চিপসেট : এটি কি এবং স্মার্টফোনে এটির কাজ কি?

অনেকসময় মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনে বা ওয়েবসাইটে স্পেসিফিকেশন দেখার সময় আমরা চিপসেট এর নাম লেখা দেখি। আমরা দেখি মোবাইল ফোনটিতে কোন কোম্পানির চিপসেট ব্যবহার করা হয়েছে,ইত্যাদি। তবে আপনি কি এই চিপসেট সম্পর্কে ভেবে দেখেছেন? কি আছে এতে? কিভাবে এটি স্মার্টফোন চালনা করছে?যাই হোক, আমরা যখন একটি জিনিস ব্যবহার করছি বা সেটি কিনছি, বিজ্ঞানের এই যুগে আমাদের জানা উচিত তিভাইসটির ভিতরে কি কি কম্পোনেন্ট  আছে; কিভাবে তা কাজ করছে, ইত্যাদি। সেজন্য আজ আমরা জানব স্মার্টফোনের চালক চিপসেট সম্পর্কে,জানব এটি আসলে কি? কি আছে এতে!

ম্পিউটার হার্ডওয়্যার গুলোর দিকে তাকালে সহজেই সনাক্তকরণ করা যায়; কোনটা কোন পার্টস বা কোনটার কাজ কি। তবে স্মার্টফোন এর ব্যাপারে এটা কখনই সেভাবে বোঝা যায় না,কারন ফোন খুললে আমরা শুধু দেখি কালো কালো আইসি।এই আইসির মত দেখতে নানারকম চিপস মিলেই সমন্বিত স্মার্টফোন চিপসেট।

স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে চিপসেট হল কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের সমষ্ঠির মত । অর্থাত,চিপসেট হল স্মার্টফোনের মাদারবোর্ড । আমরা জানি একটা মাদারবোর্ড হল সেই পার্টস; যেখানে ডিভাইস এর যাবতীয় সব স্টোরেজ, র‍্যাম ,প্রোসেসর ইত্যাদি যুক্ত অবস্হায় থাকে। কম্পিউটার মাদারবোর্ডেও চিপসেট রয়েছে, তবে সেখানে চিপসেটগুলো ওভারক্লকিং,ভোল্টেজ কন্ট্রোল ও কিছু ফাংশন নিয়ন্ত্রন এর কাজ করে। স্মার্টফোনের এই মাদারবোর্ড হল চিপসেট। কম্পিউটার যেমন গ্রাফিক্স কার্ড,প্রেসেসর, র‍্যাম,সাউন্ডকার্ড ইত্যাদির জোড়ে চলে, স্মার্টফোনও এগুলোর ব্যবহার করেই চলে। তবে সাইজে ছোট হওয়ার কারনে এদের গঠন সম্পূর্নভাবে ভিন্ন।

 

চিপসেট হল স্মার্টফোনের সেই অংশ যার সাথে মোবাইল বা স্মার্টফোনের সকল কম্পোনেন্ট যুক্ত থাকে। মোবাইলের যাবতীয় সবরকম কম্পিউটিং সম্পর্কিত কাজ করে এই চিপসেট। মোবাইলে এই চিপসেট কাজ মাদারবোর্ড হিসেবে। তবে আরেকটি টার্ম রয়েছে যাকে বলা হয় SoC [System on Chip]। এই SoC স্বয়ং চিপসেট সহ সবগুলো কম্পোনেন্ট,আইসি এগুলোকে  এক জায়গায় যুক্ত করে রাখে। SoC কে অনেকে চিপসেট বলে এক করে ফেলে, তবে এটা একটা আলাদা টার্ম ।

মিডিয়াটেক, কোয়ালকম,এক্সিনস,কিরিন,সার্জ এগুলোকে প্রোসেসর না বলে চিপসেট বলাই ভালো।


চিপসেট এর গঠনঃ

স্মার্টফোনের চিপসেট কতগুলো বেসিক কম্পোনেন্ট এর সমন্বয়ে গঠিত হয়। এগুলো সব আইসি আকারে সমন্বিত ভাবে সার্কিটবোর্ডে সংযুক্ত থাকে, আমরা কালো কালো যা দেখতে পাই আরকি। মূলে থাকে একটা CPU ও GPU কমবাইন্ড ভাবে। এদের অধীনে অনেক দরকারি চিপ থাকে । 

CPU: সিপিইউ হল চিপসেট এর মূল কন্ট্রোল প্যানেল। এটিই সবগুলো কম্পোনেন্টকে পরিচালনা করে থাকে। কোয়ালকম ও মিডিয়াটেক এর চিপসেটে মূলত ARM এর Cortex A7/A9/A15 ইত্যাদি ভিত্তিক হয়ে থাকে। CPU হল মোবাইল হার্ডওয়্যার এর মধ্যে সবচাইতে শক্তিসালী কম্পোনেন্ট। বেশির ভাগ চিপসেট নির্মাতা কোম্পানি সিপিইউ হিসেবে ARM এর আর্কিটেকচার ব্যবহার করে থাকে। ARM এর পূর্নরূপ হল Advance RISC Machine। উদাহরন হিসেবে কুয়ালকম এর স্ন্যাপড্রাগন ৬২৫ চিপসেটে সিপিইউ হিসেবে ব্যবহার করা আছে ৮এক্স কর্টেক্স এ৫৩ আর্কিটেকচার এবং যার বাজ স্পীড ২.০ গিগাহার্জ। আর এই CPU এর ওপর ক্যামেরা ক্ষমতাও নির্ভর করে। যেমন স্ন্যাপড্রাগন ৬২৫ চিপসেট ডুয়াল ক্যামেরা ১৩ মেগাপিক্সেল এর ও সিঙ্গেল ক্যামেরা ২৪ মেগাপিক্সেল পর্যন্ত হ্যান্ডেল করতে পারবে।

GPU: গ্রাফিক্স প্রোসেসিং ইউনিট বা কম্পিউটার এর ভাষায় গ্রাফিক্স কার্ড। স্মার্টফোনের জন্য এটি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরন হিসেবে স্ন্যাপড্রাগন ৪৩৫ চিপসেট এর কথা বলা যেতে পারে। এখানে আমরা দেখতে পারি কোয়ালকম এর নিজস্ব আর্কিটেকচার এর এডরিনো ৫০৫ গ্রাফিক্স প্রোসেসিং ইউনিট ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে মিডিয়াটেক প্রোসেসরে ব্যবহার করা হয়ে থাকে ARM এরই তৈরি Mali আর্কিটেকচার। GPU এর ওপর ফোনের গেমিং, ডিসপ্লে, ভিডিও প্লেয়িং সহ অন্যান্য সকল গ্রাফিক্স ভিত্তিক কার্যকলাপ পরিচালিত হয়।

Memory: আমরা একে বলতে পারি র‍্যাম। এটি চিপসেট এর প্রান, চিপসেটের জান। র‍্যাম DDR বিভিন্ন হয়ে থাকে। DDR যত বেশি এর গতি তত ভালো হয়। ভালো চিপসেটে, যেমন স্ন্যাপড্রাগনে LP-DDR বা Low Power DDR র‍্যাম ব্যবহৃত হয়, যার পাওয়ার কনজিউমিং হার কম বা ব্যাটারি কম খরচ করে।

অন্যান্য চিপ

  • মডেম: চিপসেটে থাকা গুরুত্ববহ আরেকটি চিপস হচ্ছে নেটওয়ার্ক মডেম। এর ওপর ডিভাইসটি ৪জি সাপোর্টেড না ৩জি তা নির্ভর করবে।
  • সেন্সর প্রোসেসিং: স্মার্টফোনে তো আর একটি সেন্সর থাকে না, অনেক সেন্সর থাকে, তাই এইসকল সেন্সর এর কাজের ধারা সমন্বয় করার জন্য আধুনিক চিপসেট গুলোতে সেন্সর প্রোসেসিং ইউনিট বিদ্যমান থাকে।
  • ডিসপ্লে প্রোসেসিং: আসলে চিপসেট এর মূলে থাকে হল CPU, GPU আর Memory বাকি সব হল এদপর অধিনস্হ কর্মচারী। তেমনই GPU এর অধিনে ডিসপ্লে প্রোসেসিং এর জন্য আলাদা একটা চিপ দেখা যায়, তা ডিসপ্লেতে সচরাচর কী দেখানো হচ্ছে, সেসব বিষয় নিয়ন্ত্রন করে থাকে।
  • ডিএসপি: আধুনিক আইসিটি ডিভাইস এর কমান্ড বোঝার মূল ক্ষমতাই হল সিংনাল, আর এইসব নানাবিধ সিংনাল বোঝার ক্ষমতা এনে দেয় DSP বা ডিজিটাল সিংনাল প্রোসেসিং ইউনিট। স্ন্যাপড্রাগন ৪৩৫ চিপসেটে কুয়ালকম এর হেক্সাগন ৫৩৬ DSP চিপ ব্যবহার করা হয়। আর এই সকল DSP অ্যানালগ সব সিংনালকে ডিজিটালি রূপান্তরিত করে প্রোসেসিং করে, দরকার পরলে অন্যালগ সিংনালে আবার পররিন করে।
  • আইএসপি: ISP বা Image Sensor Prossesor ক্যামেরা সেন্সরকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে। এটি মোবাইল চিপসেট এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ন অংশ। এটির কারনে মোবাইলে ছবি তোলার সময় কোনো ফোনে ল্যাগ হয়, আবার কোনো ফোনে ল্যাগ হয়না।
  • কানেক্টিভিটি: এর জন্য GPS, Wifi,Bluetooth এর মত ছোট ছোট চিপস পাওয়া যায়। যা স্মার্টফোন এর কানেক্টিভিটি ও শেয়ার এবিলিটিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। ইউএসবি এর জন্যও স্মার্টফোনে একটা ডেডিকেটেড চিপ থাকে।
  • কুইক চার্জিং:যেসব স্মার্টফোন কুইক চার্জিং সাপোর্ট করে তাদের জন্য চিপসেটের সাথে একটি ২.০ বা ৩.০ কুইক চার্জিং চিপ এরও দেখা পাওয়া যায়।
  • অডিও চিপ: সর্বশেষ বলব অডিও চিপ বা কম্পিউটারের ভাষায় সাউন্ড কার্ড এর কথা। সকল চিপসেটেই সাউন্ড তথা অডিও এর জন্য কমবাইন্ড বা ডেডিকেটেড অডিও চিপ দেখা যায়। উদাহরন হিসেবে স্ন্যাপড্রাগন ৪৩৫ চিপসেটে অডিও প্রোসেসিং চিপ হিসেবে রয়েছে “কুয়ালকম অ্যাকস্টিক” অডিও চিপসেট।

বর্তমান সময়ে এই সকল চিপসেট গুলো ন্যানোটেকনোলজিতে আরও কম ন্যানোমিটার আর্কিটেকচারে তৈরি হয়ে আকারে যেমন ছোট হয়েছে, তেমনই গতিও আরও বেড়েছে। কয়েক বছর আগেও সব ২৮ ন্যানোমিটার টেকনোলজির চিপসেট দেখা যেত। আর এখন সেই দামে ১৪ ন্যানোমিটার চিপসেট চলে এসেছে। চিপসেট এর আধুনিকায়নই স্মার্টফোনের বিপ্লবের একমাত্র কারন।

বর্তমানে স্মার্টফোনের চিপসেট তৈরির দিক দিয়ে মূল যে’দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা হল মিডিয়াটেক ও কোয়ালকম। কোয়ালকম চিপসেট মডিউল তথা সবগুলো কম্পোনেন্ট এর ওপর সমান নজর দিয়ে তা ভালোভাবে অপটিমাইজ ও ডিজাইন করার ফলে, বাজারে তারাই এগিয়ে রয়েছে। ব্যবহারকারীরা এই চিপসেট থেকে একটা ভালো ব্যাকআপ পাচ্ছে। আর এ’কারনে নামিদামি ব্র্যান্ড এর ভালো স্মার্টফোনে কোয়ালকম এর স্ন্যাপড্রাগন প্রোসেসরই কেবল দেখতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে,মিডিয়াটেক এক বিপুল পরিমান স্মার্টফোন দখল করে রাখলেও, এরা সবদিক দিয়ে নিজেদের চিপসেটকে অনবদ্য করতে পারছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিডিয়াটেক গতি এবং গ্রাফিক্স উন্মত করতে পারলেও, ব্যাটারির দিক দিয়ে একেবারে খারাপ ভাবে পারফর্মেন্স প্রদান করছে।

উন্নতমান ও প্রযুক্তিসম্পন্ন চিপসেটের কারনেই, আমরা আজ আমরা কম্পিউটার এর মত কার্যক্ষম স্মার্টফোন হাতে নিতে পারছি। যে স্মার্টফোন ডিজিটাল ক্যামেরার বাজারকে একপ্রকার দুর্বল করে দিয়েছে। আশা করি আজকের আর্টিকেল থেকে চিপসেট কি এবং এর মূল ভিত্তি এর গঠন সম্পর্কে ধারনা পেয়েছেন। চিপসেট প্রযুক্তির খুবই বিস্তৃত একটি অধ্যায়,এখানে জানার বহু কিছু আছে। প্রতিনিয়ত চিপসেট টেকনোলজিতে নতুন নতুন কিছু যুক্ত হচ্ছে, আমরা হাতে পাচ্ছি বিস্ময়কর কিছু।

Images: Shutterstock.com

About the author

তৌহিদুর রহমান মাহিন

Add comment

Categories