মোবাইল ফোন কি আপনাকে দিন দিন অলস তৈরি করছে?

এই পকেটের আকারের কম্পিউটার যেটাকে আমরা মোবাইল ফোন বা স্মার্টফোন হিসেবে জানি, এটি আমাদের জীবনের জন্য এক মহান আবিষ্কার। কিন্তু এই মহান আবিষ্কারটি কি আমাদের দিন দিন বাকশক্তিশীন বানিয়ে ফেলছে? একটু দাঁড়ান, আমি এক্ষুনি পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করে গুগল করে বলছি 😛 । স্মার্টফোন আসক্ত বন্ধুরা, আজকের এই পোস্টটি বিশেষ করে তোমাদের জন্য।

আমারা আজকাল প্রায় সবকিছুর জন্যই আমাদের সেলফোনটি ব্যবহার করে থাকি। এটি ক্রমবর্ধমানভাবে আমাদের মস্তিস্কের একটি বিশেষ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের মস্তিস্কের তথ্য সংরক্ষনকারী জায়গা বদল হিসেবে দখল করে নিচ্ছে এই সেলফোন। যার ফলে আপনার কিছুই মনে রাখার প্রয়োজন নেই আজকাল।২০০২ সালে অর্থনীতি জন্য বরাদ্দ নোবেল পুরস্কার মনোবৈজ্ঞানিক এর কাছে চলে গিয়েছিল একটি পেপার এর জন্য। যেখানে বর্ণনা করা ছিল, এই পৃথিবীতে দুই ধরনের চিন্তাবিদ দেখতে পাওয়া যায়। একটি হলো বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাবিদ এবং আরেকটি হলো স্বজ্ঞাত চিন্তাবিদ। সাম্প্রতিক সাধারন কম্পিউটার এ মানুষের আচরন এর উপর একটি নতুন গবেষণা বলে যে, আমাদের মোবাইল ফোন এর উপর নির্ভর হওয়ার প্রবণতা আমাদের স্বজ্ঞাত চিন্তাবিদ করে তুলছে।


মোবাইল ফোন কীভাবে আপনাকে অলস করতে পারে?

আমাদের মধ্যে স্বজ্ঞাত চিন্তাবিদরা তাদের অভ্যন্তরীণ অনুভূতি অথবা স্বত:লব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। যেখানে বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাবিদরা একটি সিদ্ধান্ত গ্রহন করার জন্য প্রথমে সমস্যাটি বিশ্লেষণ করে দ্বিতীয়ত তা অনুমান করে এবং সবকিছু চিন্তা ভাবনা করে তবেই সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। এই নতুন গবেষণাটি অনুসারে স্বজ্ঞাত চিন্তাবিদরা নিজেদের মস্তিস্ক ক্ষমতা ব্যবহারের বদলে সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহারের প্রবণতা প্রকাশ করে। তারা যখন কোন তথ্য খোঁজে তখন তারা মস্তিস্কের উপর চাপ না দিয়ে সংক্ষিপ্ত ভাবে সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে, এমনকি তথ্যটি তাদের জানা থাকলেও। উদাহরন স্বরূপ মনে করুন প্রশ্ন করা হলো, উমুক মুভিতে কোন অভিনেতা অভিনয় করেছিলেন? স্বজ্ঞাত চিন্তাবিদরা প্রশ্নটি শোনার সাথে সাথে কিছু না ভেবেই পকেট থেকে মোবাইল ফোন টি বের করে ফেলবে এবং গুগল করতে শুরু করে দেবে, উত্তরটি জানা থাকলেও। কিন্তু বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাবিদরা প্রশ্নটি শোনার সাথে সাথে তাদের মস্তিস্কের উপর জোর প্রয়োগ করে খোঁজা শুরু করবে যে তারা কি জানে, এবং তারপরে তারা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবে।

এই দুইপ্রকারের চিন্তাবিদেরই কিছু আছে। কিন্তু এই নতুন গবেষণা বলে, স্বজ্ঞাত চিন্তা ধারার মানুসেরা সার্চ ক্রিয়াকলাপ অত্যাধিক বেশি ব্যবহার করে থাকে, এবং এরা কম বুদ্ধি সম্পূর্ণ হয়ে থাকে। তারা ৬৬০ জন অংশগ্রহণকারীদের উপর পরীক্ষা চালায়। এবং তাদের প্রত্যেক কেই সম্পূর্ণ করার জন্য স্বজ্ঞাত এবং বিশ্লেষণাত্মক কাজ দেওয়া হয়। এবং অবশ্যই তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করার অনুমতি ছিল। অত্যাধিক মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী গনদের ফলাফলে কম বুদ্ধি সম্পূর্ণতা লখ্য করা হয়েছিলো। এবং তাদের অলস চিন্তাবিদ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো।

অলস চিন্তা ভাবনা, জ্ঞানীয়ও কৃপণতা অবিশ্বাস্যভাবে প্রচলিত একটি বিষয়। এটি বর্ণনা করতে পারে যে আপনি কোনো কিছু ভাবতে কতটা অপছন্দ করেন। আমারা বিশ্বাস করি এবং মনে করি যে আমরা মানুসেরা ক্রমাগত ভাবে অনেক তথ্য ্মস্তিস্ক বদ্ধ করতে পারি। কিন্তু আসলে আমারা এক প্রকারের প্রাণী, আমারা কোনো মেশিন নয়। আমারা যখন কোনো কিছু চিন্তা করি তখন আমাদের শক্তি ক্ষয় হয়। আর এই শক্তি সংরক্ষণ করতে আমরা স্বাভাবিক ভাবে মানসিক শর্টকাট গ্রহন করে থাকি এবং তথ্য খোঁজা থেকে ভারমুক্ত করতে চাই নিজেকে। এটি আমাদের শক্তি সংরক্ষণের একটি বিবর্তনীয় পথ। কেনোনা আমারা মনে করি, চিন্তা ভাবনা করা আসলেই কঠিন এবং বিরক্তিকর। তাই যতো শর্টকাটে তথ্য জানা যায় তোতোই ভালো। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্কে তখনই অনেক ক্ষমতা অর্জিত হয় যখন অনেক বেশি ভাবনা চিন্তা করা হয়।

জনপ্রিয় ওয়েব সাইট গুলোকে স্বজ্ঞাত আকারে ডিজাইন করা হয়। যাতে এটি আপনার ভাবনার ভার কমিয়ে দেয়। যেমন ধরুন, আপনি আমার এই ব্লগটি থেকে যখন প্রযুক্তি বিষয়ের উপর কোনো পোস্ট পড়েন তখন এক পোস্ট থেকেই সেই বিষয়ের উপর অনেক ধারনা অর্জন করতে পারেন। কিন্তু আমি যদি সব কিছু এক জায়গাতে বিশদ করে না লিখে ভিন্ন ভিন্ন তথ্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পেজ এ যেতে বলতাম তবে কি আপনি বিরক্ত হয়ে এই সাইট টি বন্ধ করে দিতেন না? এবং আপনি এমন একটি সাইট এর অনুসন্ধান চালাতেন যেখানে একসাথে সব তথ্য পেয়ে যাওয়া যায়। কেনোনা আমরা বেশি ভাবতে এবং বিশ্লেষণ করতে চাই না।

কিন্তু সমস্যাটি হলো আমাদের মস্তিস্ক গুলো হলো নমনীয়, অনেকটা প্ল্যাস্টিক এর মতো। আমরা যখন কোন কিছুর জ্ঞান অর্জন করি তখন আমাদের মস্তিস্কের পরিবর্তন ঘটে। আমারা মস্তিস্কে নতুন নিউরাল পথ তৈরি করি এবং আমাদের চিন্তার প্রক্রিয়াকে পুনর্নির্মাণ করি। এবং বার্ধক্য বয়সে আমাদের মস্তিস্কের নিউরাল নমনীয়তা নষ্ট হয়ে যায়। এবং আমারা আর আমাদের চিন্তার প্রক্রিয়াকে পুনর্নির্মাণ করতে পারি না।

আমাদের করনীয়

 

মুলত, আমাদের জীবনকে বৈচিত্রময় এবং আনন্দময় অভিজ্ঞতায় ভরিয়ে তোলা উচিৎ। শুধু মাত্র ছুটি অথবা সামাজিক যোগাযোগ সাইট বা মোবাইল ফোন দিয়ে নয়। বরং কোনো কিছু তৈরি করা, শেখা, কাজ করা, দৌড়ানো, খেলাধুলা করা ইত্যাদি দিয়ে। এগুলো করাতে আমাদের মস্তিষ্ক সুস্থ করে তুলবে, এবং বার্ধক্য বয়সে সুপরিণতির জন্য একটি ভাল ভিত্তি তৈরি হবে। এবং আমাদের মস্তিক আরো বুদ্ধি সম্পূর্ণ হবে। চিন্তা করে দেখুন তার কথা যে তার সারাটা জীবন সার্চ ইঞ্জিন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এসেছে। সে সব তথ্য ভুলে যাবে যখন সেটা আবার দরকার পরে তখন। কারন তার মস্তিস্কে তথ্য জমা করার পুরো জায়গাতে অবস্থান করছে স্মার্টফোন আর সার্চ ইঞ্জিন। এবং তার বুদ্ধিমত্তার বিকাশও ভালো ভাবে হবে না। এবং এটি খুবই খারাপ বিষয়।

ইন্টারনেট, টেলিভিশন, রেডিও এগুলো প্রযুক্তির একেকটি বিশেষ উপাদান। এগুলো আপনার বুদ্ধির বিকাশ এবং তথ্য সংগ্রহে বিশেষ সাহায্য করে থাকে। কিন্তু কোনো কিছু নিজে মস্তিস্কে না ভেবে শুধু এই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে যাওয়াটা আলাদা বিষয়। এটি অনেকটা স্কুলের প্রত্যেকটি টেস্ট পরীক্ষায় চিট করার মতো। আপনি যদি সব কিছু অন্নের দেখে লেখে পাস করেন তবে কি আপনাকে আসল গ্র্যাজুয়েট বলা যায়? আমি মোবাইল ফোন কিংবা সার্চ ইঞ্জিন এর বিরুদ্ধে কথা বলছি না। কিন্তু সার্চ ইঞ্জিন থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান এবং বাস্তব জীবন থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান এর মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। তাই শুধু জ্ঞান অর্জন বা তথ্য খোজার জন্য সার্চ ইঞ্জিন এর উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের মস্তিস্কের উপর বিশেষ জোর প্রয়োগ করুন। তথ্য গুলোকে বেশি বেশি করে মস্তিস্কে রাখার চেষ্টা করুন। এতে আপনার মস্তিস্ক সঠিক ভাবে বিকাসিত হবে এবং আপনার চিন্তা ভাবনায় বিশেষ পরিবর্তন আসবে।

শেষ কথা

কথা বলতে বলতে একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আমার কাছে যতোটুকু জ্ঞান ছিলো আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করেছি। আশা করি এখন বুঝতে পেড়েছেন যে কীভাবে মোবাইল ফোন এবং সার্চ ইঞ্জিন আপনাকে দিন দিন অলস তৈরি করছে। এবং আপনি আজ এটাও জানলেন যে কীভাবে আপনি এই অলস হওয়া থেকে নিজেকে রখ্যা করতে পারবেন। আমি জানি আজকের এই পোস্টটি আপনাদের অবশ্যই ভালো লেগেছে, তাই অবশ্যই শেয়ার করতে ভুলবেন না দয়া করে। আপনি কি মোবাইল ফোন আসক্ত? আপনি কি নিজে কিছুই ভাবতে পছন্দ করেন না? নিচে কমেন্ট করে আমাকে সব কিছু জানাতে পারেন। আশা করি সেখানে অনেক ভালো আলোচনায় লিপ্ত হতে পারবো আপনার সাথে।

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories