হঠাৎ পৃথিবীর আহ্নিক গতি বন্ধ হয়ে গেলে কি হবে?

আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন,আমাদের এই পৃথিবীর ওপর চরমতম প্রাকৃতিকবিপর্যয় কি হতে পারে? কেবল কি ভূমিকম্প,ঘূর্নিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এসবই কি পৃথিবীর জন্য চরমতম প্রাকৃতিকবিপর্যয়? এর চেয়ে বেশি কি কিছু হতে পারে না? আজ আমি আলোচনা করবে আমাদের পৃথিবী যদি এর কেবল একটি মহাকর্ষীয় বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে তবে এর কি অবস্থা হবে। আর এই একটি বৈশিষ্ঠ্য হল পৃথিবীর আহ্নিক গতি।

পৃথিবী কেবল যদি তার আহ্নিক গতি হারিয়ে ফেলে, তবে এটি পৃথিবীতে বসবাসরত সমস্তকিছুর জন্য হবে এক ভয়ানক বিপর্যয়।


সবকিছু পূর্ব দিকে অনেক গতিতে উড়ে যেতে শুরু করবে

পৃথিবী তার কক্ষপথে প্রতিনিয়ত যে বেগে ঘুরছে ; সত্যি কথা বলতে তা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারনা নেই। পৃথিবী নিয়মিত নির্দিষ্ট বেগে তার কক্ষপথের ওপর ২৪ ঘন্টা পরপর ঘুরছে বলে আমরা স্থির আছি -স্থির রয়েছে পৃথিবীর সকল বস্তু। তবে হ্যা, এখন হঠাৎ করে যদি পৃথিবী এখনই থেমে যায় তাহলে কি হবে? ব্যাপারটি আমাদের পৃথিবীতে বিচরন করা সমস্ত কিছুর জন্য হবে একদম ভয়ানক। হঠাৎ পৃথিবীর থেমে যাওয়া আমাদের জন্য প্রথমত হবে একটি বড় ধাক্কা। আর এসময় সাথে সাথে পৃথিবীর কোনো বস্তু আর মাটিতে থাকবে না; সবকিছু তীব্র বেগে পূর্ব দিকে উড়ে যেতে শুরু করবে। আর যে গতিতে উড়ে যাবে সে গতিটিও আমরা মানুষের জন্য খুবই ভয়ংকর ; ঘন্টায় ১০০০ মাইল বেগে আমরা সহ সকল কিছু পূর্ব দিকে উড়ে যেতে শুরু করবে। আর সে সময় পৃথিবীর আমাদের ওপর কোন আকর্ষন কাজ করবে না। তবে পৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চলে এই বেগটি হবে কম ; সেখানে হবে ৮০০ মাইল পার ঘন্টা।

দৈত্যকার ঢেউ এর সাথে সমুদ্র উপকূলে ধেয়ে আসবে সুনামি!

হঠাৎ পৃথিবীর গতিবেগ থেমে যাওয়ার ফলে এর আরেকটি ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে আমাদের পৃথিবীর সমুদ্রের সাথে। কেবল আমরা সহ পৃথিবীর সকল বস্তুই নয় ; সমুদ্রের পানি পর্যন্ত পূর্ব দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করবে! এতে করে প্রথমত সকল সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে বিশাল দৈত্যাকার এমন এমন ঢেউ সৃষ্টি হবে ; যেসব ঢেউ ইতিহাসে কেউ কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। যার ফলে সমুদ্র উপকূলের শহর ; উদাহরন হিসেবে বলতে পারি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির মত শহর ধ্বংস তো হয়ে যাবেই ; পাশাপাশি সমুদ্রের পানিতে একদম পরিষ্কারও হয়ে যাবে।

সেকেন্ডে সেকেন্ডে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটবে

পৃথিবীর গতিবেগ থেমে যাওয়ার কারনে, এসময় পুরো পৃথিবীর বায়ুমন্ডল প্রচন্ড গতিবেগের সাথে এর নিজস্ব ভরবেগের সাথে সম্পূর্ণ পৃথিবী পর্যায়ক্রমে ঘুরতে থাকে। পৃথিবীর এই অ্যাটমোসফিয়ার এত জোরে তথা গতিতে ঘুরবে যে পৃথিবীতে সেসময় প্রচন্ড গতিতে বাতাস প্রবাহিত হবে। আর বাতাসের সাথে সাথে কিছুক্ষন পরপর আবহাওয়া পরিবর্তন এর কারনে কোন স্থানে যেখানে যাবে এখনই ঝড়, এখনই বৃষ্টি আবার এখনই তীব্র বেগে বাতাস প্রবাহ।

সমুদ্রের সকল পানি মিলে কেবল দুটি বিশাল সমুদ্র সৃষ্টি হবে

এসময় পৃথিবীর সমুদ্রের সকল পানি দুই মেরুর দিকে চলে যাবে ; আর মাঝখান দিয়ে তৈরি হয়ে যাবে সুবিশাল এক ভূপৃষ্ঠ। আর নতুন তৈরি এই বিশাল কনটিনেন্টটা হবে একদম সোজা ; আগের মত এক কন্টিনেন্ট থেকে আরেক কন্টিনেন্টে যেতে মাঝখানে কোনোরূপ সমুদ্র পড়বে না। কেননা সমুদ্র তো দুপাশে চলে গিয়েছে ; মাঝখানে যা আছে তা কেবল সমতল ভূমি। আর এই ব্যাপারটি হবে পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন। এখানে ঘটনাটি কিছুটা রকম, সমুদ্রের পানিকে লাঠি দিয়ে বাড়ি দেয়া হল আর মাঝখান থেকে পানি সরে গিয়ে এক বিশাল সমতল ভূমি তৈরি হয়ে গেলো।

আগ্নেয়গিরি প্রস্ফুলন,হারিকেন এবং ভূমিকম্প সংগঠিত হবে

পৃথিবীর গতি হঠাৎ থেমে গেলে নানারকম ভয়ানক প্রাকৃতিক দূর্যোগের সূত্রপাত ঘটবে। হঠাৎ পৃথিবী থেমে গেলে গতিবিজ্ঞানের এক বিপরীত প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ পৃথিবীর কেন্দ্রে ভারসাম্য নষ্ট হতে শুরু করবে। আর এতে করে প্রথমত ঘন ঘন তীব্র ভূমিকম্প হতে থাকবে। ভূমিকম্পের পাশাপাশি সেসব স্থানে আগ্নেয়গিরি দেখা যায় ; সেখান থেকে ঘন ঘন অনেকক বেশি পরিমানে আগ্নেয়গিরি প্রস্ফুলিত হতে থাকবে। আগ্নেয়গিরি ধীরে ধীরে অনেক বড় শহরে প্রবেশ করে শহরের যাবতীয় পরিকাঠামোকে ধ্বংস করে দিতে শুরু করবে। তাছাড়াও পৃথিবীর কেন্দ্রাতিক অবস্থার পরিবর্তনের কারনে হারিকেন ঘূর্নিঝড় সৃষ্টি হবে।

পৃথিবী পূর্ন গোলাকার আকৃতিতে রূপান্তরিত হবে

বর্তমানে পৃথিবী সবসময় ঘুরছে বলে ঘোরার সুবিধার্থে পৃথিবীর আকৃতি চ্যাপ্টা। আর পৃথিবীর এই চ্যাপ্টা প্রকৃতির আকৃতিকে বলা হয় জিওয়েড। যেহেতু পৃথিবীর স্পিনিং মোশনের জন্য ছিল তার এই চ্যাপ্টা আকৃতি; তবে যখন পৃথিবী আর ঘুরবে না তখন আর পৃথিবীর এরকম চ্যাপ্টা ভাব আর থাকবে না। সুতরাং পৃথিবী ঘোরা বন্ধ করলে পৃথিবী চ্যাপ্টা থেকে পরিনত হবে পূর্ন গোলাকারে।

গরম হবে কয়েকগুন বেশি, ঠান্ডা হবে কয়েকগুণ বেশি

পৃথিবীর আহ্নিকগতি থেমে গেলে পৃথিবীতে আর ১২ ঘন্টা পরপর একপাশে সূর্য আসবে না। এখানে পৃথিবীকে নির্ভর করতে হবে কেবল তার বার্ষিক গতির অপর। অর্থাৎ ৩৬৫ দিনে যে সূর্যকে প্রদক্ষিন করছে তারওপর। আর সে কারনে পৃথিবীর যে প্রান্তে সূর্য থাকে সে প্রান্তে দেখা যাবে ৬ মাসের জন্য দিন ; আর যে প্রান্তে বা পাশে সূর্য থাকবে না সেখানে ৬ মাসের জন্য রাত। আর আহ্নিক গতি না থাকার ফলে কোনো স্থানে ৬ মাস ধরে টানা সূর্যরশ্মি সে স্থানের আবহাওয়াগত তাপমাত্রাকে অত্যাধিক উত্তপ্ত করে তুলবে। একইভাবে বিপরীত পার্শ্বে টানা ৬ মাস ধরে সূর্যের আলো না থাকা এবং চিররাতময় অবস্থা সে স্থানের আবহাওয়াকে করে দেবে আরও কয়েকগুণ ঠান্ডা ; অনেকটা অ্যান্টার্টিকা মহাদেশের চেয়ে বেশি ঠান্ডা।

পৃথিবী মারাত্মক সৌরজাগতিক রেডিয়েশন এর স্বীকার হবে

আহ্নিক গতির ফলে পৃথিবী যখন ঘুরতে শুরু করে ; তখন ঘোরার সাথে সাথে পৃথিবীর চারিপাশে একটি ম্যাগনেটিক ফিল্ড ক্রিয়াশীল হয়। এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড আমাদেরকে সৌরমন্ডলীয় বায়ু বা সোলার উইন্ড থেকে  রক্ষা এবং সুরক্ষা প্রদান করে। তাছাড়াও এই ফিল্ড আমাদের ওজোন স্তরকে রক্ষা করে। তবে আহ্নিক গতি না থাকলে ম্যাগনেটিক ফিল্ড থাকবে না – যার ফলে সৌরমন্ডলীয় বায়ু আমাদের পৃথিবীতে প্রবেশ করে মারাত্মক রেডিয়েশন এর সৃষ্টি করবে ; যার ফলে পৃথিবী আমাদের থাকার অযোগ্য হয়ে পড়বে।


এরকম অবস্থা হলে সমগ্র মানবজাতির বেঁচে থাকার চান্স যদিও কম ; তবুও আমরা যদি বেঁচে থাকি তবে আমাদেরকে তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে বসতি স্থাপন করতে হবে। ভূপৃষ্ঠে আমরা বসবাস করতে পারব না কেননা খোলা বায়ুমন্ডলে ততদিনে যে রেডিয়েশন তৈরি হয়েছে, রেডিয়েশন প্রোটেক্টিভ স্যুট ব্যাতিত সেখানে বেঁচে থাকা সম্ভব হবেনা। আরও অনেক গবেষনা থেকে দেখা গিয়েছে যে, চাঁদ ধীরে ধীরে আমাদের কাছে চলে আসবে এবং একসময় আমাদের পৃথিবীর সাথে চাঁদের সংঘর্ষ ঘটবে। এসকল বিষয় থেকে আমরা ধারনা করতে পারি মহাবিশ্ব কতটা সুগঠিত এবং এর একটি বৈশিষ্ঠ্যেরও যদি ব্যাত্যয় ঘটে তবে কতটা ভয়ানক পরিস্থিতি হতে পারে। যে পরিস্থিতিটা আমাদের জন্য কেয়ামত এর চাইতে কম নয়।

নাসার এক গবেষনা থেকে উঠে এসেছে প্রতি ১০০ বছরে দিনের দৈর্ঘ্য ২.৩ মিলিসেকেন্ড করে বাড়ছে ; মানে প্রতি ১০০ বছরে পৃথিবীর ঘোরার গতি ২.৩ মিলিসেকেন্ড করে কমছে। আর সেই হিসেবে আগামী কয়েক বিলিয়ন বছরের মধ্যে পৃথিবীর আহ্নিক গতি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগই নেই।

Images: Shutterstock.com

About the author

তৌহিদুর রহমান মাহিন

Add comment

Categories