আমাদের পৃথিবী থেকে থেকে ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা সর্বদা আমাদের চারিদিকে ঘূর্নায়মান প্রিয় সাথী হল আমাদের পৃথিবীর প্রাকৃতিক উপগ্রহ তথা ন্যাচারাল স্যাটেলাইট চাঁদ; আর প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর ধরে এই চাঁদ আমাদের সাথে রয়েছে। সৌরমন্ডল সহ বিশ্বজগৎ এর আরো প্রচুর গ্রহ রয়েছে যাদের কিনা অনেকগুলো করে প্রাকৃতিক উপগ্রহ রয়েছে, তবে আমাদের এই কেবল একটিমাত্রই উপগ্রহ রয়েছে যেটি হল ‘চাঁদ’। রাতের আকাশের দিকে যখন আমরা তাকাই তখন স্বাভাবিক ভাবেই আমরা অনেক তারা দেখতে পাই ; আর তারা সকলের মাঝে জ্বল জ্বল করে আমাদের এই প্রানের উপগ্রহ ; আর এই উপগ্রহ চাঁদকে আমরা সবাই সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবেই মানি। কাল্পনিক অর্থে চাঁদকে আমরা উচ্চতার শিখরে নিয়ে গেলেও বাস্তবিক অর্থে আমরা এই চাঁদকে মোটেও গুরুত্ব দেইনা ; আর বাস্তবিক অর্থে চাঁদ যে আমাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা কেবল হয়ত চাঁদ একবার আমাদের থেকে হারিয়ে গেলেই হয়ত বুঝতে পারব।
শত মিলিয়ন বছর আগে চাঁদ যখন ছিল না, তখন পৃথিবী কেবল সূর্যকে প্রদক্ষিণ করত। এবং তখন পৃথিবীতে বর্তমানের মত এমন জীবের বিচরনও ছিলনা,পৃথিবী ছিল এক অবসবাসযোগ্য গ্রহ। তবে আমাদের জন্য কোনো এক সৌভাগ্যপূর্ন মহাজাগতিক সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় চাঁদের; মঙ্গল গ্রহের সমান একটি গ্রহ এসে সজরে আমাদের পৃথিবীর সাথে ধাক্কা খায়। আর এতে করে সেই গ্রহের সাথে সাথে আমাদের পৃথিবীর কিছু অংশ চূর্ন বিচূর্ণ হয়ে পৃথিবীর চারিদিকে অসংখ্য টুকরো হয়ে ঘুরতে থাকে। এটা ছিল সেই মূহুর্ত যখন কিছু ভয়ংকর ঘটে সৃষ্টি হচ্ছিল সুন্দর কিছু। অতঃপর পৃথিবীর মধ্যাকর্ষন এর কারনে কনাগুলো একত্র হয়ে পৃথিবীর ৫০ গুন ছোট একটি গ্রহের মত আকার ধারন করে আর যাকে আমরা বলি চাঁদ। চাঁদ সৃষ্টির আগে বস্তুত পৃথিবীতে কোনো জীব তথা প্রানীজগত ছিল না। চাঁদ সৃষ্টির পরেই পৃথিবীতে প্রানের আবির্ভাব ঘটে আর সেকারনেই বলা হয় চাঁদ পৃথিবীতে প্রান সৃষ্টির উপযোগী পরিবেশ তৈরির জন্য অনেকাংশে দ্বায়ী।
যেহেতু পৃথিবীর পানির ইকোসিস্টেম এর একটি বড় অংশ সমুদ্রের পানির ওপর চাঁদের অনেক বড় আধিপত্য রয়েছে, সেকারনে চাঁদকে পৃথিবীর একটি মহাজাগতিক চৌম্বক বললে ভুল হবেনা। আর পৃথিবীর উপ বৃত্তাকার কক্ষপথকে কেন্দ্র করে চাঁদের অবিরত ঘোরার সাথে জোয়ার-ভাটার অতপ্রত সম্পর্ক রয়েছে। তাই বলা যায় চাঁদ আমাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ারও অন্যতম কারন হতে পারে ; যদি এটির কিছু হয়। পৃথিবীর যে অংশ দিয়ে চাঁদ প্রদক্ষিণ করে সেখানকার পানির উচ্চতা অন্য স্থানের পানির উচ্চতার চাইতে অনেক বেশি ; এভাবে চাঁদ ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী পৃষ্ঠে সমুদ্রের পানি আটকে রাখতে সহযোগিতা করে। এভাবে সূর্যও মহাকর্ষীয় বলে পৃথিবী পৃষ্ঠকে চাঁদের মত আকর্ষন করে তবে তা চাঁদের তুলনায় অনেক কম। অনেকে বলবেন সূর্য এত বড় তো চাঁদের তুলনায় এর বল কম হবে কেন? এর কারন হল এর দূরত্ব, চাঁদের তুলনায় সূর্যের দূরত্ব পৃথিবী থেকে আরও ৪০০ গুন বেশি হওয়াই আকর্ষন কম হওয়ার মূল কারন।
কাল্পনিক অর্থে চাঁদকে আমরা উচ্চতার শিখরে নিয়ে গেলেও বাস্তবিক অর্থে আমরা এই চাঁদকে মোটেও গুরুত্ব দেইনা ; আর বাস্তবিক অর্থে চাঁদ যে আমাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা কেবল হয়ত চাঁদ একবার আমাদের থেকে হারিয়ে গেলেই হয়ত বুঝতে পারব।
সামদ্রিক অবস্থা ও পৃথিবীর ভারসাম্যের বিপর্যয় ঘটবে
আমার এর আগের পৃথিবীর আহ্নিক গতি থেমে গেলে কি হবে আর্টিকেলেও পড়েছেন সুনামির কথা। আসলে সুনামি পৃথিবীর জন্য একটি কমন প্রাকৃতিক দূর্যোগ। যাই হোক, চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার সময় চাঁদ এবং সূর্য পৃথিবীর দুটি একদম দুপাশে অবস্থান করে ; চাঁদ নিজে ঘুরে এর অবস্থান তো ঠিক রাখেই। পাশাপাশি সূর্যের সাথে পৃথিবীর অবস্থান ঠিক রাখতে কাজ করে পৃথিবীর আহ্নিক গতি। চাঁদ যখন এপাশ থেকে পৃথিবীর সমুদ্রের পানিকে আকর্ষন করছে ; তখন সে স্থানের পানি ফুলে অনেক বেশি উচ্চতা উঠছে। ঠিক বিপরীত পাশে বা একে এর প্রতিপাদ স্থানও বলা যেতে পারে। সেখানে সূর্য আরেকটু কম মহাকর্ষীয় আকর্ষন বলের সাহায্যে সেখানকার পানিও আকর্ষন করে আছে ; এতে করে দুদিক থেকে পানির ভারসাম্য ঠিক থাকছে।
তবে একপাশে যদি চাঁদ না থাকত তাহলে কি হত? তখন সূর্যের আকর্ষনের কারনে সে পাশের পানি ফুলে উঠে বিশাল প্রায় ২৫০-৩০০ ফুট বড় ঢেউ হয়ে জনপদের ওপর আছড়ে পড়ত। যার ফলে আমরা দেখতে পেতাম ইতিহাসের সবচাইতে বড় এবং ভয়াবহ সুনামি। আর নিশ্চিত বাংলাদেশের মত নিচু দেশও এর কারনে হয়ত সমুদ্র তলে চলে যেত। এরপর সমুদ্রের স্রোতধারার মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। এতে করে পৃথিবীর কেন্দ্রাতিক বল আর ঠিক থাকবে না, যার ফলে বলতে গেলে পৃথিবীর ভারসাম্যও স্থির থাকবে না। পৃথিবী যেহেতু চাঁদ এবং সূর্যের মহাকর্ষীয় বলের কারনে তার কক্ষপথে স্হির ভাবে বসে সূর্যকে প্রদক্ষিন করছে। তবে চাঁদ না থাকলে পৃথিবীর ভেতরকার এই স্থিতিশীল গতি কাজ করত না। আর পৃথিবী নিজের কক্ষপথ এর ভেতরই নড়াচড়া করত।
পৃথিবীতে ঋতুচক্র থাকবে না
এখন যেমন বর্ষাকাল,গ্রীষ্মকাল এমনকি শীতকাল এর যে প্রবাহ রয়েছে তখন পৃথিবীর এরূপ অসাম্য অবস্থার কারনে তা আর স্থায়ী থাকবেনা। নির্দিষ্ঠ কোনো ঋতুর সময় থাকবে না। আর তাপমাত্রা এখনই ৯০ ডিগ্রী হলে সকালে হয়ত তা হয়ে যাবে -৫০ ডিগ্রী। অর্থাত কখনও অত্যাধিক ঠান্ডা হবে আবার কখনও হবে অত্যাধিক গরম তার কোনো ঠিক-ঠিকানা থাকবে না। আর আমাদের মহাকাশ বিষয়ক বিগত অনেক আর্টিকেল থেকে হয়ত জানতে পারবেন যে, মঙ্গলেও ঠিক এরকমই হয়ে থাকে।
প্রানীজগত বিলুপ্ত হয়ে যাবে
একেতে সমুদ্রের এইরকম পরিস্থিতে ব্যাপক ভারসাম্য জনিত ক্ষতি হবে। তারওপর সমুদ্রের ভেতর থাকা নানারকম প্রানীজগতের একই রকম পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে অনেক বেশি অভিযোজন করতে হবে। আর যার অভাবে অনেক দূর্বল প্রজাতি হয়ত আর বেঁচেই থাকতে পারবে না। অনেক সামুদ্রিক প্রানী কেবল মাত্র রাতে চাঁদের আলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে অল্প আলোতে শিকারে বের হয় ; তারা আর তাদের খাদ্য আহরন করতে পারবে না। ভূপৃষ্ঠের অস্থিতিশীল অবস্থার কারনে মানুষ সহ আরো নানারকম জীবজাতি খুব সহজেই বেঁচে থাকার অযোগ্য হয়ে পড়বে। তবে সে সময় যদি এরকম পরিস্থিতি এর সাথে মানুষ বা যেকোন জীব খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তবে তারা হয়ে উঠবে বর্তমান সময়ের চাইতে বহু গুন বেশি শক্তিসালী।
এখন কথা হল, এতক্ষন চাঁদ কি আর চাঁদ ধ্বংস হলে কি কি হবে সে বিষয়েই তো বললাম, তো এবার কথা হল চাঁদকে কি আসলেই ধ্বংস করা সম্ভব? এর খুবই সহজ উত্তর হল ‘হ্যা’। চাঁদকে কেবল হলিউড মুভিতেই নয় বাস্তবেও বিস্ফোরন করিয়ে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। আর আপনি জেনে অবাক হবেন যে, আমেরিকা পারমানবিক শক্তি ব্যবহার করে আসলেই পৃথিবীকে ধ্বংস করা সম্ভব কিনা তা পরীক্ষা করতে চাঁদকে পারমানবিক বিস্ফোরনের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তবে তার ভয়াবহ পরিনতি এর কথা চিন্তা করে তা আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। আশা করি আজকের আর্টিকেলটি আপনার ভালো লেগেছে ; আর ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত অবশ্যই কাম্য। কি হবে, যদি সূর্য হঠাৎ করে হারিয়ে যায়?
Images: Shutterstock.com