স্মার্ট হোম কি? আপনার বাড়ি নিয়ন্ত্রন করবে কম্পিউটার?

আমরা মানুষেরা পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে স্মার্ট জীব। অন্যান্য প্রাণীদের মতো আমরা হামাগুড়ি দিয়ে, লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে, দৌড়াদৌড়ি করে সারা পৃথিবী চলি না। আমাদের কোন সমস্যা হলে আমরা একে অপরের সাথে কথা বলি, কোন বিষয় নিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হয় এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিন বদলের সাথে আমরা নিজেদেরও বদলিয়ে নিয়েছি প্রয়োজন অনুসারে; আমাদের চারপাশে সর্বদা সাহায্য করার জন্য রয়েছে নানান প্রকারের গাজেট আর ইলেকট্রিক/ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি। এখন এটা কেমন হয়, যদি প্রত্যেকটি গাজেট ঠিক আমাদের মতো নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে আরম্ভ করে? আপনি বাড়িতে না থাকলে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়ির সব দরজা জানলা লক হয়ে যাবে। বাড়িতে কোন রোগী অসুস্থ হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলে অ্যাকসিলরোমিটার সেটা ডিটেক্ট করে নেবে এবং টেলিফোন হসপিটালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কল করবে। বাড়ি থেকে বেড় হয়ে এসে সর্বদায় মনে পরে, “লাইট বন্ধ করেছি তো?” “টিভি, মিউজিক প্লেয়ার বেজেই চলছে না তো?” “চুলায় আগুন ধরেই নেই তো?” —কেমন হয় যদি প্রত্যেকটি ডিভাইজকে রিমোট ভাবে অ্যাক্সেস করা যায়? — চিন্তা গুলো অনেকটা কল্পনাপ্রসূত, কিন্তু ইন্টারনেট অফ থিংগস (Internet of Things) নিয়ে লেখা আর্টিকেলে আমি বুঝিয়েছি, এগুলো কিভাবে ব্যস্তবে সম্ভব। আর ঠিক একই রূপে স্মার্ট হোম (Smart Home) প্রযুক্তি সম্ভব হয়। এই আর্টিকেলে এমন এক বাড়ির সম্পর্কে জানবো যেটা টেকের ছোঁয়ায়, আপনার জীবনকে আরো সহজ করে দেবে। অথবা বলতে পারেন, এক ভবিষ্যৎ বাড়ি, যেটা নিজের খেয়াল স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেই রাখতে পারে। —তো চলুন, বিস্তারিত সবকিছু জেনে নেওয়া যাক…


স্মার্ট হোম কি?

 

স্মার্ট হোম এমন কিছু ইলেকট্রিক এবং ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে গঠিত, যেগুলো একটি সেন্ট্রাল কম্পিউটার কন্ট্রোল সিস্টেম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। হতে পারে কম্পিউটার কন্ট্রোলারটি কোন বিশাল কম্পিউটিং সেটআপ বা হতে পারে, এটি সামান্য মাত্র একটি সুইচ। প্রত্যেকটি সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করার জন্য থাকবে বিভিন্ন সেন্সর, যেমন হিট সেন্সর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘরের তাপমাত্রা চেক করবে এবং সে অনুসারে এসি নিয়ন্ত্রন করবে। আবার ফটোইলেকট্রিক সেন্সর অন্ধকার মেপে ঘরের বাতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু করে দেবে। এভাবে প্রত্যেকটি যন্ত্রপাতি এই সেন্ট্রাল সিস্টেমটির সাথে সংযুক্ত থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করবে। তবে আজকের অনেক যন্ত্রপাতিতে প্রয়োজনীয় অনেক স্মার্টনেস রয়েছে —কেনোনা এতে বিল্ডইন সেন্সর এবং কম্পিউটার মাইক্রোকন্ট্রোলার লাগানো রয়েছে।

যদি আপনি অনেক হাই টেক ব্যক্তি হয়ে থাকেন তবে নিশ্চয় আপনার ঘরে রোবোটিক্স ভ্যাকুয়াম ক্লিনার রয়েছে; যেটা নিজে থেকেই আপনার মেঝেতে ঘোরাঘুরি করে মেঝে পরিষ্কার করে। শীত প্রধান দেশ গুলোতে ঘরে থার্মোস্টাট লাগানো থাকে, যেটা আপনি ঘরে না থাকলেও আপনার হিটিং এলিমেন্টকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রন করে। ঘরে লাগানো থাকা স্মোক ডিটেক্টর; কোন ধোঁয়ার সৃষ্টি হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম বাজিয়ে দেয়।

এই প্রত্যেকটি জিনিসই হোম স্বয়ংক্রিয়তার উদাহরণ; কিন্তু এই ডিভাইজ গুলো আপনার ঘরে থাকা মানেই কিন্তু স্মার্ট হোম নয়। যন্ত্রগুলো শুধু নিজে নিজে কাজ করলেই হবে না, সেখানে থাকতে হবে একটি সেন্ট্রাল কন্ট্রোল সিস্টেম। স্মার্ট হোম এর জন্য থাকবে একটি ডেডিকেটেড কম্পিউটার, যেটা সর্বদা বাড়ির জানালা, দরজা, লাইট, ইলেকট্রনিক, ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি গুলোকে মনিটর করবে, এবং কম্পিউটারটির কাছে প্রত্যেকটি যন্ত্রপাতির সুইচ থাকবে। কম্পিউটিং সিস্টেমটির কাছে বাড়ি এবং আপনার সমস্ত ডিটেইলস থাকবে। আপনি বাড়িতে থাকলে সিস্টেমটি একভাবে কাজ করবে আর আপনি বাড়িতে না থাকলে সিস্টেমটি আরেকভাবে কাজ করবে। ধরুন, আপনি বাড়িতে রয়েছেন, কম্পিউটিং সিস্টেমটি দেখতে পাচ্ছে অন্য একটি রুমে আপনার মুভমেন্ট হচ্ছে এবং আপনি সেখানে দীর্ঘক্ষণ ধরে রয়েছেন, তাহলে সিস্টেমটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলাদা রুমের লাইট গুলো বন্ধ করে দেবে। আবার ধরুন আপনি বাড়িতে নেই, এবার সিস্টেমটি ঘরের মধ্যে কোন মুভমেন্ট ডিটেক্ট করতে পারলো, সাথে সাথে অ্যালার্ম বেজে উঠবে।

আমরা সিকিউর থাকতে পছন্দ করি, তাই নিরাপত্তার খাতিরে টেককে আপন করে নিচ্ছি দিনের পর দিন। ধরুন আপনি সপ্তাহিক ছুটিতে পরিবার সহকারে কোথাও বেড়াতে গেলেন, আর বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে গেলেন কোন প্রতিবেশীর হাতে, সত্যি কথা বলতে এভাবে আপনি কখনোই নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন না। মনে হাজারো প্রশ্ন জন্মাবে, ভাববেন, “হায়রে, আমার বাড়ির সাথে বুঝি কিনা হচ্ছে” —আর প্রতিবেশী যদি সেই টাইপের হয় তাহলে তো কথায় নেই, আপনার ফ্রিজের খাবার শেষ করবে, আপনার বাড়িতেই টিভি দেখবে, আর লাইট তো অফ করবেই না। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে স্মার্ট হোম আর তার ইন্টারনেট কানেক্টেড কম্পিউটিং সিস্টেম অনেকবেশি সিকিউর এবং উপযোগী। বাড়িতে লাগানো থাকা ওয়্যারলেস ওয়েবক্যাম আপনাকে সর্বদা লাইভ ফুটেজ সেন্ড করবে, কন্ট্রোলার সিস্টেম রিয়াল টাইমে যেকোনো সুইচ অন অফ করতে সক্ষম হবে তাছাড়া আপনার প্রয়োজন অনুসারে আপনি সমস্ত সিস্টেমকে রি-প্রোগ্রাম করতে পারবেন।

স্মার্ট হোম আপত্তি

যারা কম্পিউটার বা কম্পিউটিং সিস্টেমের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, তাদের কাছে স্মার্ট হোম অনেকটা দুঃস্বপ্নের মতো ব্যাপার। যারা রিমোট কন্ট্রোল বলতে শুধু টিভি চ্যানেল আর ভলিউম পরিবর্তন করা বোঝেন, দুর্ভাগ্য বশত স্মার্ট হোম টেক তাদের জন্য নয়—কেনোনা এতে তারা লাইফকে সহজ করার জায়গায় বিশাল কঠিন করে ফেলবে। তাই অটোমেটিক হোম সিস্টেম সেটআপ করার আগে কিছু বিষয় জেনে নেওয়া প্রয়োজনীয়।

প্রথমে আপনাকে জানতে হবে, আপনার সিস্টেমের সাথে কোন কোন ডিভাইজ কানেক্টেড রয়েছে। অপরিচিত একটিভিটির সাথে আপনার সিস্টেমটি কিভাবে আচরণ করবে সেটাও জানা প্রয়োজনীয়। তাছাড়া আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে সিস্টেমটি কিভাবে কাজ করছে এবং আপনি কিভাবে সিস্টেমটিকে ব্যবহার করবেন। সাথে আপনাকে সিস্টেমটি রী-প্রোগ্রাম করার ধারণাও থাকতে হবে, ধরুন আপনার সিস্টেম অনুসারে আপনাকে সকাল ৭টার সময় ঘুম থেকে ডেকে তুলে দেওয়া হয়, এবং বাড়ির সকল কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুরু হয়ে যায়, কিন্তু আপনি বৃহস্পতিবার রাতে অনেক কাজ করলেন এবং শুক্রবারে অনেক দের পর্যন্ত ঘুমাইতে চান, তাহলে কি হবে? —স্মার্ট হোম নিয়ন্ত্রন করার জন্য অবশ্যই আপনাকে একজন টেকি পার্সন হতে হবে, কিংবা আপনাকে অবশ্যই অন্তত বেসিক ব্যাপার গুলো জানতে হবে।

স্মার্ট হোমে কিছু সিকিউরিটি দুশ্চিন্তা রয়েছে, ভুল করেও যদি হ্যাকার আপনার সিস্টেম নেটওয়ার্ক অ্যাক্সেস পেয়ে যায়, তাহলে সে আপনার বাড়ির সবকিছু নিয়ন্ত্রন করতে পারবে, আপনার সিকিউরিটি অ্যালার্ম অফ করে সহজেই আপনার বাড়িতে ঢুঁকে পড়তে পারবে আর যা ইচ্ছা তা করতে পারে। যদিও যেকোনো ভার্চুয়াল সিকিউরিটি ক্র্যাক করা পসিবল তারপরেও আরেকটি কথা আছে, যেকোনো হ্যাক অ্যাটাককে ঠেকানোরও ব্যবস্থা রয়েছে। তাই অবশ্যই আপনাকে সিকিউরিটি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হতে হবে। তবে ধন্যবাদ জানায় স্মার্টফোনকে, এর স্মার্ট হোম কন্ট্রোল করার জন্য থাকবে নির্দিষ্ট অ্যাপ, যার মাধ্যমে সকল প্রকারের একটিভিটি সব সময়ই মনিটর করা সম্ভব হবে।

আপনার কি সত্যিই স্মার্ট হোমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে?

আমার মতে বিকলাঙ্গ ব্যক্তিদের স্বয়ংক্রিয় হাউজ সিস্টেম আশীর্বাদ বয়ে আনবে, তারা তাদের লাইফের কোয়ালিটিকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে, যেটা আগে তারা কল্পনাও করতে পারতো না। বাড়ির লাইট, ফান সবকিছুর সুইচ প্রয়োজনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন অফ হয়ে যাবে। বিভিন্ন ধরনের সেন্সর সর্বদা কাজ করে যাবে, বাড়িতে অনাকাঙ্ক্ষিত কারো প্রবেশ করা থেকে বাঁচাবে, ভার্চুয়ালি প্রায় আপনার কল্পনার সবকিছু বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে। সঠিক সময়ে সবকিছু অন অফ করার জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ খরচ হবে না, ফলে বিদ্যুৎ বিল অনেকটা সাশ্রয়ী হবে।

উপরের ব্যাপার গুলো ব্যবহার করা পরের কথা, ব্যাট ভাবতেই অনেক মজা লাগে, লাইফ কতোটা হাই টেক হয়ে যাবে, তাই না? কিন্তু এর সাথে একটি প্রশ্নও জুড়ে যায়, সত্যিই আপনার স্মার্ট হোমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? যেখানে আপনার কাছে সবকিছু যন্ত্রপাতি আগে থেকেই রয়েছে, সেখানে আলাদা কম্পিউটিং সিস্টেম সেটআপ করা কতোটা প্রয়োজনীয়? হ্যাঁ, স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাইট, টিভি, চুলা অফ হয়ে যাওয়া অনেক ভালো ব্যাপার। কিন্তু টিভি’র প্লাগ হাতে খুলে ফেলা কতোটা কঠিন কাজ? বা এক চাপ মেরে সুইচ অফ করে দেওয়া কি খুবই মুশকিল? —যেখানে আপনার সিস্টেম হ্যাক করার মাধ্যমে দূর থেকে আপনার সাথে যে কেউ যা ইচ্ছা তা করতে পারে, যে রিস্ক আগে কখনোই ছিল না।

আপনি ঘুম থেকে জাগলেন আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে জুতা আপনার পায়ে পড়ে গেলো, এরকম সিস্টেম কার প্রয়োজনীয় বলুন? আপনি সামান্য কষ্ট করেই এটি করতে পারেন। তবে হ্যাঁ, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়া, টাকা বেঁচে যাওয়া, এগুলো নিঃসন্দেহে অনেক ভালো ব্যাপার, আর এর জন্য স্মার্ট হোমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারেন। আমি কোন টেকের বিপক্ষে নয়, তবে লেটেস্ট টেক মানে কিন্তু এটা নয়, সেটার সবকিছুই আপনার জন্য মঙ্গলজনক হিসেবে প্রমাণিত হবে। অবশ্যই ভেবে চিনতে সুবিধা অসুবিধার কথা ভেবে তবেই সেটা জীবনের সাথে আপ্লাই করানো উচিৎ।

শেষ কথা

সামনের কয়েক দশকের মধ্যে চারিদিকের সবকিছু ইন্টারনেট অফ থিংগস এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে, এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সকল যন্ত্রপাতিকে একত্রে একই সিস্টেমে কানেক্ট করে বা একই প্রোটোকলে নিয়ে এসে রিয়াল লাইফে কতোটা বেনিফিট দিতে সক্ষম হবে, সেটা চিন্তা করে দেখার বিষয়। স্মার্ট হোম নিয়ে যেকোনো মতামত আমাদের নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন, আপনার কি মনে হয়? ইন্টারনেট অফ থিংগস কি সত্যিই উল্লেখ্যযোগ্য ভাবে ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে?

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories