মোবাইল জায়েন্ট নোকিয়া কেন ধ্বংস হয়েছিল?

আমার মত আপনাদেরও হয়ত জীবনের প্রথম মোবাইল ছিল নোকিয়া। এমন একটা সময় ছিল যখন মোবাইল মানেই ছিল নোকিয়া।তবে কোন এক কারনবশত বিশাল এই কোম্পানি ধ্বংস হয় । আজকের আর্টিকেল এ আমরা জানার চেষ্টা করব কেন নোকিয়ার এই পতন হয় এবং এর পিছে কোন বাক্তি কি দায়ি কিনা।  ফিনল্যান্ডে ১৮৬৫ সালে মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন নোকিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। নোকিয়া স্যমসাং এর মতই নানারকম ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। নোকিয়া মূলত কমিউনিকেশন,ইনফর্মেশন টেকনোলোজি এবং কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স এর ওপর কাজ করত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এসব নিয়ে কাজ করতে করতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাজারে নোকিয়ার রাংক উপরে চলে আসে।

কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স খাতে নোকিয়ার সবচাইতে বড় সাফল্য আসে; বহনযোগ্য টেলিফোন তথা মোবাইল সেট উৎপাদন এর মধ্য দিয়ে। নোকিয়ার এই যাত্রা শুরু হয়েছিল মোবিরা নামক একটি টেলিফোন নির্মাতা কোম্পানিকে কিনে নেওয়ার মাধ্যমে। তারপর থেকে নোকিয়া টেলিফোনিক ডিভাইস তৈরিতে মনোনিবেশ করে। তাদের প্রথম টেলিফোনিক পোর্টেবল ডিভাইস ছিল একটি ‘কার ফোন’ বা গাড়িতে বহনযোগ্য ফোন। নোকিয়া এই ফোনটি লঞ্চ করে ১৯৮২ সালে। এই কার ফোনটির নাম ছিল ‘নোকিয়া মোবিরা সেনেটার’। এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম কার ফোন, যার ওজন ছিলো ১০ কেজি। ঠিক তার ২ বছর পর নোকিয়া ১৯৮৪ সালে পুরোপুরি বানিজ্যিকভাবে লঞ্চ করে যেকোনো স্হানে বহনযোগ্য ফোন ‘ নোকিয়া মোবিরা টকম্যান’। তৎকালীন সময়ে এই ফোনটির বিজ্ঞাপন প্রচারের কারনে সর্বস্তরে এটি সমাদৃতি লাভ করে। নোকিয়া মোবিরা টকম্যান এর ওজন ছিল ৫ কেজি। তারপর ১৯৮৭ সালে নোকিয়ার ‘মোবিরা সিটিম্যান’ ছিল পৃথিবীর প্রথম এক হাতে এবং হাতের মুঠোয় ব্যবহার করা সম্ভব এমন একটি ফোন। এই সিটিম্যান ফোনটি ছিল অত্যান্ত বেশি বহনযোগ্য, কেননা এর ওজন ছিল মাত্র ৮০০ গ্রাম। যেখানে আগে ৫ কেজি, ১০ কেজি এর ফোন বানাতো তারপর ৮০০ গ্রাম। মানুষ ফোনটিকে দারুনভাবে নিয়েছিল।

এভাবে নোকিয়ার মোবাইল এর বাজার দখল রাজকীয় ভাবে শুরু হয়েছিল। এর ভেতর ১৯৯২ সালে ১০১১ সিরিজের জিএসএম ফোন সফলভাবে বাজারে আনার পর ১৯৯৪ সালের ২১০০ সিরিজ ফিচার ফোন ব্যাপক ভাবে বাজার কাপিয়ে তোলে। নোকিয়ার এস্টিমেট অনুযায়ী তারা আশা করেছিল ৪ লক্ষ ফোন বিক্রয় করতে পারবে, তবে আশ্চর্যজনকভাবে তারা ২ কোটিরও বেশি ২১০০ সিরিজের ফিচার ফোন বিক্রয় করেছিল। ঠিক এভাবে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত নোকিয়া যা যা আশা করছিলো মার্কেট সাইজ হয়ে যাচ্ছিলো তার চাইতে বড়। আর ঠিক এরই মধ্যে নোকিয়া তার প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী মটোরোলাকেও টপকে সামনে চলে এসে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মোবাইল কোম্পানিতে পরিনত হয়েছিল। ১৯৯৬-১৯৯৮ এর ভেতর নোকিয়া ব্যাপকভাবে চীন,আমেরিকা,ইউরোপ,রাশিয়া এবং পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের বাজারে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় পৃথিবীর সেরা ৫০ টি মোবাইল ফোনের কথা বলা হলে সেরা ২০ টা নোকিয়ারই হত, বাকি পিছে পড়ে থাকত মটোরলা,স্যমসাং এইসব কোম্পানি।

২০০৩ এর পর নোকিয়ার ১১০০ এবং ১১১০ মডেলটি বিশ্ব মোবাইল বাজারে বোম-ব্লাস্ট এর মত করে ছড়িয়ে পড়ে। হয়ত আপনি অথবা আপনার বাবা কেউ না কেউ এটি ব্যবহার করেছেই, মাস্স্ট। ২০০৫ সাল থেকে মানুষ এর ভেতর এমন একটি মনোভাব সৃষ্টি হয়েই গিয়েছিল যে, মোবাইল মানেই নোকিয়া। বলতে গেলে সময়টাতে নোকিয়া তার সর্বোচ্চ ম্যান পাওয়ার নিয়ে পৃথিবীর ভেতর একটি সবচেয়ে বড় একটি ফুল প্রোসেস মোবাইল কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। নোকিয়ার সিমবিয়ান অপারেটিং সিস্টেম চালিত ফোনগুলো তখন বাজারে চরমভাবে জনপ্রিয় ছিলো।

এসময় থেকে নোকিয়ার সাথে সমভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য বাজারে চলে আসে সনি,স্যমসাং এবং আগের মটোরলার মত কোম্পানি। নোকিয়া যেসব মোবাইল ফোন তৈরি করত তাতে তো তারা সেরা ছিলই, তবে এখন মার্কেটে নোকিয়ার থেকে মানুষকে সরে আনার জন্য স্যমসাং এর মত কোম্পানি নতুন কিছু ট্রাই করছিল। যেহেতু নোকিয়া তখন খুবই বড় একটা কোম্পানি ছিল, তাই যেকোনো মডেলের মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচার করা তাদের জন্য খুবই সময় সাপেক্ষ ছিল। অন্যদিকে নতুন এন্ট্রি করা স্যামসাং জন্য এগুলো ছিল মার্কেটে ঢোকার চান্স। এদিকে মটোরলা এবং স্যামসাং মিলে বাজারে বেশ কতগুলো মডেল এর ফ্লিপ ফোন নিয়ে আসে। আর নতুন ধরনের এই ফোন দেখে বিশাল পরিমান মানুষ এইসব ফ্লিপ ফোন এর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এদিকে আমেরিকান ও ইউরোপের মার্কেটে অ্যাপেল ও গুগলের অ্যান্ড্রয়েড এর আগমন হওয়াতে এমনিতেই সেদিকে নোকিয়ায় বাজার কমে আসছিল, অন্যদিকে এশিয়া চায়নার বাজারে স্যমসাং, মটোরোলা ও সনির দৌড়াত্বে নোকিয়া ধীরে ধীরে ছোট হতে শুরু করেছিল। অন্যদিকে চায়নায় ছোট ছোট কিছু মোবাইল কোম্পানি গড়ে উঠেছিল, যারা খুবই চিপ দামে মোবাইল ছাড়তে শুরু করে ; আর এটা ছিল নোকিয়ার জন্য আরেকটা বড় ক্ষতির কারন।

এদিকে নোকিয়ার ইঞ্জিনিয়াররা পড়ে রয়েছিল তাদের আগের সিমবিয়ান ওএস নিয়ে। অন্যদিকে অ্যাপেল তাদের আইওওস এবং গুগলের অ্যান্ড্রয়েড ইকোসিস্টেম ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। এমন বড় হয়ে গেল যে, নোকিয়ার সব মোবাইল নিয়ে তাদের বাজারে টিকে থাকা হুমকি হয়ে দাড়ালো। আসলে নোকিয়ার এখানে বড় ভুল ছিলো যে, এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নোকিয়া সফটওয়্যারে বেশি নজর দেয় নি, নোকিয়া কেবল তাদের ভালো হার্ডওয়্যার নিয়েই কাজে ব্যস্ত ছিল। তবে নোকিয়া তখন বুঝতে পারে নি যে, দুনিয়া এখন হার্ডওয়্যার নয় সফটওয়্যার মুখী হয়ে যাচ্ছে। আর এই সফটওয়্যার মুখী মোবাইল বাজারকে স্যমসাং, মটোরোলা, অ্যাপেল এর মত কোম্পানি তাদের ভালো অপারেটিং সিস্টেম এর আকর্ষনে আয়ত্ত করে নিচ্ছিল। এদিকে ২০১০ সালের ভেতর অ্যাপেল এর আইওএস এর কাছে প্রায় ৩ লক্ষ অ্যাপলিকেশন এসে জমা হয়েছিল, অন্যদিকে গুগলের অ্যান্ড্রয়েডে ততদিনে জমা হয়েছিল ১.৫ লাখের মত অ্যাপলিকেশন। আর এসব অ্যাপলিকেশনের টানে মোবাইল ইউজাররা আরো বেশি বেশি অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস এর দিকে যেতে শুরু করে। অন্যদিকে নোকিয়ার সিমবিয়ানের কাছে ২০ হাজার অ্যাপলিকেশনও ছিলনা, তো মানুষ কেন নোকিয়া ব্যবহার করবে। এখানে অ্যান্ড্রয়েড মত ডেভেলপার বান্ধব অপারেটিং সিস্টেমকে আপন করে করে নিয়ে ২০১০ এর পর থেকে স্যামসাং,এইচটিসি,সনি তাদের স্মার্টফোন মার্কেটকে ফুলে ফেপে তুলতে থাকে, অথচ নোকিয়া তখনও সিমবিয়ান নিয়ে তাদের নোকিয়া আশা সিরিজ নিয়েই পড়ে রয়েছিল।

এখানে নোকিয়ার উচিত ছিল অ্যান্ড্রয়েড এর মত একটি ইকোসিস্টেমে ঢুকে পড়া এবং সিমবিয়ানকে ছেড়ে দেয়া। তবে তারা সিমবিয়ানকে না ছেড়ে দিয়ে তাদের কর্মচারী দের ছেড়ে দিচ্ছিল তথা চাকরিচ্যুৎ করে যাচ্ছিল, এমনকি তারা তাদের সিউও ওলি পেক্কা কে পর্যন্ত বাদ দিয়ে দেয়। এবার নতুন সিইও এল মাইক্রোসফট এর পুরাতন মার্কেটিং বিজনেস হেড ‘ স্টিফেন ইলোপ’। স্টিফেন ইলোপ প্রথমেই এসে বললেন নোকিয়াতে বড় পরিবর্তন আনতে হবে, যা রয়েছে তাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। এবার নোকিয়া গুগল এর সাথে কথা বলতে যায়, অ্যান্ড্রয়েড এর সাথে কাজ করবে বলে। তবে এখন স্টিফেন ইলোপ বুদ্ধি দেয় যে, না এটা করা যাবে না, করলে আমরাও অন্যসব স্মার্টফোন কোম্পানির ভীরে চলে আসব। তারফলে নোকিয়ার অ্যান্ড্রয়েডে আসার প্ল্যান বানচাল হয়ে যায়। এবারের ইলোপের যুক্তিমতে নোকিয়া চলে যায় মাইক্রোসফট এর কাছে। এখানে নোকিয়াকে বোঝানো হয়েছিল, আমরা যদি নতুন কোনো ভালো সফটওয়্যার এর সাথে আমাদের যে ভালো হার্ডওয়্যার আছে তা যোগ করি তবে আমাদের মার্কেট আবার চলে উঠবে।

এবার নোকিয়া মাইক্রোসফটের সাথে চুক্তি করে তাদের উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম এবং তাদের হার্ডওয়্যারকে যুক্ত করে দারুন একটা স্মার্টফোন বানানোর চেষ্টা করে। এখানে উইন্ডোজ ওএস আসলে মোবাইল ডিভাইস এর হার্ডওয়্যারের সাথে কম্প্যাটিবল নয়। পাশাপাশি ডেভেলপারদের জন্যেও উইন্ডোজ কখনই ভালো মোবাইল প্ল্যাটফর্ম নয়। তাই নোকিয়ার নতুন লুমিয়া সিরিজ এখানে খুব খারাপভাবে ফ্লপ হয়। এখন উইন্ডোজ নিয়ে নোকিয়ার আবারও সিমবিয়ান এর মত অবস্হা তৈরি হয়ে গেলো। আর বিপরীত পাশে অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস এর বিশাল ইকোসিস্টেম তৈরি হয়ে বসে আছে। তার তুলনায় নোকিয়া এখন জিরো, নোকিয়ার এখানে একা রাস্তায় একাই বসে থাকার মত অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। আর এমনই একটি খারাপ সময়ে নতুন সিইও স্টিফেন ইলোপের চক্রান্তে নোকিয়াকে মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলারে মাইক্রোসফট এর নিকট বিক্রয় করতে হয়। আর এভাবে মৃত্যু হয় কিংবদন্তী এক বিশাল মোবাইল কোম্পানির।


এখন অনেকে বলবেন যে,নোকিয়া ফিরে এসেছে। তবে না সেই আগের নোকিয়া কোম্পানিটি আর নেই। এখন নোকিয়ার আগের কতজন কর্মচারী মিলে এইচএমডি গ্লোবাল নামক কোম্পানি তৈরি করে নোকিয়ার ১০ বছরের জন্য স্বত্ত মাইক্রোসফটের থেকে কিনে নিয়ে, নোকিয়া ব্র্যান্ডিং এ স্মার্টফোন বাজারজাত করছে। একসময় যে নোকিয়া নিজেই মোবাইল তৈরিতে স্বয়ংসম্পূর্ন ছিল, আজ তারা ফক্সকন থেকে মোবাইল বানিয়ে নেয়। আসলে নোকিয়া তাদের ভুল এর জন্য  তখন তাদের বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। নোকিয়া মার্কেটকে বোঝার চেষ্টা করেনি, অন্যদিকে মার্কেট এর নতুন চাহিদা বুঝতে পেরে বাকিরা বড় হয়েছে।

Images: Shutterstock.com

About the author

তৌহিদুর রহমান মাহিন

Add comment

Categories