ইউটিউব থেকে ভিডিও ডাউনলোড করা কি বৈধ?

গুগল পৃথিবীর অন্যতম বড় একটি অনলাইন কর্পোরেশন। এই বিশাল অনলাইন কর্পোরেশনটির ৯০% আয় আসে তাদের বিজ্ঞাপন সেবা গুগল অ্যাডসেন্স থেকে। আর গুগল অ্যাডসেন্স এর আয়ের অন্যতম একটি জায়গা হল ইউটিউব। ইউটিউব বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় একটি ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট। এটি পৃথিবীর ৩য় মোস্ট ভিজিটেড ওয়েবসাইট এবং ২য় বৃহত্তম সার্চ ইঞ্জিন। ইউটিউব পৃথিবীর বৃহত্তম ভিডিও সার্চ ইঞ্জিন। গুগল ২০০৭ সালে ইউটিউব এর তৈরিকারক দের থেকে এর স্বত্ত্ব কিনে নেয়। আর আজকে ইউটিউবের এই সাফল্যের পেছনে গুগলের অনেক বড় অবদান রয়েছে।

একটা বিষয় স্বাভাবিক ভাবে আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, গুগল সবসময় ইউটিউব এর কনটেন্ট ডাউনলোড থেকে আপনাকে এড়িয়ে রাখতে চায়। গুগল এখানে ইউটিউবের সবরকম আয়ের সম্ভাবনা, ইউটিউবের কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের বিষয়বস্তু নিরাপত্তা গুলোকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়। বর্তমানে এমন অনেক ইউটিউব কনটেন্ট ক্রিয়েটর রয়েছে যারা কেবল তাদের ইউটিউব ভিডিও কে পুঁজি করে জীবিকা নির্বাহ করে এবং অবশ্যই গুগল তথা ইউটিউব কতৃপক্ষ এই বিষয়ে অবহিত। গুগলকে তাদের সম্পর্কে সবদিক দিয়ে ভাবতে হয়। ইউটিউবে ভিডিও ডাউনলোড অপশন থাকলেও আমরা জানি যে, সেই ডাউনলোডকৃত ভিডিও থাকবে সাময়িক সময়ের জন্য। ইউটিউব সবরকম ভিডিও ডাউনলোডকে আন-সাপোর্ট করে বিধায় আমরা গুগল প্লে স্টোরে’ও সরাসরি কোনো ইউটিউব ভিডিও ডাউনলোডার অ্যাপ খুঁজে পাব না। তো এখন আসল প্রশ্ন হল ইউটিউব থেকে ভিডিও ডাউনলোড করা কি আসলে অবৈধ?

ব্যাক্তিগত ব্যবহারের জন্য হলে ইউটিউব ভিডিও ডাউনলোড করা অবৈধ নয়। তবে নৈতিকভাবে যদি বলি এটি মানবিক আদর্শের বিপরীত। সবাই এখানে বলতেই পারেন সামান্য ইউটিউব ভিডিও ডাউনলোড এর সাথে মানবিক বিষয় অথবা নৈতিক দিক আসল কোথায় থেকে? সমস্যা নেই বিষয়টি সম্পর্কে বুঝতে পারবেন। ভিডিও স্ট্রিমিং বাফারিং এর জন্য, অতিরিক্ত ডাটা খরচ হওয়ার জন্য আমরা অনেকেই এমনকি মাঝে মাঝে আমিই ইউটিউব ভিডিও ডাউনলোড করে থাকি। আর আমাদের অনেকের ইউটিউব ভিডিও ডাউনলোড করার আরেকটি বড় কারন হলো ইউটিউব অ্যাডভার্টাইজমেন্ট থেকে মুক্ত থাকা। এটা কোনো ভাবেই অবৈধ কিছু নয়।

তবে একটি বিষয় আমরা লক্ষ্য করলে দেখব যে, বহু মানুষ কেবল এই ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করার মধ্য দিয়ে তাদের জীবন চালিয়ে থাকে। তারা তাদের জীবন পরিচালনার টাকার জন্য ইউটিউব এর ওপর নির্ভরশীল। নাম বলবনা এমন বাংলাদেশের বেশ কিছু ইউটিউবার ইউটিউব থেকে তাদের সারা মাসের চলার টাকা আয় করে থাকে। আর তারা কিভাবে আয় করে? তারা আয় করে আপনার মাধ্যমে। আপনি যে গুগলের ইউটিউব ওয়েবসাইট বা অ্যাপ থেকে সেইসব ভিডিও টি দেখলেন, এতে করে গুগল আপনাকে কিছু বিজ্ঞাপন তথা অ্যাডস দেখাবে ; আর এই থেকে আপনার মত হাজার হাজার ভিডিও দর্শকদের মাধ্যমে ইউটিউব কনটেন্ট ক্রিয়েটরটি তার ভিডিও পরিশ্রম এর পেছনে যা ব্যায় হয়েছে তার সম্মানী পায়। তবে যখন আপনি এই ভিডিওটি ইউটিউবে পুরোপুরিভাবে দেখলেন না, বা ভিডিওটি আপনি ইউটিউবে না দেখে লিংক কপি করে বা অন্যান্য ডাউনলোডার অ্যাপ দিয়ে ডাউনলোড করলেন ; ঠিক তখন ভিডিও ক্রিয়েটরটি তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হবে।

গুগল সবসময়ই চায় যে তাদের প্ল্যাটফর্মে যারা কাজ করছে, তারা যেন সবসময়ই তাদের ন্যায্য প্রাপ্য পায়। আর এটি রক্ষার জন্য গুগল ছোট থেকে বড় নানা পদক্ষেপ গ্রহন করেছে এবং নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহন করেই চলেছে। আর তার মধ্যে ভিডিও ডাউনলোড থেকে মানুষদের এড়িয়ে রাখা অন্যতম একটি। গুগল এখানে ইউটিউবের ভেতরই অফলাইনে ভিডিও সেইভ করে রাখার একটি সুবিধা রেখেছে, তবে আমরা সবাই জানি অফলাইনে সেইভ থাকা ভিডিও চিরস্হায়ী নয়। অফলাইনে সেইভড ভিডিও দেখতেও আমাদেরকে অবশ্যই ইউটিউব অ্যাপকে ব্যবহার করতেই হয়। আবার যদি কোনো ইউটিউব ক্রিয়েটর তথা ইউটিউবার যদি চান তবে তার ভিডিওর জন্য ইউটিউব ডাউনলোড ফিচারটি বন্ধও করে রাখতে পারেন। সুতরাং এখানে গুগল এটিও চায় না যে, তাদের এই ফিচার এর জন্য যেনো কোনো ক্রিয়েটরের ক্ষতি না হয়। সুতরাং এই থেকে একটা বিষয় আমরা বুঝতে পারলাম যে, ইউটিউব ভিডিও ডাউনলোড করাটা গুগল কোনোভাবেই সমর্থন করে না। ইউটিউবে ডাউনলোড যেমন ক্রিয়েটর বা পাবলিশার বিরোধী একটি পদক্ষেপ ; ঠিক একইভাবে অ্যাড ব্লকারগুলো একইভাবে তাদের নানারকম ক্ষতির কারন।

ইউটিউব নীতিমালা কি বলে?

ইউটিউবের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন বা ইউটিউব নীতিমালা পড়লে জানতে পারবেন যে, ইউটিউব ভিডিও ডাউনলোড গুগলের রুলস ও রেগুলেশন বিরোধী। ইউটিউবের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন ধারা ৫.১ এ লিপিবদ্ধ করা আছে যে, ” আপনি কিছু কন্ডিশন অনুসরন করার মধ্য দিয়ে ইউটিউবের ফ্রী সার্ভিসটি ব্যবহার করছেন। আর আপনি যদি কোনো কারনে এসব কন্ডিশন মানতে অপারগ হন তবে আপনি ইউটিউবের নীতিমালা লঙ্ঘন করলেন। আপনি ইউটিউব ভিডিও দেখতে অবশ্যই অন্য কোনো প্রযুক্তি বা মাধ্যম ব্যবহার করবেন না ; অর্থাত আপনি ইউটিউব ভিডিও দেখতে অবশ্যই ইউটিউব ভিডিও প্লেয়ার ব্যবহার করবেন। ”

“আপনি অবশ্যই ব্যাক্তিগত এবং নন-কমার্শিয়াল ব্যবহারের বাইরে কোনো ইউটিউব কনটেন্ট এক্সেস করবেনা। এবং আপনি সম্পূর্ণ ভাবে কনটেন্টকে কেবল ইউটিউবের প্লাটফর্মে স্ট্রিমিং এর মাধ্যমে উপভোগ করবেন বলে সম্মত হচ্ছেন। এখানে স্ট্রিমিং বলতে বোঝানো হচ্ছে, ইন্টারনেটে ভিডিও কনটেন্ট এর ডিজিটাল ট্রান্সমিশন যা ইউটিউব থেকে আপনি পাচ্ছেন। এখানে ইন্টারনেট সমৃদ্ধ যেকোনো ডিভাইস এর ইন্টারনেট ব্যবহার করে রিয়েল টাইম ভিডিও ভিউ হতে হবে। আপনি সাময়িক বা সবসময়ের জন্য ভিডিও কনটেন্ট ডাউনলোড,কপি,সংরক্ষন বা রি-ডিস্ট্রিবিউশন করবেন, ইউটিউব তা সমর্থন করেনা। ”

সুতরাং ইউটিউব টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন তথা ইউটিউব নীতিমালা ৫.১ ধারার এই অংশটি স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করছে যে ; ইউটিউব কোনো ভাবে ইউটিউবের ন্যাটিভ প্লেয়ার ব্যাতিত অন্য কোথাও অনলাইন হোক, কিংবা অফলাইন ; আপনাকে ভিডিও এক্সেস করার সম্মতি দেয় না। যেহেতু এখানে ইউটিউব না গুগল আপনাকে এখানে অনুমতির কথা বলেনি, তারা বলেছে সম্মতি এর কথা ; তাই আপনি ভিডিও ডাউনলোড করলে তা অবৈধ হবেনা, তবে অন্য নৈতিক দিক দিয়ে এটি অবৈধ এর বিপরীত বৈধও নয়।


ভিডিও ডাউনলোড এর পক্ষে ইউটিউব এর সম্মতি না দেওয়া, এর পিছে আরেকটি বড় কারন হলো কনটেন্ট এর প্রাইভেসি এবং কপিরাইট প্রোটেকশন। ইউটিউব/গুগল এখানে কখনই চায় না যে অন্য কারো কনটেন্ট আপনি নিজের প্রোজেক্টে ব্যবহার করেন। আপনি ভাবতে ইউটিউবে থাকা কর্মাসিয়াল মিউজিক ভিডিওগুলো হয়ত ডাউনলোড করা ফ্রি, তবে এটা ভুল। মিডিয়া কোম্পানি যেমন: জি সিরিজ, সিডি চয়েজ, টি সিরিজ,এস ভি এফ ইত্যাদি ; এরা কিন্তু আপনি ফ্রি ভিডিও ডাউনলোড করবেন সেজন্য ইউটিউবে ভিডিও দেয়নি, তারা শুধু আপনাকে ইউটিউবে তথা অনলাইনে তাদের নিজেদের সিলেক্টেড প্লাটফর্মে আপনাকে ভিডিও দেখার সুযোগ দিয়েছে মাত্র।

আশা করি আজকের আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লেগেছে। ইউটিউন ভিডিও ডাউনলোড করা অবৈধ নয়; তবে এটি এক প্রকার অন্যায়, ভিডিওটির আসল ক্রিয়েটর এর প্রতি অন্যায়। কেননা আপনি তার ভিডিও ইউটিউবে না দেখে, ডাউনলোড করে অফলাইনে দেখছেন বলে তার প্রাপ্য রেভেনিউ লস হচ্ছে।

Images: Shutterstock.com

About the author

তৌহিদুর রহমান মাহিন

Add comment

Categories