ফ্রীওয়্যার কি? ফ্রীওয়্যার আর ফ্রী সফটওয়্যার কিন্তু এক জিনিষ নয়! [ব্যাখ্যা]

সবকিছুর দাম আকাশে চড়ে থাকার এই যুগে মনে হয় একমাত্র কম্পিউটার প্রোগ্রামই আছে লাখো যেগুলো এখনো ফ্রীতে পাওয়া যায়। ফ্রী বলতে কিন্তু পাইরেটেড ভার্সন নয়, বরং অফিশিয়াল ভাবেই সেই সফটওয়্যারটি সম্পূর্ণ ফ্রী। তবে কম্পিউটিং ওয়ার্ল্ডে “সফটওয়্যার” এই টার্মটির সাথে বেশকিছু টার্ম জরিয়ে রয়েছে যার মানে “বিনা মূল্যের সফটওয়্যার” কে নির্দেশ করা হয়, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে টার্ম গুলো শুনতে বা এদের বৈশিষ্ট্য অনেকটা একই প্রকৃতির, আর এই জন্যই বিভ্রান্ত হয়ে পড়া অনেক সহজ। দেখুন, ওপেন সোর্স সফটওয়্যার নিয়ে তো এক আর্টিকেলে আলোচনা করে বিষয়টি পরিষ্কার করেছি, কিন্তু ফ্রী সফটওয়্যার টার্মটির সাথে আরো দুইটি টার্ম জুরিয়ে রয়েছে, ফ্রীওয়্যার এবং ফ্রী সফটওয়্যার। তো এই দুই টার্মকি একই? — চলুন, এই আর্টিকেল থেকে সমস্ত কিছুর বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।


ফ্রীওয়্যার

ফ্রীওয়্যার আসলে একত্রে দুইটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত, ফ্রী এবং সফটওয়্যার। তবে ফ্রী সফটওয়্যার বলেও কিন্তু আরেকটি আলাদা টার্ম রয়েছে, যাই হোক সেটা নিয়ে নিচে আলোচনা করছি। ফ্রীওয়্যার মানে এমন সফটওয়্যার বা সফটওয়্যার গোষ্ঠীকে বুঝনো হচ্ছে যারা ব্যবহার করতে ১০০% ফ্রী, আপনাকে কোন মুল্য প্রদান করতে হবে না। শুধু তাই’ই নয়, আপনাকে কোন লাইসেন্স নিতে হবে না, কোন বাঁধা নেই আপনি কতোবার সফটওয়্যারটি ডাউনলোড করবেন বা ইন্সটল করবেন, কোন ধরা নেই আপনি কতোবার সফটওয়্যারটি ওপেন করবেন বা আপনার কতো গুলো কম্পিউটারে ব্যবহার করবেন, এবং সফটওয়্যার গুলোকে অনন্ত কালের জন্য ফ্রীতে ব্যবহার করতে পাড়বেন, এতে কোন টাকা বা ডোনেশন করার প্রয়োজন পড়বে না।

 

ফ্রীওয়্যার মানে কিন্তু ফ্রী সফটওয়্যারই, কিন্তু হুবহু ফ্রী সফটওয়্যার টার্মটিই নয়। যদিও ফ্রীওয়্যার সম্পূর্ণ ফ্রী, তারপরেও এতে কিছু বাঁধা থাকতে পারে কিন্তু অপরদিকে যদি ফ্রী সফটওয়্যার টার্ম নিয়ে কথা বলা হয়, সেটা সম্পূর্ণ বা বলতে পারেন ১০০% যেকোনো বাঁধা ফ্রী, আপনি ফ্রী সফটওয়্যার ডিস্ট্রিবিউট ও করতে পাড়বেন, আপনি টাকাও ইনকাম করতে পাড়বেন, কোন সমস্যা নেই।

ফ্রীওয়্যার Vs ফ্রী সফটওয়্যার

যদি এক কথায় এই দুই টার্মের মধ্যে পার্থক্য করতে যাই, ফ্রীওয়্যার হচ্ছে বিনা মুল্যে ব্যবহার করার জন্য সফটওয়্যার, কিন্তু ফ্রী সফটওয়্যার হচ্ছে বিনা মুল্য প্লাস বিনা কপিরাইট নিয়মে ব্যবহার করার জন্য সফটওয়্যার। সত্যি বলতে এই টার্ম গুলো কিন্তু মোটেও নতুন নয়, ১৯৮০ সালের দিকে রিচার্ড স্টলম্যান জিএনইউ প্রোজেক্ট (GNU Project) তৈরি করেন, যেখানে ফ্রী অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করা হতো, ঠিক তখনোই তিনি ফ্রী সফটওয়্যার ফাউন্ডেশন উদ্ভাবিত করেন। ফ্রীওয়্যারে কেবল আপনি বলতে পারেন এর দাম জিরো হবে কিন্তু আপনাকে তারপরেও কিছু রুল মেনে চলতে হতে পারে, কিন্তু ফ্রী সফটওয়্যার টার্মে দাম জিরোতো হবেই সাথে এখানে “ফ্রী” বলতে “ফ্রীডম” এর সাথে তুলনা করতে পারেন।

 

ফ্রী সফটওয়্যার মানে, আপনি যা ইচ্ছা তা করার জন্য প্রস্তুত, আপনি সফটওয়্যার এডিট করতে পাড়বেন, নতুন ভাবে প্রোগ্রাম করতে পাড়বেন, এক প্রোগ্রাম থেকে সম্পূর্ণ আরেক প্রোগ্রামে রূপান্তরিত করতে পাড়বেন, মানে মূল সফটওয়্যারটি রিলিজ করার সাথে সাথে ডেভেলপার সফটওয়্যারটি থেকে সম্পূর্ণ বাঁধা সরিয়ে নেয় এবং সোর্স কোড উন্মুক্ত করে দেয় যাতে যে কেউ সফটওয়্যারটি যেকোনো ভাবে ব্যবহার করতে পারে। এই টাইপের ফ্রী সফটওয়্যার গুলোকে সাধারণত ওপেন-সোর্স সফটওয়্যার বা ফ্রী ওপেন-সোর্স সফটওয়্যার বলা হয়ে থাকে।

ফ্রী সফটওয়্যার ফাউন্ডেশন মূলত ৪টি প্রধান ফ্রীডম নিশ্চিত করে,

  1. Freedom 0: যেকোনো ব্যাবহারের ক্ষেত্রে আপনি অ্যাপ্লিকেশনটি রান করতে পাড়বেন, হোক সেটা ব্যাক্তিগত বা ব্যবসায়ীক।
  2. Freedom 1: আপনি প্রোগ্রামটি কীভাবে কাজ করে তার উপর গবেষণা করতে পাড়বেন, এবং আপনার ব্যবহার অনুসারে প্রোগ্রামটিকে যা ইচ্ছা তা অনুসারে পরিবর্তন করে নিতে পাড়বেন।
  3. Freedom 2: আপনি স্বাধীনভাবে এই টাইপের সফটওয়্যারকে ডিস্ট্রিবিউট করতে পাড়বেন, আপনি ডাউনলোড ওয়েবসাইট বানিয়ে এই সফটওয়্যার গুলোকে ফ্রীতে অনলাইন শেয়ার করতে পাড়বেন।
  4. Freedom 3: আপনি একই প্রোগ্রামকে ডেভেলপ করতে পাড়বেন এবং সেটার উন্নত ভার্সন রিলিজ করতে পাড়বেন যাতে মানুষের সাহায্য হয়।

ফ্রী সফটওয়্যার অনলাইনে ডিস্ট্রিবিউট করে আপনি অনেক টাকা উপার্জন করতে পাড়বেন, আমি নিজেও এক সময় ফ্রী সফটওয়্যার ডিস্ট্রিবিউট করতাম, আর এটা ১০০% আইনত।  GIMP, LibreOffice, এবং Apache HTTP Server হলো ফ্রী সফটওয়্যারের বেস্ট উদাহরণ।

এখন কথা বলি ফ্রীওয়্যার নিয়ে, দেখুন ফ্রীওয়্যার ব্যবহার করতে ফ্রী হলেও এতে কোন নিশ্চয়তা নেই সফটওয়্যারটির সোর্স কোড উন্মুক্ত করা হবে কিনা। অবশ্যই জিরো টাকা দিয়ে আপনি সফটওয়্যারটি ব্যবহার করতে পাড়বেন, কিন্তু এর মানে এই নয় আপনি প্রোগ্রামটি এডিট বা মডিফাই করে অন্যকিছু বানাতে পাড়বেন। যেহেতু প্রোগ্রামটির সোর্স কোড রিলিজ নাও করা হতে পারে, তাই আপনি প্রোগ্রামটিকে পর্যবেক্ষণও করতে পাড়বেন না, এটি কীভাবে কাজ করে। এর মানে অনেকটা এরকম ধরে নিতে পারেন, ফ্রীওয়্যার পার্সোনাল ইউজের জন্য ঠিক রয়েছে কিন্তু কমার্শিয়াল ইউজ করতে পাড়বেন না, হয়তো বা কমার্শিয়াল ইউজ করার জন্য লাইসেন্স নিতে হবে কিংবা পেইড ভার্সন ব্যবহার করতে হবে। কিছু ফ্রীওয়্যার ডেভেলপার তাদের প্রোগ্রামের অনেক অ্যাক্সেস দিতে পারে্‌ কিন্তু বেশিরভাগ ডেভেলপার তাদের প্রোগ্রাম কোর অ্যাক্সেস ক্লোজ বা ব্লক করে রাখে, মানে তারা যেটা বানিয়ে দিয়েছে সেটাই ব্যবহার করতে পাড়বেন আপনি নিজে উন্নতি করতে পাড়বেন না।

TeamViewer, এবং Skype কে আপনি বেস্ট ফ্রীওয়্যার উদাহরণ হিসেবে গন্য করতে পারেন।

এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, যেহেতু সফটওয়্যারটি ব্যাবহার করতে টাকা লাগে না, তাহলে কেন ডেভেলপার’রা ফ্রীওয়্যারের উপর বিভিন্ন বাঁধা লাগিয়ে দেয়? সোর্স কোড কেন পাবলিশ করে না? — দেখুন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডেভেলপারদের ঐ প্রোগ্রামের পেইড ভার্সন থাকে, আর ঐ পেইড ভার্সনকে এক প্রকারের মার্কেটিং করানোর জন্য তারা ফ্রীওয়্যার রিলিজ করে। ফ্রীওয়্যারে অনেক ফাংশন ডিসেবল করা থাকে, শুধু পেইড লাইসেন্স কিনলেই সেগুলো এনাবল হতে পারে। অনেক ডাটা রিকভারি সফটওয়্যার এর ক্ষেত্রে দেখে থাকবেন হয়তো — ফ্রীতে ডাউনলোড করতে পাড়বেন এবং হারিয়ে যাওয়া ফাইল স্ক্যানও করতে পাড়বেন, কিন্তু ডাটা রিকভার করার সময় আর সফটওয়্যারটি কাজ করবে না, আপনাকে পেইড ভার্সন কিনতে বলা হবে।

অনেক প্রোগ্রাম আবার ব্যবহার করার জন্য কোন টাকা দিতে হয় না বা তার কোন পেইড ভার্সনও নেই, কিন্তু তারপরেও সেটা ফ্রী সফটওয়্যার না হয়ে ফ্রীওয়্যার হিসেবে ডেভেলপার রিলিজ করে। এ ক্ষেত্রে সফটওয়্যার গুলোর সাথে ইন্সটলার ফাইল জুড়ে দেওয়া থাকে, মানে আপনি ঐ ফ্রীওয়্যার ইন্সটল করার সময় বিভিন্ন অ্যাডভার্টাইজ সফটওয়্যার ডাউনলোড করে ইন্সটল করে ফেলেন, আর ঐ সফটওয়্যারটি পেইড হতে পারে। যারা KmPlayer ব্যবহার করেন, অবশ্যই লক্ষ্য করে থাকবেন হয়তো, কেএম প্লেয়ার ইন্সটল করার সময় আলাদা সফটওয়্যারও সাথে ইন্সটল হয়ে যায়, তো এটা কিন্তু ফ্রী সফটওয়্যার হলো না, এটা ফ্রীওয়্যার।

তাহলে কি ওপেন সোর্স মানেই ফ্রী সফটওয়্যার?

হ্যাঁ, বেশিরভাগ ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ফ্রী সফটওয়্যার, কিন্তু সকল ওপেন সোর্স সফটওয়্যার কিন্তু ফ্রী সফটওয়্যার নয়। আপনি যদি লিনাক্স ডিট্রিবিউশনের প্যাকেজ ম্যানেজার ব্যবহার করে সফটওয়্যার ডাউনলোড করে থাকেন, সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটি সফটওয়্যার অবশ্যই ফ্রী সফটওয়্যার এবং ওপেন সোর্স। বাট, যদি কথা বলা হয় ক্রোম ওএস নিয়ে বা অ্যান্ড্রয়েড নিয়ে, এগুলো ওপেন সোর্স হলেও আপনাকে ফ্রী সফটওয়্যারের উপরের ঐ চারটি ফ্রীডম প্রদান করবে না। অ্যান্ড্রয়েড বর্তমানে বেস্ট এবং জনপ্রিয় মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম যেটা শুধু মোবাইলে নয় আরো নানান ডিভাইজে বিস্তারত ব্যবহৃত হয়, যেহেতু এটি লিনাক্স কার্নেলের উপর, তাই অনেক কিছুই মডিফাই করতে পাড়বেন, কিন্তু অ্যান্ড্রয়েড গুগল দ্বারা কপিরাইট করা, মানে আপনি কতোটুকু মডিফাই করতে পাড়বেন সেটা গুগল দ্বারা নির্ধারিত।

এক্ষেত্রে যদি ফ্রীওয়্যার নিয়ে কথা বলি, তো ফ্রীওয়্যারকে কমার্শিয়াল সফটওয়্যারের উল্টা রুপ, আপনাকে টাকা দিতে হবে না ব্যবহার করার জন্য, কিন্তু সেটা ওপেন-সোর্স হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। যদি একই সফটওয়্যারের প্রিমিয়াম ভার্সন থাকে, এবং আপনি প্রিমিয়াম ভার্সনের ফ্রী ভার্সন (ফাংশন লিমিটেড ভার্সন) ব্যবহার করেন, সেক্ষেত্রে সেটাকে ফ্রীমিয়াম সফটওয়্যার বলা হয়। ফ্রীমিয়াম টার্মটিতে ফ্রী+প্রিমিয়াম টার্ম দুইটি এম্বেড করা থাকে। শেয়ারওয়্যার বলে আরেকটি সফটওয়্যার টার্ম রয়েছে, এই টাইপের সফটওয়্যার শুধু ট্র্যায়াল পিরিয়ডের জন্য ফ্রী পাওয়া যায়, নির্দিষ্ট সময় পরে আপনাকে পেইড ভার্সনটি কিনতে হবে কিন্তু তার আগে আপনি কিছুদিন সেটাকে ফ্রী ব্যবহার করতে পাড়বেন। অনেক শেয়ারওয়্যার ডেভেলপার সম্পূর্ণ ফিচার এনাবল করে রাখে, মানে ফ্রী সময়ে আপনি পেইড ভার্সনের সমস্ত সুবিধা বা ফিচার গুলো ব্যবহার করতে পাড়বেন, আবার অনেক শেয়ারওয়্যারে অনেক প্রিমিয়াম ভার্সন ফিচারের তুলনায় অনেক ফিচার ডিসেবল করা থাকে, সেগুলোকে শুধু পে করার মাধ্যমেই এনাবল করতে পাড়বেন।


আশা করছি আর্টিকেলটি আপনার জন্য অনেক সাহায্য পূর্ণ ছিল এবং আপনি এক আর্টিকেল থেকেই অনেক টাইপের ফ্রী সফটওয়্যার নিয়ে সম্পূর্ণ বিস্তারিত এবং পরিষ্কার জ্ঞান লাভ করলেন। ডেভেলপার’রা তাদের সফটওয়্যার বা প্রোজেক্ট প্রটেক্ট করার জন্য অনেক টাইপের বাঁধা লাগিয়ে দিতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ সময় প্রায় যেকোনো টাইপের ফ্রী সফটওয়্যার পার্সোনাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনই সমস্যা করে না।

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories