরকম ডিভাইজ প্ল্যান করেই সেটআপ করা হয় যাতে জ্যামিং এরিয়াতে কেউ কোন রেডিও কমিউনিকেশন তৈরি করতে না পারে। জ্যামার শুধু সেল ফোন সিগন্যালের উপরই চালানো হয় না — ওয়াইফাই, ব্লুটুথ — সহ যেকোনো রেডিও সিস্টেমের উপর চালানো যেতে পারে।

রেডিও জ্যামার যেকোনো স্থানে ইন্সটল করা যেতে পারে, আপনি পার্সোনাল জ্যামার লাগাতে পারেন যেটার রেঞ্জ ১০-১০০ মিতার পর্যন্ত হতে পারে আবার বিশাল এরিয়া জুড়ে বিশাল রেঞ্জের জ্যামার ইন্সটল করা যেতে পারে। অনেক পোর্টেবল জ্যামার রয়েছে যেগুলো পকেট সাইজের মানে আপনার সেল ফোন সাইজেরই হয়ে থাকে, বেশি রেঞ্জের জ্যামার গুলোর আকৃতি বড় হয়ে থাকে। সেল ফোন জ্যামার গুলো কাজ করার জন্য অনেক টাইপের এন্টেনা এতে মজুদ থাকে, নিচের প্যারাগ্রাফ গুলো থেকে আপনি বিস্তারিত তথ্য গুলো জানতে পারবেন।

সিগন্যাল জ্যামার কিভাবে কাজ করে?

যেকোনো টাইপের রেডিও কমিউনিকেশন আর সেল ফোন সিগন্যাল জ্যাম করা একই প্রিন্সিপ্যালের উপর কাজ করে। সিগন্যাল জ্যামার কিভাবে কাজ করে, সেটা স্পষ্ট বুজতে হলে আগে আমার লেখা “সেল ফোন কিভাবে কাজ করে” — এই আর্টিকেলটি পড়ে নিতে হবে। যাই হোক, সেল ফোন সেল টাওয়ার বা মোবাইল টাওয়ারের উপর ভিত্তি করে কাজ করে, সেল ফোনের মধ্যে ছোট্ট এন্টেনা এবং ট্রান্সমিটার লাগানো থাকে, যেটা সবচাইতে কাছের সেল ফোন টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ করে এবং টাওয়ার থেকে সিগন্যাল নিয়ে কাজ করে। যখন আপনি বাসের মধ্যে থাকেন বা এরিয়া পরিবর্তন করেন, আর সেল ফোন একটি টাওয়ার থেকে আরেকটি টাওয়ারে সুইচ করে, বিশেষ করে যে টাওয়ার থেকে সবচাইতে বেস্ট সিগন্যাল পাওয়া যায় সেই টাওয়ারের সাথে কানেক্ট হয়ে কাজ করে।

এখন মোবাইল জ্যামার গুলো এই ধর্মের উপরই সুবিধা লাভ করে, যেহেতু সেল ফোন গুলো অলওয়েজ স্ট্রং সিগন্যাল ট্রান্সমিট করা টাওয়ার থেকে সিগন্যাল গ্রহণ করে তাই জ্যামার গুলো টাওয়ারের হুবহু সিগন্যাল তৈরি করে এবং যেহেতু টাওয়ার থেকে জ্যামারই ফোনের কাছে থাকে তাই ফোন টাওয়ারের সিগন্যাল গ্রহণ না করে জ্যামার থেকে আসা সিগন্যাল গ্রহণ করে কাজ করতে চায়, আর সেল ফোন কমিউনিকেশন কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়। টাওয়ারের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির হুবহু রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি তৈরি করে জ্যামার গুলোর করা অ্যাটাক কে ডিনায়াল-অফ-সার্ভিস অ্যাটাক বলা হয়ে থাকে।

শুধু জ্যামার একই সিগন্যালই জেনারেট করে না বরং সিগন্যালের পাওয়ার অনেক গুন বাড়িয়ে দেয়, এতে দুইটি সিগন্যাল একে অপরের সাথে জ্যাম বাঁধিয়ে দেয় এবং একটি সিগন্যাল অপর সিগন্যালের সাথে কান্সেল হয়ে যায়। সেলফোন হচ্ছে ফুল-ডুপ্লেক্স ডিভাইজ, অর্থাৎ এটি দুইটি আলাদা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সিকে একসাথে কাজে লাগায়, একটি ফ্রিকোয়েন্সি কথা রিসিভ করে এবং আরেকটি ফ্রিকোয়েন্সি কথা সেন্ড করে, এবং কাজটি একই টাইমে সঠিকভাবে করার জন্যই এই দুই আলাদা ফ্রিকোয়েন্সি প্রয়োজনীয় হয়ে থাকে।

কিছু জ্যামার এক সাথে দুইটি সিগন্যালই জ্যাম করে আবার কিছু জ্যামার জাস্ট একটি সিগন্যাল জ্যাম করে। অনেক সেল ফোন যখন লক্ষ্য করে একটি সিগন্যাল কাজ করছে না সেক্ষেত্রে নো নেটওয়ার্ক বলে ডিসপ্লে করে, আবার অনেক মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে একটি সিগন্যাল ব্লক হয়ে যাওয়াতে অন্য সিগন্যালটি এমনিতেই কাজ করা বন্ধ করে দেয়। যেমন- আপনি যদি আপনার ইন্টারনেট কানেকশনের আপলোড সম্পূর্ণ ব্লক করে দেন, সেক্ষেত্রে ডাউনলোডও স্বয়ংক্রিয় ব্লক হয়ে যাবে।

সেলফোন জ্যামার কাজ করানোর জন্য অবশ্যই জ্যামার থেকে সঠিক ফ্রিকোয়েন্সি ট্রান্সমিট করতে হবে। বিভিন্ন দেশের টাওয়ারে বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হয়, জিএসএম নেটওয়ার্ক সিস্টেমে বিশেষ করে ৯০০ মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সি এবং এশিয়ান দেশ গুলোতে ১৮০০ মেগাহার্জ (১.৮ গিগাহার্জ) ব্যান্ড ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সিগন্যাল জ্যামার ডিভাইজ গুলো যেকোনো টাইপের নেটওয়ার্কের উপর কাজ করতে পারে, যেমন- সিডিএমএ, টিডিএমএ, জিএসএম, ডিসিএস – ইত্যাদি।

সিগন্যাল জ্যামারের গঠন

ব্যাস্তবিকভাবে, এই অসাধারণ কাজের ডিভাইজটির গঠন একেবারেই স্বাভাবিক। এর মধ্যে এন্টেনা লাগানো হয়েছে আর ডিভাইজটি অন-অফ করার জন্য রয়েছে সাধারণ সুইচ, কমপ্লেক্স ডিভাইজ গুলোতে একাধিক ফ্রিকোয়েন্সি সিগন্যাল ট্রান্সমিট করার জন্য রয়েছে একাধিক সুইচ। এর এন্টেনা সিগন্যাল সেন্ড করার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে, পোর্টেবল ডিভাইজ গুলোতে বিল্ডইন অ্যান্টেনা লাগানো থাকে কিন্তু বড় জ্যামিং ডিভাইজ গুলোতে এক্সটার্নাল এন্টেনা লাগানো থাকে যাতে হিউজ কভারেজ দেওয়া সম্ভব হয়।

