ইমোজি : ইতিহাস এবং সময়ের সাথে এর বিবর্তন! ????

ইমোজি জিনিসটির সাথেও পরিচিত নয় এমন ইন্টারনেট ইউজার বা স্মার্টফোন ইউজার খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। কারণ, এখন বলতে হলে ইমোজি আমাদের টেক্সট করার অন্যতম একটি অপরিহার্য জিনিস। আমাদের মধ্যে অনেকেই কোনো ইমোজি ছাড়া ২ লাইন টেক্সটও করতে পারেনা। যেমন- আমি নিজেই। ইমোজি ছাড়া টেক্সটই অসম্পূর্ণ মনে হয়। ইমোজি আবার বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেম অনুযায়ী ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। উইন্ডোজ এর ইমোজি একরকম, অ্যান্ড্রয়েড এর ইমোজি আরেকরকম, আবার আইওএস এর ইমোজি আরেকরকম। আবার অনেক সোশ্যাল মিডিয়ারও নিজের ইমোজি স্টাইল আছে। যেমন ফেসবুকের ইমোজি একরকম, মেসেঞ্জারের ইমোজি আরেকরকম, আবার টুইটারের ইমোজি আরেকরকম। যাইহোক, আজকে আমরা একটু টেকনিক্যাল সাইড থেকে বাইরে বেরিয়ে ইমোজি নামক এই মজার জিনিসটির ইতিহাস এবং বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করবো।


ইমোজি-র ইতিহাস

সত্যি কথা বলতে ইমোজি জিনিসটির নির্দিষ্ট কোনো একজন ক্রিয়েটর বা ডিজাইনার নেই। আর প্রাইমারিলি যিনি ইমোজি তৈরী করেছিলেন, তিনি কখনোই ধারণা করেননি যে এই ইমোজি এতো বছর পরে মানুষ এভাবে প্রত্যেকদিন ব্যবহার করবে। কিন্তু আমরা এই যেসব হ্যাপি ফেস, স্যাড ফেস, গ্রিন ইমোজি, ব্যাঙ ইমোজি ব্যবহার করি, আপনি হয়তো জানেন না যে এইসব ইমোজি আপনি বা আমি যতটা ধারণা করি তার থেকেও অনেক বেশি পুরোনো।

আপনি হয়তো আগে পুরোনো অনেক নোকিয়া জাভা মোবাইলে টেক্সট করার সময় ইমোটিকন (Emoticons) ব্যবহার করেছেন। এই ইমোটিকন গুলোই মূলত ইমোজির পুরোনো ভার্সন বলতে পারেন। এসব ইমোটিকন হচ্ছে মূলত কিছু ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন যেগুলো কিছু পাংচুয়েশন মার্ক দিয়ে তৈরী করা হয় যেমন- :'( >-< :3 :v :p ইত্যাদি। যখন ইমোজি ছিল না তখন এসবই ইমোজির পরিবর্তে ব্যবহার করা হতো মানুষের ইমোশন বোঝানোর জন্য। যদিও এসব এখনো অনেক জাভা ফোনে বা অনেক নন-মাল্টিমিডিয়া ফোনে ব্যবহার করা হয়। তবে এখন আফোর্ডেবল স্মার্টফোনের যুগে এসব ইমোটিকনের ব্যবহার নেই বললেই চলে। এই ইমোটিকন এর আপগ্রেডেড ভার্সনই বলতে পারেন ইমোজি যা এখনকার আমাদের টেক্সট এর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আপনি জানলে হয়তো অবাক হবেন যে এই ইমোটিকন সর্বপ্রথম তৈরী হয় এবং প্রকাশ হয় ১৮৮১ সালে একটি আমেরিকান লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনে, যার নাম Puck Magazine। এই ম্যাগাজিনে চারটি আলাদা আলাদা ফেস সিম্বল পাবলিশ করা হয় যেগুলোর একেকটি ফেস এককেটি ইমোশন নির্দেশ করে এবং এই ফেসগুলোকে তারা নাম দেয়, টাইপোগ্রাফিক্যাল আর্ট

 

কিন্তু এসব ইমোটিকন কিন্তু তখন থেকেই ব্যবহার শুরু হয়নি। এই টাইপোগ্রাফিকাল আর্টগুলো সর্বপ্রথম সাধারণ মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত হয় তার আরো প্রায় ১০২ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৮২ সালে। ইমোটিকন ব্যবহার প্রচলন শুরু হয় প্রথম একটি ইউনিভার্সিটিতে যার নাম Carnegie Mellon University। এই ইউনিভার্সিটিতে ইমোটিকন ব্যবহার করার হটাৎ প্রয়োজন পড়ে যখন ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরা ভার্সিটির ডিজিটাল মেসেজ বোর্ডের সিরিয়াস মেসেজগুলো এবং জোকসগুলোর মধ্যে কোনো ডিফারেন্স করতে পারছিলো না। তখন জোকসকে সিরিয়াস মেসেজ থেকে আলাদা করার জন্য এই ইমোটিকন ছাড়া আর কোনো ওয়ে ছিলোনা। তখনই এই ইনিভার্সিটির একজন ফ্যাকাল্টি মেম্বার, Scott Fahlman একটি আইডিয়া বের করেন।  তার আইডিয়াটি ছিল এমন যে, ডিজিটাল মেসেজ বোর্ডের সব জোকসগুলোর পাশে 🙂 এই সিম্বলটি অ্যাড করা হবে এবং সকল সিরিয়াস মেসেজের পাশে 🙁 এই সিম্বলটি অ্যাড করা হবে। তিনি ভার্সিটির সব ছাত্রদের এই সিম্বলগুলোকে সাইড থেকে পড়তে বলেন যাতে তারা এগুলোর অর্থ সহজে বুঝতে পারে এবং জোকস ও সিরিয়াস টেক্সটগুলোর মধ্যে ডিফারেন্স করতে পারে। তো এখানেই মূলত ইমোটিকন প্রথম ব্যবহার করা হয়।

আচ্ছা, এই হলো ইমোটিকনস এর ব্যাপার। কিন্তু ইমোটিকন এর যে মডার্ন ভার্সন অর্থাৎ আমাদের চিরপরিচিত ইমোজি, এটা কার তৈরী? এই ইমোজি প্রথম তৈরী করা হয় ১৯৯৮ সালে। তৈরী করেন Shigetaka Kurita নামের একজন জাপানিজ ইঞ্জিনিয়ার যিনি জাপানের NTT Docomo একটি ফোন কোম্পানিতে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি মূলত এমন একটি উপায় খুঁজছিলেন, যার সাহায্যে তাদের আইকনের সাহায্যেই একে অন্যের সাথে অনেকটা কমিউনিকেট করতে পারে। তখনই তার মাথায় আসে এই ইমোটিকনগুলোকে আরো বেটারভাবে রিক্রিয়েট করার ব্যাপারটি। ফলস্বরূপ, তিনি ১৭৬ টি ছোট ছোট আইকনের সেট তৈরী করেন যেগুলোকে তিনি নাম দেন ইমোজি। তিনি এই নামটি সিলেক্ট করেন দুটি জাপানিজ শব্দ মিলিয়ে। জাপানিজ ভাষায় E অর্থ হচ্ছে পিকচার এবং Moji অর্থ হচ্ছে ক্যারেক্টার। অর্থাৎ Emoji শব্দটির সম্পূর্ণ অর্থ হচ্ছে Picture of Character বা ক্যারেক্টারের পিকচার। আর হ্যা, Emoji একটি জাপানিজ শব্দ। যিনি এসব ইমোজি তৈরী করেন, তিনি বলেন যে, তিনি এসব ক্যারেক্টার তৈরী করার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন সূর্য থেকে এবং Manga চাইনিজ ক্যারেক্টার থেকে, যেখানে তিনি সূর্যকে ইমোজির সম্পূর্ণ ফেস হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অবশ্যই স্বাভাবিক কারণেই তার তৈরী করা ইমোজিগুলো এখনকার মতো এতো বেশি নিখুঁত এবং সুন্দর দেখতে ছিলোনা। তিনি সর্বপ্রথম যে ইমোজির সেটগুলো তৈরী করেছেন সেগুলো কেমন ছিল নিচে দেখুন-

 

এই ইমোজিগুলো প্রথমে NTT Docomo  গ্রাহকদের মধ্যে লিমিটেড থাকার পরে, যখন ২০০৭ সালে স্টিভ জবস প্রথম আইফোন  লঞ্চ করেন, তখন এই ফোনে এসব ইমোজির সাপোর্ট দেওয়া হয়। তখন এভাবেই এই ইমোজি জাপানের বাইরে পৃথিবীর গ্লোবাল কনজিউমারদের সামনে আসে। এছাড়া এর আগেও NTT Docomo প্রথম ইমোজি রিলিজ করার পরে জাপানের আরো অনেক ক্যারিয়ার এবং নেটওয়ার্ক এসব ইমোজি তাদের নিজেদের লাইব্রেরিতে অ্যাড করে যাতে এসব ইমোজি শুধুমাত্র NTT Docomo  গ্রাহকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। কিন্তু প্রথম আইফোনের সাথে সাথে যখন এটি গ্লোবাল কাস্টোমারদের সামনে আসে তখন এই প্রত্যেকটি ইমোজি শুধুমাত্র আইফোনে বিভিন্ন এপ্লিকেশন এর ভেতরে রিড করা যেত বা দেখতে পাওয়া যেত। কিন্তু নিজের ইচ্ছামতো ইমোজি ইনপুট করার কোনো ব্যবস্থা ছিলোনা। এরপরে আরো অনেকদিন পরে আইওএস ফাইভের থেকে আইফোনের কিবোর্ডে ইমোজি ইনপুট করার ফিচারটি যোগ করা হয় এবং প্রত্যেকটি ইমোজি রিডিজাইন করা হয় আরেকটু মডার্ন লুক দেওয়ার জন্য।

কিন্তু এখানেও আরেকটি সমস্যা শুরু হয়। তা ইমোজি গুলো মাল্টি প্লাটফর্ম সাপোর্টেড ছিলোনা। অর্থাৎ দেখা যেত সব ইমোজি সব অপারেটিং সিস্টেমে সাপোর্ট করতোনা। এই সমস্যা সমাধানের জন্যই ২০১০ সালে ইমোজির কোডগুলো ইউনিকোড লাইব্রেরিতে অ্যাড করা হয়। এর ফলে বিভিন্ন এপ্লিকেশন বা বিভিন্ন ক্যারিয়ার বা বিভিন্ন কোম্পানি তাদের নিজেদের কাস্টম ডিজাইনড ইমোজি তৈরী করলেও প্রত্যেকটি ইমোজির মূল কোড একই থাকে। এর ফলে এখন যদি আপনি আইফোন থেকে আপনার বন্ধুর অ্যান্ড্রয়েড ফোনে টেক্সট করেন এবং ইমোজি সেন্ড করেন, তাহলে তার কাছে তার অপারেটিং সিস্টেম অনুযায়ী ইমোজিটি শো করবে। তখন আপনার ইমোজিটি তার কাছে আনসাপোর্টেড দেখাবে না। ঠিক তেমনি, আপনি যদি টুইটারের থেকে একটি ইমোজি কপি করে এনে ফেসবুকে পেস্ট করেন, তাহলে ফেসবুক সেই ইমোজিটি তাদের নিজেদের ডিজাইন ল্যাংগুয়েজ অনুযায়ী তাদের লাইব্রেরি থেকে আবার তৈরী করবে। এর ফলেই ইমোজি প্লাটফর্ম এবং সোশ্যাল মিডিয়া এবং অপারেটিং সিস্টেম ও ক্যারিয়ারের ওপরে নির্ভর করে একেক জায়গায় একেকরকম হয় যদিও সবগুলোর কোড এবং সবগুলোর এক্সপ্রেশন একই জিনিস বা একই ইমোশন নির্দেশ করে।

আর এই ইউনিকোডে ইমোজি অ্যাড করার সুবাদেই এখন আমরা এতো ধরণের এবং এতো অসংখ্য পরিমান ইমোজি দেখতে পাচ্ছি এবং ব্যবহার করতে পারছি। এখন প্রায় সব প্লাটফর্ম এবং অপারেটিং সিস্টেম মিলিয়ে প্রায় ১৮০০+ ইমোজি আছে। হাসির ইমোজি থেকে শুরু করে টয়লেট সিট ইমোজিও আছে আমাদের কাছে এখন। এবং বিগত বছরগুলোর মতো সামনের বছরগুলোতে এভাবেই আরো নতুন নতুন ইমোজি যোগ হতে থাকবে লাইব্রেরিতে এবং ইমোজির আরো অনেক নতুন নতুন রিডিজাইন দেখবো আমরা।


আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। আশা করি আজকের আর্টিকেলটিও আপনাদের ভালো লেগেছে। কোনো ধরণের প্রশ্ন বা মতামত থাকলে অবশ্যই কমেন্ট সেকশনে জানাবেন।

Images: Shutterstock.com

About the author

সিয়াম

Add comment

Categories