ক্লাউড গেমিং কি এবং কিভাবে কাজ করে? এটা কি সত্যিই গেমিং এর ভবিষ্যৎ?

আপনি যদি গেমার হয়ে থাকেন অথবা গেমিং নিয়ে হালকা কিছু ইন্টারেস্টও থেকে থাকে, তাহলে আপনি হয়তো অনেকবার ক্লাউড গেমিং টার্মটি শুনেছেন। ক্লাউড গেমিং বিষয়টি অনেকটা ভিডিও স্ট্রিমিং এবং ক্লাউড কম্পিউটিং এর মতো। অর্থাৎ, এগুলো একই জিনিস না হলেও এগুলো যেভাবে কাজ করে সেই টেকনোলজিটি অনেকটা একইরকম। এবং ক্লাউড গেমিং এর এই সম্পূর্ণ কনসেপ্টটি এতোটাই ইনোভেটিভ যে, অনেকের মতে এটাই হবে সবধরনের গেমিং এর ভবিষ্যৎ। তবে তা কতটা সত্যি এবং কিভাবেই বা কাজ করে এই ক্লাউড গেমিং? আজকে এই বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করবো।


ক্লাউড গেমিং

যেমনটা বললাম, ক্লাউড গেমিং এর বিষয়টি অনেকটা ভিডিও স্ট্রিমিং এবং ক্লাউড কম্পউটিং এর সাথে সম্পর্কিত। এক্ষেত্রে সহজ ভাষায় বলা যায় যে, ক্লাউড গেমিং হচ্ছে এমন একটি সিস্টেম যেখানে কোন একটি ক্লাউড গেমিং সার্ভার কোন একটি গেম রান করে এবং সেই গেমটির গেমপ্লে মুলত একটি ভিডিওর মতো করে স্ট্রিম করা হয় অন্য কোন একটি রিমোট কম্পপিউটার বা ডিভাইসে।

তবে গেমের ইনপুটগুলো অর্থাৎ গেমপ্যাডের কিস্ট্রোক, কিবোর্ডের কিস্ট্রোক, মাউসের ক্লিক ইত্যাদি সবকিছু রিমোট ডিভাইস থেকে সার্ভারে পাঠানো হয়। অর্থাৎ, ক্লাউড গেমিং হচ্ছে মূলত কোন একটি শক্তিশালী গেমিং সার্ভারে কোন গেম রান করা এবং গেমটিকে খেলা বা গেমটিকে কনট্রোল করা নিজের পিসির বা নিজের অন্য কোন ডিভাইসের সামনে বসেই।

কিভাবে কাজ করে?

ক্লাউড গেমিং ঠিক নিজের কম্পিউটারে বসে অন্য কোন কম্পিউটারে গেম খেলার মতো!

ক্লাউড গেমিং যেভাবে কাজ করে টার কনসেপ্টটি অনেক সহজ। এখনকার যেকোনো হাই এন্ড গেম খেলতে চাইলে কি ধরনের হার্ডওয়্যার দরকার হয়? হয়তো দরকার হতে পারে কোরআই ৯ এক্সট্রিম এডিশন প্রোসেসর, ৩২ জিবি র‍্যাম আর ধরুন জিটিএক্স ১০৮০ টিআই গ্রাফিক্স কার্ড? যাই দরকার হোক, ধরুন এইসব হাই এন্ড হার্ডওয়্যার ব্যবহার করে একটি হাই এন্ড গেমিং সিস্টেম তৈরি করা হল এবং এই সিস্টেমটিকেই একটি সার্ভার হিসেবে ব্যবহার করা হল যেটাতে কানেক্ট করে মানুষ গেম খেলতে পারবে।

অ্যাকচুয়াল গেমটিকে রান করবে এই হাই এন্ড সার্ভার এবং শুধুমাত্র গেমপ্লের একটি ভিডিও স্ট্রিম করা হবে যে গেমটি খেলছে তার ডিভাইসে। তবে গেমটিকে কনট্রোল করবে সে তার ওই রিমোট ডিভাইসটির সাহায্যেই। ব্যাপারটা ঠিক নিজের কম্পিউটারে বসে অন্য কোন কম্পিউটারে গেম খেলার মতো। এবার নিশ্চই বুঝছেন যে, ক্লাউড গেমিং এর সাথে ক্লাউড কম্পিউটিং এর সম্পর্কটি কি।

ক্লাউড গেমিং এর জন্য বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন ব্যাবস্থা আছে তবে সবগুলোর প্রধান কনসেপ্টটি মূলত একই। তা হচ্ছে, শক্তিশালী কোন রিমোট সার্ভারে কোন গেম রান করা এবং সেই গেমটিকে কনট্রোল করা নিজের ডিভাইস থেকেই। ক্লাউড গেমিং এর জন্য বিখ্যাত জিপিইউ নির্মাতা এনভিডিয়ার নিজস্ব একটি সার্ভিস আছে যার নাম Nvidia Geforce Now। এর সাহায্যে মূলত আপনি ক্লাউড গেমিং টেকনোলজি ব্যবহার করে আপনার লো এন্ড পিসিতেও এবং চাইলে আপনার ম্যাকবুকেও (যদি থাকে) হাই এন্ড পিসি গেমস যেমন GTA V, Fortnite বা PUBG ইত্যাদি এই ধরনের সব হাই এন্ড গেম স্মুথ ৬০ এফপিএস ফ্রেমরেটে খেলতে  পারবেন, যেগুলো ন্যাটিভলি আপনার লো এন্ড পিসিতে রান করারই কথা নয়।

তবে ব্যাপারটা এক্সাইটিং মনে হলেও এতটা এক্সাইটেড হওয়ার মতোও কিছু নেই। কারন, ক্লাউড গেমিং এর কিছু সুবিধা এবং অসুবিধাও আছে। এবার আলোচনা করা যাক ক্লাউড গেমিং এর সুবিধা এবং অসুবিধাগুলো নিয়ে।

ক্লাউড গেমিং এর সুবিধা

ক্লাউড গেমিং এর সুবিধা কি কি থাকতে পারে তা হয়তো আপনি এতক্ষনে আপনি বুঝেই ফেলেছেন। তবুও কয়েকটি মেজর সুবিধাগুলো বলছি-

হাই এন্ড হার্ডওয়্যারের দরকার নেই : ক্লাউড গেমিং এর সময় অ্যাকচুয়াল গেমটি যেহেতু আপনার সিস্টেমে রান হচ্ছে না, বরং পাওয়ারফুল ক্লাউড সার্ভারে রান হচ্ছে, তাই এমন কোন কথা নেই যে আপনার পিসিটিকে হাই এন্ড হতে হবে। কারন, আপনার পিসিকে শুধুমাত্র ক্লাউড সার্ভারে রান হওয়া গেমটির গেমপ্লেকে একটি ভিডিও হিসেবে স্ট্রিম করতে হচ্ছে। আপনি চাইলে আপনার ডুয়াল কোর এবং ২ জিবি র‍্যামের ল্যাপটপেও মডার্ন সব হাই এন্ড গেম স্মুথলি খেলতে পারবেন ক্লাউড গেমিং এর সাহায্যে।

ক্রস প্লাটফর্ম গেমিং সুবিধা : ক্লাউড গেমিং এর ক্ষেত্রে আপনার সিস্টেমটিকে যেহেতু সম্পূর্ণ গেমটিকে রান করতে হচ্ছেনা, বরং শুধুমাত্র গেমপ্লের একটি ভিডিও স্ট্রিম করতে হচ্ছে মাত্র, তাই এমন কোন বাধ্যতা নেই যে ওই গেমটি আপনার অপারেটিং সিস্টেমে সাপোর্টেড হতে হবে। আপনি চাইলে ক্লাউড গেমিং যেকোনো ডিভাইসের সাহায্যে করতে পারবেন। উইন্ডোজ, ম্যাকবুক, আইম্যাক এবং অনেকক্ষেত্রে স্মার্টফোন এবং স্মার্ট টিভি ব্যবহার করেও ক্লাউড গেমিং উপভোগ করতে পারবেন। সবথেকে জনপ্রিয় গেমিং প্লাটফর্ম স্টিম এমনই একটি ক্লাউড গেমিং অ্যাপ রিলিজ করতে চলেছে অ্যান্ড্রয়েড এবং আইফোনের জন্য।

ইনস্ট্যান্ট প্লেয়িং : অনেক হাই এন্ড গেম অনেকসময় ডাউনলোড হতেই অনেক সময় নিয়ে নেয়। অনেক গেমস খেলতে হলে আগেই ৫০ বা ১০০ জিবি গেম ফাইল ডাউনলোড করতে হয়। তবে ক্লাউড গেমিং এর ক্ষেত্রে এসবের কোন দরকার হয়না যেহেতু যে গেমটি আপনি খেলবেন সেটি আগে থেকেই সার্ভার কম্পিউটারে ডাউনলোড এবং ইন্সটল করা আছে। আপনি জাস্ট সার্ভারের সাথে কানেক্ট করে ইনস্ট্যান্টলি গেমটি খেলা শুরু করতে পারবেন।

ক্লাউড গেমিং এর অসুবিধা

এটাই মূলত ক্লাউড গেমিং খুব বেশি জনপ্রিয় এবং অনেক বেশি ব্যবহার না হওয়ার কারন। ক্লাউড গেমিং এর অনেক প্র্যাক্টিকাল সুবিধা এবং অ্যাডভান্টেজ থাকলেও অনেক অসুবিধাও আছে যেগুলো সম্পূর্ণ ক্লাউড গেমিং এর কনসেপ্টটিকে আনস্ট্যাবল করে দিতে পারে। যেমন-

যথেষ্ট দ্রুতগতির ইন্টারনেট কানেকশন দরকার : আপনি নিজেই ভেবে দেখুন, কোন একটি ক্লাউড সার্ভারে কোন গেম রান করে সেই গেমটির গেমপ্লে আপনার ডিভাইসে স্ট্রিম এবং একইসাথে আপনার ডিভাইসের ইনপুট ডিভাইস ব্যবহার করে সেই গেমটিকে কনট্রোল করতে হলে কতটা দ্রুতগতির ইন্টারনেট কানেকশন দরকার? হ্যাঁ। ক্লাউড গেমিং করতে হলে যথেষ্ট দ্রুতগতির ইন্টারনেট স্পিড, কম লেটেন্সি এবং অনেক ব্যান্ডউইথের দরকার। আপনি ধরেই রাখতে পারেন যে ক্লাউড গেমিং করতে হলে আপনার কমপক্ষে ২০-২৫ মেগবিট/সেকেন্ডের ইন্টারনেট স্পিড এবং আনলিমিটেড ব্যান্ডউইথ দরকার হবে এবং একইসাথে দরকার হবে কম লেটেন্সি। এমন একটি দ্রুতগতির স্ট্যাবল ইন্টারনেট কানেকশন না থাকলে ক্লাউড গেমিং এর কথা ভাবাও উচিত নয়।

ভিডিও কমপ্রেশন : আপনি হয়তো জানেন যে, অনলাইনে ভিডিও স্ট্রিমিং করার সময় প্রত্যেকটি ভিডিওই কিছুটা কমপ্রেস করা হয় বা কোয়ালিটি কিছুটা রিডিউস করা হয় যাতে সেগুলো ভালভাবে স্ট্রিম করা সম্ভব হয়। ক্লাউড গেমিং এর ক্ষেত্রে সার্ভার কম্পিউটার থেকে গেমপ্লের যে ভিডিওটি রিমোট ডিভাইসে স্ট্রিম করা হয় সেই ভিডিওটিও কমপ্রেস করা হয়। এই কম্প্রেশনের ফলে গেমের অরিজিনাল কোয়ালিটি কিছুটা কমে যায়, যা আরেকটু রেসপনসিভ পারফরমেন্স নিশ্চিত করে। তবে ক্লাউড গেমিং এর ক্ষেত্রে আপনি ন্যাটিভ গেমের তুলনায় কিছুটা ভিডিও কোয়ালিটি কম পাবেন যদিও এটি খুব বড় কোন ইস্যু নয়।

পাইরেসি প্রায় অসম্ভব : এটা যদি আপনি ইউরোপিয়ান এবং অ্যামেরিকান কান্ট্রিগুলোর প্রেক্ষাপটে চিন্তা করেন, তাহলে এটা কোন সমস্যাই নয়। কারন, সেসব দেশে ক্র্যাক গেমস খুব কম মানুষই খেলে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে  এটা অনেক বড় সমস্যা বলা যায়। কারন, বাংলাদেশের অধিকাংশ পিসি ইউজারই ক্র্যাক গেমস খেলে থাকেন। তবে হ্যা, ক্লাউড গেমিং এর ক্ষেত্রে পেইড গেম ফ্রিতে খেলা সম্ভব নয়! । ক্লাউড গেমিং করতে চাইলে আপনাকে লেজিট গেমার হতেই হবে। কোন গেম খেলতে চাইলে সেটিকে বৈধভাবে কিনে তারপরেই খেলতে হবে।

ক্লাউড গেমিং কি সত্যিই গেমিং এর ফিউচার?

ক্লাউড গেমিং যথেষ্ট ইনোভেটিভ একটি কনসেপ্ট এবং এটিকে ইম্প্রুভ করা সম্ভব!

ক্লাউড গেমিং এর এতো সুবিধা এবং অসুবিধা জানার পরে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে ক্লাউড গেমিং এর অসুবিধার তুলনায় সুবিধা অনেক বেশি এবং অসুবিধাগুলোকেও খুব সহজেই ফিক্স করা সম্ভব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইন্টারনেট এবং ব্যান্ডউইথের প্রবলেম এখনই ফিক্স করা খুব সহজেই সম্ভব নয়, তবে ইউরোপিয়ান কান্ট্রি যারা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর তুলনায় টেকনোলোজির  দিকথেকে অনেক বেশি অ্যাডভান্সড, সেসব দেশে এসব প্রবলেম ফিক্স করা কোন ব্যাপারই নয়। তবে তবুও ভিডিও কমপ্রেশনের কথা চিন্তা করলে ন্যাটিভ গেমিং এবং ক্লাউড গেমিং এর মধ্যে অনেকটা পার্থক্য থেকেই যায়। তবে এই পার্থক্যগুলোকেও প্রতিনিয়ত উন্নত হতে থাকা টেকনোলজির সাহায্যে কমিয়ে আনা সম্ভব এবং অবশ্যই কমিয়ে আনা হবে।

তবে ক্লাউড গেমিং নিঃসন্দেহেই যথেষ্ট ইনোভেটিভ একটি কনসেপ্ট। এটিকে ভবিষ্যতে আরও বেশি ইম্প্রুভ এবং কনভেনিয়েন্ট করে তোলার অনেক সুযোগ রয়েছে। আর এসবের জন্য এনভিডিয়া এবং স্টিমের মতো বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলো ইতোমধ্যেই অনেক পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে। তাই সবশেষে বলা যায়, হ্যা ক্লাউড গেমিং সত্যিকারেই গেমিং এর ভবিষ্যৎ হতে পারে, তবে তার জন্য অনেকটা সময় দরকার।

Images: Shutterstock.com

About the author

সিয়াম

Add comment

Categories