এর প্রধান সার্কিট গঠনে থাকে, ভোল্টেজ-কন্ট্রোলড অসিলেটর (Voltage-controlled oscillator) যেটা রেডিও সিগন্যাল জেনারেট করে এবং সেল টাওয়ারের সিগন্যালকে জ্যাম করে দেয়। তাছাড়া এতে থাকে টিউনিং সার্কিট (Tuning circuit), যেটার সাহায্যে নানান টাইপের ফ্রিকোয়েন্সি তৈরি করে নানান টাইপের নেটওয়ার্ক সিগন্যাল জ্যাম করা যায়। এর মধ্যে নয়েজ-জেনারেটর (Noise generator) থাকে, এটি এলোমেলো ইলেকট্রিক সিগন্যাল আউটপুট তৈরি করে, যেটা টাওয়ার সিগন্যালের সাথে প্যাঁচ বেধে যায়, এবং এর মধ্যে একটি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যামপ্লিফায়ার থাকে যেটা সিগন্যাল পাওয়ার বুস্ট করতে সাহায্য করে যাতে, যথেষ্ট শক্তিশালী সিগন্যাল তৈরি করে সেল ফোনকে ধোকা দেওয়া যায়।

ছোট এবং পোর্টেবল জ্যামার গুলোতে সাধারণ ব্যাটারি পাওয়ার প্রদান করে, অনেক জ্যামার সেলফোন ব্যাটারি ব্যবহার করে কাজ করে। বড় সিগন্যাল জ্যামার গুলোর বড় ব্যাটারি বা এক্সটার্নাল পাওয়ার সোর্স প্রয়োজনীয় হয়।

সেল ফোন জ্যামারের ব্যবহার এবং বৈধ/অবৈধতা

মোবাইল জ্যামার ডিভাইজ বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিলো সরকারী আর্মিদের ব্যবহারের জন্য। ক্রিমিন্যাল এবং আতঙ্কবাদীদের প্রতিরোধ করার জন্য সিগন্যাল জ্যামার ব্যবহার করা হতো। সিনেমাতে হয়তো দেখে থাকবেন, আতঙ্কবাদী’রা মোবাইল ট্রিগার বম লাগিয়ে আসে তারপরে মোবাইলে কল দিলেই বম ব্লাস্ট হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে সেল জ্যামার বিশেষ কাজে লাগতে পারে। তাছাড়া আরো অনেক টাইপের আইনি কাজে ইগ্নাল জ্যামার ব্যবহার করা যেতে পারে।

আর বর্তমানে এটি একটি কমন ডিভাইজে পরিণত হয়েছে মানে পাবলিকও এই ডিভাইজ ব্যবহার করতে পারে, বিশেষ করে মসজিদ, রেস্টুরেন্ট, হোটেল বা এমন কোম্পানি যারা অফিসের মধ্যে সেল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে রাখে, তারা এই ডিভাইজ ব্যবহার করতে পারে।

ইউএস, ইউকে, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি সহ অনেক দেশে সেল ফোন সিগন্যাল জ্যাম করা আইনত অপরাধ মূলক কাজ। বাংলাদেশে এটি ওপেনভাবে কেনা যাবে না, সেক্ষেত্রে অবশ্যই অবৈধ হবে তবে কারণে বা প্রয়োজনে বিটিআরসি থেকে অনুমতি নিয়ে কেনা যেতে পারে। তবে অবশ্যই সীমিত এরিয়ার মধ্যে সিগন্যাল জ্যামার চালাতে হবে, আপনি যদি বিরাট এরিয়া জুড়ে সেলফোন জ্যামার ইউজ করেন সেক্ষেত্রে সেটা অবৈধ হবে।

তো এই ছিল, মোবাইল সিগন্যাল জ্যামার নিয়ে বেসিক সকল তথ্য গুলো। আপনি এখন জানলেন এই ডিভাইজটি ঠিক কিভাবে কাজ করে, যদি আপনিও একটি কিনতে চান সেক্ষেত্রে অবশ্যই প্রয়োজনীয় অনুমতির প্রয়োজন পড়বে, ৫-১০হাজার টাকা খরচ পড়তে পারে, তবে সেটার খরচ আপনার প্রয়োজনীয় রেঞ্জিং হিসেবে আরো কমতে বা বাড়তে পারে। তাছাড়া এই ব্যাপারে আরো বিস্তারিত কোন প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories