গরিলা গ্লাস কি, কিভাবে কাজ করে? — আপনার যে তথ্য গুলো জানা প্রয়োজনীয়!

যদি কয়েক বছর পেছনের কথা চিন্তা করা হয়, পার্সোনাল কম্পিউটার মোটেও পোর্টেবল কোন ডিভাইজ ছিল না আর সেলফোন ও আজকের মতো প্রসাধনী আর প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ডিভাইজ ছিল না। কিন্তু আজকের দিনে, কম্পিউটার, সেলফোন, সহ নানান টাইপের ইলেকট্রনিক আমাদের কাছে খেলানার ন্যায় পরিণত হয়েছে, আর আমাদের আজকের এই খেলনার জিনিষ গুলো অবশ্যই পোর্টেবল! আমাদের আজকের ডিভাইজ গুলো শুধু পোর্টেবলই নয়, সাথে বছরের পর বছর ধরে আরো এবং আরো বেশি উন্নতি লাভ করছে। স্মার্টফোনের প্রসেসর গুলো আগের থেকে আরো এবং আরো বেশি ফাস্ট হচ্ছে, ক্যামেরা টেকনোলোজিতে আনা হয়েছে অস্বাভাবিক পরিবর্তন, ডিভাইজ গুলো ডিসপ্লে দিনের পর দিন আরো বেশি চকচকে ও স্পন্দনশীল হয়ে উঠছে!

আজকের দিনে অনেক টেক কোম্পানি রয়েছে, যারা সর্বদা নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং টেকনোলোজির পেছনে সম্পূর্ণ সময় ব্যয় করছে। কিন্তু আরেকটি জিনিষের প্রতিও অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে — গরিলা গ্লাস (Gorilla Glass) — যেটার উন্নতি হয়তো আপনি চোখে দেখে বুঝতে পারবেন না, কিন্তু দিনের পর দিন এটি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে আর আপনার ডিভাইজের হয়ে নিজে অত্যাচার সহ্য করার জন্য সর্বদা রেডি রয়েছে।

আজকের প্রত্যেকটি মডার্ন ডিভাইজে গরিলা গ্লাসকে প্রোটেকশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সেটা হোক কম্পিউটার স্ক্রীন, স্মার্টফোন স্ক্রীন, বা আলাদা যেকোনো গাজেটের স্ক্রীন। — কিন্তু কি রয়েছে এই গরিলা গ্লাসে? কেন এটি এতো শক্তিশালী? কেন গরিলা গ্লাস ব্যবহার না করে আলাদা টাইপের গ্লাস ব্যবহার করা হয় না? বা কিভাবেই এই শক্তিশালী গ্লাসটি কাজ করে? — যদি এই প্রশ্ন গুলো এতোদিন আপনাকে জ্বালিয়ে থাকে তো এই আর্টিকেলই সকল জ্বলনের অবসান হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে।


গরিলা গ্লাস কি?

গরিলা একটি স্পেশাল টাইপের গ্লাস বা কাচ যা করনিং আইএনসি (Corning Inc) কোম্পানি দ্বারা প্রস্তুতকৃত এবং যেটাকে বিশেষ করে স্মার্ট ডিভাইজ গুলো, যেমন- ল্যাপটপ, মনিটর, স্মার্টফোন, টিভি ইত্যাদির স্ক্রীন প্রটেক্ট করার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনেক সায়েন্স ফিকশন মুভিতে দেখে থাকবেন, ভুল সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট থেকে সুপার হিরো তৈরি হয়ে যায়, গরিলা গ্লাসের ইতিহাস অনেকটা একই রকমের। ১৯৫২ সালের দিকে, করনিং কোম্পানির এক বিজ্ঞানী এক টুকরা ফটো-সেন্সিটিভ গ্লাসকে পরীক্ষা চালানোর জন্য চুল্লিতে রেখে দেয়, একসময় চুল্লির তাপমাত্রা ৬০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ৯০০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে উঠে যায়, বিজ্ঞানী এতে আশা করেন টেস্টিং স্যাম্পলটি হয়তো ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন আশ্চর্যজনকভাবে এটি সম্পূর্ণ আলাদা টাইপের একটি মেটালে পরিণত হয়েছে, এরপরে নমুনাটি হঠাৎ করে পরে যায়, আর পরে যাওয়ার পরে কাচটি ভেঙ্গে আলাদা না হয়ে গিয়ে মেঝে থেকে লাফিয়ে উপরে উঠে আসে।

এভাবেই এমন একটি নতুন ম্যাটেরিয়ালের জন্ম নেয় যেটা ঐ যুগের সবচাইতে শক্তিশালী গ্লাস ছিল, যেটা অ্যালুমিনিয়াম থেকে অনেক পাতলা, সাধারণ গ্লাসের তুলনায় অনেক শক্তিশালী এবং ষ্টীলের মতো কঠিন ছিল। তো এটা হচ্ছে একেবারেই প্রথমের গল্প, মানে গরিলা গ্লাসের ঠিক যখন জন্ম হয়েছিল। আজকের দিনের গরিলা গ্লাসের কথা অনেক আলাদা, এতে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে আর এটি আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী বর্তমানে।

১ম জেনারেশন করনিং গরিলা গ্লাস ২০০৮ সালে তৈরি করা হয় এবং পরে ২০১২, ২০১৩, এবং ২০১৪ সালে এর টেকনোলোজিতে অনেক উন্নতি আনা হয় (যথাক্রমেঃ দ্বিতীয়, তৃতীয়, এবং চতুর্থ জেনারেশন গ্লাস তৈরি করা হয়)। ২০১৬ সালের জুলাই মাসের দিকে এই গ্লাসের ৫ম জেনারেশন রিলিজ করা হয়।

গরিলা গ্লাস কিভাবে কাজ করে?

করনিং তাদের এই নতুন টাইপের গ্লাসকে তৈরি করেছে, যেটার আসল নাম বলতে পারেন, “অ্যালুমিনোসিলিকেট (Aluminosilicate)” — সাধারণ যেকোনো গ্লাসের মতো এটিও তৈরি করা হয় মূল উপাদান বালু বা স্যান্ড থেকে। তাছাড়া এই গ্লাসে ব্যবহার করা হয় অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, এবং অক্সিজেন। গ্লাসটির প্রয়োজনীয় মডেল তৈরি করে নেওয়ার পরে একে ৪০০ ডিগ্রী সেলসিয়াসেরও বেশি তাপমাত্রার গলিত লবণ মিশ্রণের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়, এখন এর মধ্যে অনেক টাইপের বৈজ্ঞানিক বিক্রিয়া চলতে থাকে যেগুলোকে ঠিকঠাক বর্ণনা করলে সম্পূর্ণই আপনার মাথার উপর দিয়ে চলে যাবে, তাই সহজভাবে জেনে রাখুন, এই প্রসেসটি চলার ফলে একই যায়গার মধ্যে অনেক বড় সাইজের আয়ন আঁটানো হয়, এতে গ্লাসের ঘনত্ব অনেক বেড়ে যায়। আর এর ফলেই গরিলা গ্লাস শক্তিশালী এবং আরো নমনীয় হয়ে উঠে।

আপনি হয়তো আগে ভাবতেন, এই টাইপের গ্লাস হয়তো ফ্যাক্টরিতে বিশেষ গবেষণা করে তৈরি করা হয়, কিন্তু সত্য ব্যাপারটি হচ্ছে এর তৈরির সকল প্রকারের উপাদান গুলো প্রকৃতি থেকেও পাওয়া। কতিপয় টাইপের পাথর এবং খনিজ পদার্থ অত্যন্ত তাপমাত্রার ফলে গ্লাসে পরিণত হয়ে যেতে পারে। প্রাকৃতিকভাবেও অনেক গ্লাস তৈরি হয়, যেমন লাভা বয়ে যাওয়ার সময় বা যদি বজ্রপাত মাটি আঘাত করে সেই সময়ে গ্লাস তৈরি হয়ে যেতে পারে।

সাধারণ অ্যালুমিনোসিলিকেট আপনার স্মার্টফোনের স্ক্রীন প্রটেক্টর হিসেবে সহজেই কাজে লাগাতে পারবেন, কিন্তু সেটা কখনোই গরিলা গ্লাসের মতো শক্তিশালী, আঁচর প্রুফ, আর নমনীয় হবে না। করনিং তাদের গ্লাসকে গলিত লবণ স্ন্যান করিয়ে এর মধ্যে অনেক টাইপের গুন বিদ্যমান করিয়ে দেয়। আর সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে এই গ্লাসটি রিসাইকেলেবল, মানে এটিকে যেভাবেই তৈরি করা হোক না কেন, তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক নয়।

আরো কিছু তথ্য

অনেকের মনে চিন্তা থাকতে পারে, এই গ্লাসের নাম এমন কেন হলো বা এর কি বিশেষ কোন অর্থ রয়েছে? — মূলত এখানে “গরিলা” নাম থেকে “এটি গরিলার ন্যায় শক্তিশালী” এরকম ছাড়া আর বিশেষ কোন অর্থ বোঝানো হয় না। তবে মোবাইল ডিভাইজে গরিলা গ্লাস ব্যবহার প্রচলন শুরু হওয়ার পেছনে এক ইতিহাস রয়েছে। ২০০৬ সালের দিকে অ্যাপেলের মালিক স্টিভ জবস এবং অ্যাপেলের কর্মকর্তারা তাদের নতুন আইফোনের প্রোটোটাইপ নিয়ে কাজ করছিলেন, এই সময় তারা লক্ষ্য করেন, মোবাইলের প্ল্যাস্টিকের স্ক্রীন সহজেই যেকোনো মেটাল এর আঁচরে দাগে ভরপুর হয়ে যেতে পারে, তাছাড়া ফোন হাত থেকে পরে গেলে আর রেহায় নেই। এই অবস্থায় স্টিভ করনিং কোম্পানির উদ্দেশ্যে একটি মেইল সেন্ড করেন এবং করনিং কোম্পানি নতুন ডিভাইজের জন্য নতুন টাইপের এই গ্লাস কন্সেফট এর উপর কাজ করতে শুরু করে। তাদের কোনই আইডিয়া ছিল না আসলে কি টাইপের এবং কিভাবে এই গ্লাস তৈরি করা যেতে পারে, কিন্তু এদিকে অ্যাপেলের তার ফোন বের করার সময় ঘনিয়ে আসছিলো, এতে করনিং কোম্পানি একটি প্রজেক্ট রিস্ক গ্রহণ করে, যেটার নাম দেওয়া হয়েছিল প্রজেক্ট গরিলা গ্লাস, আর এভাবেই এর নামকরন করা হয়েছিল।

অনেকেই কিন্তু আরেকটি তথ্য জানেন না, সেটা হচ্ছে গরিলা গ্লাসেরও কিন্তু অল্টারনেটিভ মানে বিকল্প গ্লাস রয়েছে। সবচাইতে বেস্ট বিকল্পটি হচ্ছে, আসাহি গ্লাস কোম্পানির ড্রাগনটেইল গ্লাস, যেটা অনেকটা গরিলা গ্লাসের অনুরুপ টেকনোলোজির উপর ভিত্তি করে বানানো এবং অনেক স্মার্টফোন কোম্পানি যেমন- সনি, স্যামসাং, জলো, এটি ব্যবহারও করে। আরেকটি বিকল্প হচ্ছে সাফায়ার স্ক্রীন (Sapphire), অ্যাপেল ওয়াচে সাফায়ার স্ক্রীন ব্যবহার করা হয়েছে।

আজকের স্মার্টফোন গুলোতে সত্যিই অনেক চমৎকার ডিসপ্লে ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু গরিলা গ্লাস ছাড়া এই ডিসপ্লে গুলোতে নিমিষের মধ্যেই বিভিন্ন আঁচর, দাগ বা হাত থেকে পরে স্ক্রীন ভেঙ্গে যেতে পারে আর এটা স্বীকার করতেই হবে কয়েক বছর ধরে করনিং এর এই বিশেষ গ্লাস অসাধারণ জব করে আসছে। আর আজকের এই আর্টিকেলটি থেকে জানলেন, কিভাবে এই কাগজের মতো পাতলা গ্লাসটি এতোদিন ধরে আপনার স্মার্ট ডিভাইজ গুলোকে বিভিন্ন প্রকারের নির্যাতন থেকে রক্ষা করে আসছিল।

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories