আমরা কি কখনো অন্য কোন নক্ষত্র মন্ডল ভ্রমন করতে পারবো?

আপনি যদি আরও অধিকাংশ মধ্যবয়স্ক মানুষদের মত হয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই আপনার পৃথিবীর বাইরে অন্যান্য প্লানেটে এবং এমনকি অন্যান্য নক্ষত্রে ভ্রমন করার ইচ্ছা আছে। রাতের আকাশে যখন আমরা হাজার হাজার ফুটফুটে তারা দেখি, তখন অবশ্যই একবার চিন্তা করি যে, কেমন হতো যদি আমরা এসব তারায় যেতে পারতাম? সেখান থেকে পৃথিবীকে কেমন দেখা যেত? আমাদের গালাক্সিটাকেই বা কেমন দেখা যেত এসব নক্ষত্র থেকে? যদিও প্র্যাক্টিক্যালি চিন্তা করলে, এসব নক্ষত্রে আমরা কখনো যেতে পারলেও সেখান থেকে আমাদের পৃথিবীকে দেখতে পারবো না। কারণ, এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তারার বা নক্ষত্রের তুলনায় আমাদের পৃথিবী একটি বালু-কনার সমান বা তার থেকেও ছোট। যাইহোক, কিন্তু আমরা এটা অনেকবারই ভেবে থাকি যে, আমরা আমাদের মৃত্যুর আগে কি মানুষের নক্ষত্রভ্রমন দেখে যেতে পারবো? প্রথম চিন্তায় অবশ্যই আপনি এর উত্তর দেবেন, “কখনোই না”। তবে আরও গভীরে গিয়ে চিন্তা করলে কি বলা যায়? আজকে এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করা যাক।

বিঃদ্রঃ এখানে ভ্রমন করা বলতে সেখানে ফিজিক্যালি গিয়ে ভ্রমন করার কথা বলা হয়নি। এখানে মূলত ভ্রমন করা বলতে বোঝানো হয়েছে নক্ষত্রে মানুষের তৈরি কর মহাকাশযান প্রেরন করা।


আমরা যেহেতু মানুষের নক্ষত্রভ্রমন নিয়ে আলোচনা করছি, তাহলে তুলনামূলকভাবে আমাদের পৃথিবীর সবথেকে কাছের নক্ষত্রটিকেই উদ্দেশ্য হিসেবে ধরে নেওয়া যাক। আমাদের পৃথিবীর সবথেকে কাছের নক্ষত্রটি হচ্ছে প্রক্সিমা সেন্টারি (Proxima-Centaury)। কিন্তু এই সবথেকে কাছের নক্ষত্রটিও আমাদের পৃথিবীর থেকে ৪.২৫ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আশা করি আলোকবর্ষ মানে কতদূর আপনি জানেন। যদি না জেনে থাকেন তাহলে বলি, আলো বা লাইট একবছরে যতদূর দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে সেটিকে ১ আলোকবর্ষ বলা হয়। আমরা সবাই জানি যে আলো ১ সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে। তাহলে নিশ্চই ধারনা করতে পারছেন যে আলো ১ বছরে কতটা দূরত্ব অতিক্রম করবে। এবার নিশ্চই কিছুটা আইডিয়া করতে পারছেন যে ৪.২৫ আলোকবর্ষ মানে কতটা দূর হতে পারে।

আচ্ছা, এবার আরেকটি এস্টিমেট করা যাক। আমাদের বর্তমান টেকনোলজি ব্যবহার করলে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে ঠিক কতটা সময় লাগতে পারে। আপনি হয়তো ভয়েজার ওয়ানের নাম শুনেছেন। যদি ভয়েজার ওয়ান সম্পর্কে না জেনে থাকেন তাহলে আমাদের আগের এই আর্টিকেলটি একবার পড়ে আসতে পারেন।  যদি ভয়েজার ওয়ান স্পেস প্রোগ্রাম সম্পর্কে জেনে থাকেন তাহলে নিশ্চই জানেন যে, ভয়েজার ওয়ান একটি স্পেস প্রোব। যে রোবটিক মহাকাশ যান গুলো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে না, সেগুলোকে স্পেস প্রোব (Space Probe) বলা হয়। ৯৭৭ সালে প্রোবটিকে পৃথিবী থেকে মহাকাশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর আজ ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যাত্রা অতিক্রম করে প্রোবটি পৃথিবী থেকে প্রায় ২১ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর যানটি ১৭ কিলোমিটার/সেকেন্ড স্পীডে ছুটে চলে আজ পৃথিবী থেকে প্রায় ১৪১ অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিট (Astronomical Unit) দূরে রয়েছে। সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব অনুসারে অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিট মাপা হয়, এখানে একবার সূর্য থেকে পৃথিবীর সমান দূরত্ব (১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার) অতিক্রম করলে ১ অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিট ধরা হয়। তো এর মানে হচ্ছে, এখনো পর্যন্ত মানুষের তৈরি কোন মহাকাশযানের সর্বোচ্চ গতি হচ্ছে ১৭ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড।

১৭ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড মানে এটি অবিশ্বাস্যরকম দ্রুতগতির একটি মহাকাশযান। কিন্তু তবুও, এই ১৭ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড স্পীডে চলতে থাকলেও ভয়েজার ১ এর আমাদের নিকটতম নক্ষত্র, প্রক্সিমা সেন্টারিতে পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ৭৩ হাজার বছরেরও বেশি। আমরা নিশ্চই ৭৩ হাজার বছর বেঁচে থাকবো না। তাই এই ভয়েজার ১ ব্যবহার করে যদি নক্ষত্র ভ্রমন করা হয়, তাহলে সেটা আমাদের জীবনকালের মধ্যে সম্ভব হবেনা।

তবে এবছরের শেষের দিকে নাসা মহাকাশে আরেকটি স্পেস প্রোব লঞ্চ করার প্ল্যান করছে যেটি হবে ভয়েজার ১ এর থেকেও আরও বেশি দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং এটিই হবে মানুষের তৈরি সবথেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন মহাকাশযান। এটির নাম দেওয়া হবে, পার্কার সোলার প্রোব। এটিকে মহাকাশে লঞ্চ করা হবে সূর্যের বিষয়ে স্টাডি করার জন্য। এই প্রোবটি সূর্যের চারদিকে একটি ডিম্বাকৃতির অরবিটালে প্রত্যাবর্তন করবে। আবর্তন করার সময় যখন এটি সূর্যের সবথেকে কাছে থাকবে তখন এটি যে ভেলোসিটি বা দ্রুতি অর্জন করতে সক্ষম হবে, তা হচ্ছে ২০০ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড। এটি এতটাই দ্রুত গতি যে, এই স্পীডে পৃথিবীর চারদিকে আবর্তন করলে সম্পূর্ণ পৃথিবী একবার ঘুরে আসতে সময় লাগবে প্রায় ৩ মিনিট ২৪ সেকেন্ড। এই গতি আমাদের পৃথিবীর তুলনায় অনেক অনেক বেশি হলেও, এটি আলোর গতির মাত্র ০.০৭%। যার মানে হচ্ছে, এই স্পিডে ভ্রমন করলেও ওই প্রোবটির আমাদের নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টারিতে পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ৭ হাজার বছরেরও বেশি।

তো এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সামনের দিনগুলোতে এমন কোন নতুন প্রযুক্তি দেখতে পাবো যার সাহায্যে আমাদের লাইফটাইমের মধ্যেই মানুষ নক্ষত্রে ভ্রমন করতে পারবে? এই বিষয়ে অতীতে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে এবং অনেকসময় অনেকরকম আইডিয়া এবং প্রোপোসালও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশ আইডিয়াই ভিত্তিহীন বা প্র্যাকটিক্যাল নয় কিংবা এককথায় অসম্ভব। তবে এগুলোর মধ্যে একটি আইডিয়া অনেকটা বিশ্বাসযোগ্য এবং সম্ভব। এই আইডিয়াটি হচ্ছে ব্রেকথ্রু স্টারশট (Breakthrough Starshot)। এই প্রোজেক্টটি যদি সত্যিকারেই বাস্তবায়িত হয় তবে এই প্রোজেক্টটি হবে ২১ শ সেঞ্চুরির সবথেকে ইনোভেটিভ এবং সবথেকে উল্লেখযোগ্য একটি ইভেন্ট।

ব্রেকথ্রু স্টারশট প্রোজেক্টে যে আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে হবে তা হচ্ছে, প্রথমত একটি সেন্টিমিটার স্কেলে পরিমাপ করার মত ক্ষুদ্র একটি স্পেসশিপ বা স্পেস প্রোব তৈরি করতে হবে, যেটার ওজন হবে সর্বোচ্চ কয়েক গ্রামের মত। এই স্পেসশিপটির চারদিকে ৪ মিটার বাই ৮ মিটার সাইজের একটি সেইল বা অনেকটা নৌকার পালের মত স্ট্রাকচার সংযুক্ত করা থাকবে। এমন সেইলসহ ক্ষুদ্র স্পেসশিপ প্রায় ১০০০ টার মত তৈরি করতে হবে এবং সেই সবগুলোকে একসাথে আরেকটি বড় সাধারণ রকেটের সাহায্যে লঞ্চ করতে হবে। পৃথিবীর বাইরের অরবিটালে গিয়ে এই প্রত্যেকটি ছোট ছোট স্পেসশিপগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে একটি একটি করে লঞ্চ করতে হবে। এই স্পেসশিপগুলোর সাথে সংযুক্ত করা সেইলগুলো অনেকটা আমাদের পৃথিবীতে নৌকার পাল যেমন কাজ করবে, সেভাবে কাজ করবে। তবে এক্ষেত্রে পালতোলা নৌকার মত বাতাস এসব স্পেসশিপগুলোকে স্পিড দেবে না, বরং এই সেইলগুলোতে নিক্ষেপ করা হবে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন লেজার। একটি লেজার নয়, বরং এক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে ১ স্ক্যয়ার কিলোমিটার অ্যারে যেটির সাহায্যে হাজার হাজার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করা হবে। তবে এই লেজার রশ্মিগুলো একত্রে তাদের সম্মিলিত শক্তি এই সেইলগুলোর দিকে ফোকাস করে নিক্ষেপ করবে।

এর ফলে যা হবে তা হচ্ছে, এই  লেজারগুলো এইসকল ছোট ছোট স্পেসশিপগুলোকে প্রায় আলোর ২০% সমান গতি এনে দিতে পারবে, তাও ১০ মিনিটের মধ্যে। তার মানে হচ্ছে, এই সবগুলো স্পেসশিপ এই গতিতে প্রক্সিমা সেন্টারিতে পৌঁছাতে সময় নেবে প্রায় ২০ বছরের মত। কিন্তু সেখানেও এই প্রোজেক্টে কিছু ইস্যুস থেকেই যায়। যেমন, এই আলোর ২০% গতিতে ভ্রমন করা ক্ষুদ্রও স্পেসক্রাফটগুলোতে যদি ১ কণা পরিমান ধুলা বা অন্য কোন ম্যাটেরিয়াল লেগে যায়, তাহলে তাদের এই স্পিড সেখানেই শেষ হয়ে যাবে। ঠিক এই কারনেই এই প্রোজেক্ট অনুযায়ী বলা হয়েছে যে এই ছোট ছোট স্পেসক্রাফটগুলো পড়ায় ১০০০ টার মতো লঞ্চ করতে হবে যাতে এগুলোর মধ্যে অন্তত কয়েকটি তাদের ভ্রমন শেষ করতে পারে। এছাড়াও আরও সমস্যা হচ্ছে, পৃথিবী থেকে যেসব লেজার রশ্মি ওপরে নিক্ষেপ করতে হবে, সেগুলোর একেকটি লেজার রশ্মি প্রায় ১০০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে। এর পেছনে এতটা বিদ্যুৎ খরচ করা কষ্টকর, তবে অসম্ভব কিছুনা। আর এছাড়াও এই সম্পূর্ণ প্রজেক্টটি বাস্তবায়ন করতে হলে খরচ হবে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ১০ বিলিয়ন ডলার শুনে অনেক বেশি মনে হয়, তবে নাসার ট্র্যাক রেকর্ড অনুযায়ী এই প্রজেক্টের পেছনে এত ডলার খরচ করা কোন ব্যাপারই না। তবে এই প্রোজেক্টটি সত্যিকারেই বাস্তবায়ন হবে কিনা এবং হলেও কবে নাগাদ নাসা এটির কাজ শুরু করবে, তার উত্তর এখনো জানা যায়নি। এর উত্তর সময়ই দিতে পারবে… 🙂

আজকের মত এখানেই শেষ করছি। আশা করি আজকের আর্টিকেলটিও আপনাদের ভালো লেগেছে। কোন ধরনের প্রশ্ন বা মতামত থাকলে অবশ্যই কমেন্ট সেকশনে জানাবেন।

Images: Shutterstock.com

About the author

সিয়াম

Add comment

Categories