স্মার্টফোন যেভাবে আমাদের মস্তিষ্ক এবং দেহের নানাভাবে ক্ষতি করছে!

৬৩% মানুষ যাদের বয়স ১৮-২৯ এবং ৩০% মানুষ যাদের বয়স ৩০-৩৩ তারা সাধারনত রাতে তাদের স্মার্টফোন টিপতে টিপতেই ঘুমিয়ে পড়েন। আর এরকম আরও নানাকারনে স্মার্টফোন বিভিন্ন ভাবে আমাদের মস্তিষ্ক এর ক্ষতি করে থাকে ; আর আমাদের দৈহিক কার্যকলাপে নানাভাবে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। আর এরকম করে সামগ্রিকভাবে স্মার্টফোন আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতসাধন করে।


মেলাটোনিন এর নিঃসরণ কমে যাওয়া

মানুষের মস্তিষ্ক মেলাটোনিন নামক একটি হরমোন নিঃসরণ করে যার ফলে মানুষের ঘুমঘুম ভাব হয়। মানুষের ২৪ ঘন্টায় তথা একটি দিনে; শারিরীক ও জৈবিক কার্যকলাপ এর ভারসাম্য ঠিক রাখার পেছনে ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। ঘুম ঠিকমত না হলে দেহ ঠিকভাবে চলবে না; নানাবিধ শারীরিক এবং মানষিক উপদ্রব দেখা দেবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকলীন সময়ে ততকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে বন্দী কতজন কয়েদীদের উপর একটি পরীক্ষা চালানো হয়। পরীক্ষাটি ছিল তারা যদি ১ মাস ঘুম না পাড়ে তবে কেমন হবে। এসময় তাদেরকে একটি বায়ুবন্দী ঘরে বন্দী করে রাখা হয় ; অতঃপর সেই ঘরে বিশেষ একপ্রকার গ্যাস ছাড়া হয় ; যার ফলে তারা নিদ্রাহীন হয়ে পরে। তাদের নিয়মিত খাবার পানি দেয়া হত, পাশাপাশি তাদের বাতাসে অক্সিজেন ছিলও ঠিকই ; তবে ৩০ দিন পর তাদের আর জীবন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা যায়নি। তাদের রুমে লাগানো থাকা সাউন্ড সিস্টেম থেকে বোঝা যায় যে, ১৫ দিনের মাথায় তারা মানসিক রোগীতে পরিনত হয়ে গিয়েছিল।

তবে এই ঘটনার সাথে স্মার্টফোন ব্যবহারের সম্পর্ক নেই; তবে আমি শুধু বুঝিয়েছি ঘুমের কারনে মানব শরীরের কীরকম পরিবর্তন আসতে পারে সে বিষয়ে। মস্তিষ্ক থেকে বের হওয়া মেলাটোনিন হরমোন শরীরের ভেতরকার নানান ক্যান্সার এবং টিউমার উৎপাদনকারী কোষের কার্যকলাপকেও সীমিত রাখে। সুতরাং, সুষ্ট মেলাটোনিন এর প্রবাহ ক্যান্সার এর আসঙ্কা কমিয়ে দেয়। আর আমরা জানি যে, টিউমার থেকে পরবর্তীতে ক্যান্সার এর রূপ ধারন করে। সুতরাং রাতের পর্যাপ্ত ঘুম নষ্ট করার পেছনে যদি আপনার স্মার্টফোনের হাত থাকে; তবে ভবিষ্যতে আপনার ব্রেইন টিউমার হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। গবেষকরা এরকম সমস্যা এড়াতে একজন মানুষকে অন্তত ৮ ঘন্টা ঘুমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তো বন্ধুরা আমরা এবার থেকে অবশ্যই খেয়াল যেন স্মার্টফোনের কারনে আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে।

নিউরো টক্সিন এর প্রভাব

আপনি কি জানেন, আমাদের দেহের প্রতিটি অংশ সারাদিন কাজ করার সাথে সাথে এক বিশেষ প্রকার জৈবিক পদার্থ নির্গত করে ; আর এটি হল নিউরো টক্সিন। নিউরো টক্সিন প্রতিটি দিন আমাদের দেহ অভন্তরীন নানানরকম অঙ্গানু থেকে নির্গত হয়ে থাকে। তবে এসব নিউরো টক্সিন আমাদের স্নায়ুতন্ত্র বিশেষ করে মস্তিষ্ক এর জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু আমাদের মানবদেহ অতি সুগঠিত একটি মেকানিজম এটি মানতেই হবে ; কেননা প্রতিদিন রাতে ঘুমের কারনে মস্তিষ্ক দীর্ঘ সময় বিশ্রামে থাকে ; আর এসময় মস্তিষ্ক এই নিউরো টক্সিন এর প্রতিক্রিয়াকে রিকেভার করে ফেলে। আর যখন মস্তিষ্ক এটি রিকোভার করতে পায় না, তখন রাতে ঘুম না হওয়া, ঘুম থেকে জেগে জেগে ওঠার মত সমস্যা দেখা দেয়। আর একটা জিনিস খেয়াল করবেন, এই সমস্যাটি তাদেরই হয় যারা রাতজেগে তাদের স্মার্টফোন বা ল্যাপটপে সময় দেয়। একারনে ডাক্তাররা রাতে যেন আমাদের মস্তিষ্ক কমপক্ষে ৮ ঘন্টা বিশ্রামে থাকে সেই পরামর্শ দেন।

পড়া মনে না থাকা

সারাদিন শেষে অনেকে আছেন, যারা রাতে ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে প্রবেশ করেন। ভাবেন ৫-৬ মিনিট ঘোরাঘুরি করে ঘুমিয়ে পড়বেন ; তবে সেই পাঁচমিনিট যে কখন ২-৩ ঘন্টা হয়ে যায় তা আমরা বুঝেই উঠতে পারি না। একারনে রাত ২-৩টা পর্যন্ত জাগা অনেকের চিরাচরিত অভ্যাসে পরিনত হয়ে গিয়েছে। এভাবে দেখা যায় যে, আমাদের অনেকের রাতে কেবল ৫ ঘন্টা মাত্র ঘুম হয়। তবে যত কম ঘুম তত বেশি আপনার পড়াশোনা ক্ষতি। গবেষনা থেকে দেখা গেছে যারা স্মার্টফোন এর পিছনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে ; তারা তাদের ক্লাসরুমে বেশি মনোযোগ দিতে পারেনা। অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের আরেকটি খারাপ সমস্যা হল কিছু মনে না থাকা। আপনি হয়ত আপনার মাথায় আগেই ভালোভাবে কোনোকিছু মনে করে রেখেছিলেন ; তবে সমস্যা হল আপনি তা ভুলে যাবেন। ধরুন আপনি আপনার কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস এক জায়গায় রেখেছেন ; দেখা যাচ্ছে কিছুক্ষন পরই ভুলে গেলেন কই রেখেছেন।

ঘন ঘন ক্ষুদা

যখন আপনার মস্তিষ্কে ঠিকমত মেলাটোনিন নিঃসরন হচ্ছে না ; আপনার ভেতরকার স্লিপ সাইকেল বা ঘুমের নিয়ম ভঙ্গ হয়ে গিয়েছে; তখন আপনার শরীরের নানা অঙ্গ ঠিকভাবে কাজ করবে না। আর একারনে আপনার পাকস্থলী অনেক সময় যখন-তখন আপনাকে ক্ষুদার সংকেত দেয়। একারনে আমাদের অনেকক্ষেত্রে এমন সময় ক্ষুদা লাগে যখন আমাদের তা লাগার কথাও নয়।

চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্থ

এই ব্যাপারটি আমরা কমবেশি সবাই জানি। টেলিভিশন,ট্যাবলেট বা স্মার্টফোন এর ডিসপ্লে থেকে নির্গত হয় একপ্রকার নীল রশ্মি মানুষের চোখের রেটিনাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। আর ব্যাপারটি আরও জোড়ালো ভাবে খারাপ প্রভাব ফেলে ; যখন আমরা রাতে অন্ধকারে স্মার্টফোন ব্যববহার করি। আর এই সমস্যা সর্বশেষ পর্যায় পর্যন্ত আপনাকে অন্ধও করে দিতে পারে। পৃথিবীতে ৫৫% মানুষের চোখের দৃষ্টি সমস্যা কেবল অতিরিক্ত ডিসপ্লে ডিভাইসের সামনে থাকার জন্য।

মানষিক অবস্থার পরিবর্তন

যারা অত্যাধিক সময় স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করে ; তাদের স্বভাব এবং আচরনে একটি খিটখিটে ভাব লক্ষ্য করা যায়। আর এসব মানুষ যেকোন পরিস্থিতিতে খুব সহজেই মানষিকভাবে ভেঙ্গে পরে বা ডিপ্রেসড হয়ে পরে। বিশেষ করে রাতে এসব মানুষ ঘুমানোর সময় বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহার করার সময় নানাকারনে ডিপ্রেশনে ভোগে।

তো এতসব সমস্যা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে আপনি কি করবেন? সর্বপ্রথম আমার পরামর্শমতে রাতে ঘুমানোর ১ ঘন্টা আগে থেকে আপনার স্মার্টফোন বা এরকম সমমানের যেকোন গ্যাজেটস ব্যবহার বন্ধ রাখুন। আর এটি আপনার মস্তিষ্ককে বুঝতে সহায়তা করবে ; এখন রাত আর আমাকে একটি ভালো ঘুম দিতে হবে। আপনি এক্ষেত্রে ঘুমানোর ১.৩০ ঘন্টা আগে থেকে যেকোন রকম বই পড়া শুরু করতে পারেন, যা আপনার ভালো লাগে। আর এসময় যদি আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো মেসেজ দেখার জন্য ফোন চালু করাই লাগে ; তবে ব্রাইটনেস একদম কম করে রাখুন।

Images: Shutterstock.com

About the author

তৌহিদুর রহমান মাহিন

Add comment

Categories