মাইক্রোওয়েভ ওভেন কিভাবে কাজ করে? এটি কি ক্ষতিকর?

এক বা দুই মিনিটের মধ্যে খাবার তৈরি—কথাটি শুনতে ম্যাজিক মানে হলেও, মাইক্রোওয়েভ ওভেন (Microwave Ovens) লাইনটিকে নাটকীয়ভাবে ব্যস্তবতার রুপ দিয়েছে। চিন্তা করে দেখুন, কাঠের খড়ি দিয়ে চলা চুলার কথা, যেখানে রান্না করা মানে পেট ভর্তি ধোঁয়া খাওয়া, অথবা গ্যাসের চুলার কথায় বলি, যেখানে রান্নার সাথে গরমে আর ঘামে আপনিও সেদ্ধ হতে থাকেন। —কিন্তু এবার চিন্তা করে দেখুন এই ম্যাজিক বাক্সের কথা, এতে রান্না করার জন্য ব্যাস দুই তিনটা বাটন প্রেস করতে আর ১-২ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়, আর এর মধ্যেই সম্পূর্ণ খাবার তৈরি! আশ্চর্য ব্যাপার না? চলুন এই আর্টিকেল থেকে জেনে নেওয়া যাক, এটি কিভাবে কাজ করে…


মাইক্রোওয়েভ

এর নাম থেকেই বোঝা যায়, মাইক্রোওয়েভ ওভেন “মাইক্রোওয়েভ” কাজে লাগিয়ে রান্না তৈরি করে। মাইক্রোওয়েভ এক ধরনের ইলেক্ট্রিসিটি এবং ম্যাগনেটিজম মেশানো তরঙ্গ, ঠিক যেমনটা আপনার সেলফোন কাজ করার জন্য ব্যবহৃত হয়, অথবা ওয়াইফাই যে তরঙ্গে কাজ করে। মাইক্রোওয়েভ সাধারনত ২,৪৫০ মেগাহার্জ থেকে ২.৪৫ গিগাহার্জ রেডিও ফ্রিকুয়েন্সিতে কাজ করে এবং এই তরঙ্গ প্রায় আলোর গতিতে ভ্রমন করতে পারে। রেডিও তরঙ্গ যেমন অনেক লম্বা হতে পারে, আবার অনেক ছোটও হতে পারে; মাইক্রোওয়েভ অনেক ছোট আকারের তরঙ্গ, যে তরঙ্গ রান্না করার জন্য ব্যবহৃত হয়, সেটা ১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।

যাই হোক, মাইক্রোওয়েভ কিন্তু এক ধরনের অসাধারণ তরঙ্গ, বিশেষ করে ২,৪৫০ মেগাহার্জ থেকে ২.৪৫ গিগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সির তরঙ্গ গুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে; এরা পানি, চিনি এবং চর্বি দ্বারা শোষিত হয়। এরা শোষিত হওয়ার পরে খাদ্যের পরমাণুর মধ্যে এক বিশেষ গতির সৃষ্টি করে। আর এই অ্যাটমিক মোসান থেকে সৃষ্টি হয়, তাপের। মাইক্রোওয়েভের ছোট সাইজের মধ্যে প্রচণ্ড এনার্জি সরবরাহ করে। এই ওয়েভের আরেকটি অসাধারণ ব্যাপার হচ্ছে, প্ল্যাস্টিক, গ্লাস, সিরামিক দ্বারা এই তরঙ্গ শোষিত হয়না, বরং মেটাল দ্বারা এই তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়। এই জন্য মাইক্রোওয়েভ ওভেন এর ভেতরের মেটালিক দেওয়াল মাইক্রোওয়েভকে প্রতিফলিত করার জন্য আয়না হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর এই জন্যই মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ভেতরে মেটাল প্যান ঠিকঠাক কাজ করে না। আবার যেহেতু মেটাল দ্বারা এই তরঙ্গ শোষিত হয় না, তাই মেটালিক আবেশের মধ্যে মাইক্রোওয়েভ সম্পূর্ণ বন্দী হয়ে থাকে, পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে না।

তাই বলতে পারেন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিরাপদ। তবে মাইক্রোওয়েভ কিন্তু নিরাপদ নয়, এটি জীবিত সেলস এবং টিস্যুকে অনেক ক্ষতিগ্রস্থ করে। আর এর সরাসরি সংস্পরস মানুষের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে। কিন্তু যেহেতু ওভেন থেকে এই তরঙ্গ বাইরে আসতে পারে না, তাই এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। কিন্তু শুধু ওভেনে নয়, আপনার সেলফোন, ওয়াইফাই, রাডার ইত্যাদি সবাই-ই মাইক্রোওয়েভের উপর কাজ করে। তাহলে এদের ব্যবহার করা কি ক্ষতিকর? —আর্টিকেলের শেষের দিকে এই ব্যাপারে আলোচনা করবো।

মাইক্রোওয়েভ ওভেন কিভাবে রান্না করে?

সাধারন ওভেন থেকে মাইক্রোওয়েভ ওভেন’এর কাজ করার ধরণ এবং রান্না করার পদ্ধতি আলাদা। আপনি হয়তো শুনে থাকবেন, “মাইক্রোওয়েভ ওভেন খাদ্যকে ভেতর থেকে বাইরে রান্না করে” —এর অর্থ কি? ধরুন সাধারন ওভেনে আপনি কোন কেক তৈরি করতে দিলেন এবং ধরুন সেই কেক করতে করতে সাধারণত ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজনীয়। এবার মনে করুণ আপনি ভুল বশত সাধারন ওভেনে ৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সেট করে দিয়েছেন, তাহলে কি হবে? অবশ্যই কেকটির ভেতরে রান্না হওয়ার আগে, বাইরের দিকটা পুড়ে ছাই হবে। কেনোনা সাধারন যেকোনো ওভেনে তাপ স্থানান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে খাদ্য রান্না হয়। প্রথমে খাদ্যের গায়ে থাকা পানি গুলো বাষ্পে পরিণত হয় এবং ধীরেধীরে তাপ খাদ্যের ভেতর পর্যন্ত ট্র্যান্সফার হতে থাকে।

কিন্তু মাইক্রোওয়েভ ওভেনে তাপ এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়ে না। মাইক্রোওয়েভ খাদ্যের পরমাণুকে কাপিয়ে তাপ সৃষ্টি করে, যতক্ষণে সাধারন ওভেনে তাপ তৈরি হয়ে তারপরে খাদ্যের ট্র্যান্সফার হয়, ততোক্ষণে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে প্রত্যেকটি খাদ্য পরমাণু নিজে থেকে তাপ তৈরি করে এবং একই সময়ের মধ্যেই উত্তপ্ত হয়ে উঠে।

মাইক্রোওয়েভ ওভেনের মধ্যে একটি মাইক্রোওয়েভ জেনারেটর থাকে, যেটাকে ম্যাগনেট্রন বলা হয়; এটি বাইরের সকেট থেকে ইলেক্ট্রিসিটি গ্রহন করে এবং ইলেক্ট্রিসিটি থেকে শক্তিশালী ১২ সেন্টিমিটার দৌর্ঘের মাইক্রোওয়েভ জেনারেট করে। আর এই ওয়েভ তৈরি করার পরে এটিকে খাদ্যের দিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। খাদ্যটিকে একটি টার্নটেবিলের উপর রাখা হয়, যেটি মাইক্রোওয়েভের ভেতর ধীরেধীরে ঘুরতে থাকে। এবার ওভেনের দেওয়ার আয়নার মতো কাজ করিয়ে, মাইক্রোওয়েভকে বারবার খাদ্যের দিকে প্রতিফলিত করে। কিন্তু যখন মাইক্রোওয়েভ খাদ্যে এসে পৌঁছায়, এটি আর প্রতিফলিত হয়না বরং খাদ্যে এর এনার্জি শোষিত হয়। রেডিও তরঙ্গ বা ওয়াইফাই সিগন্যাল যেভাবে ঘরের দেওয়াল ভেদ করতে পারে ঠিক তেমনিভাবে মাইক্রোওয়েভ খাদ্যের মধ্যে প্রবেশ করে, এবং খাদ্যের পরমাণু গুলোকে আন্দোলিত করে। যেহেতু এই ওয়েভের প্রচণ্ড এনার্জি থাকে, তাই এটি প্রচণ্ড গতিতে খাদ্যের পরমাণুকে ভাইব্রেট করতে পারে। ফলে খাদ্যের মধ্যে প্রচণ্ড তাপের উৎপাদন হয়।

মনে রাখবেন, মাইক্রোওয়েভ পানি দ্বারা শোষিত হয়, ফলে খাবারে যদি বেশি পানি থাকে সেটা দ্রুত রান্না হয়ে যাবে। কিন্তু ধরুন আপনি একটি কেক তৈরি করতে চাচ্ছেন যেটার মাঝখানের দিকে অনেক পানি বা ভেজা রয়েছে, তাহলে আগে মাঝখানটাই দ্রুত রান্না হবে, কেনোনা সেখানে ওয়েভ বেশি শোষিত হবে। তাই ওভেন থেকে খাদ্য বেড় করে খাওয়ার সময় সাবধান থাকবেন, হয়তো বাইরে খাদ্য ঠাণ্ডা হয়ে গেলেও খাদ্যের গভীরে গরম থাকতে পারে। তাছাড়া মাইক্রোওয়েভ ওভেন এর একটি দুর্বল দিক হচ্ছে, এটি বেশি পুরু খাদ্যের ভেতরের দিকে পৌঁছাতে পারে না। খাদ্য অনেক মোটা হলে, সেটার শুধু বাইরের দিকের কিছু অংশ ওয়েভ দ্বারা রান্না হবে, কিন্তু ভেতরের দিকে ওয়েভ না পৌঁছার কারণে তাপ বাইরে থেকে পরিবহন পদ্ধতিতে ভেতরে পৌঁছাবে।

মাইক্রোওয়েভ ওভেন কি ক্ষতিকর?

মাইক্রোওয়েভ ওভেন একটি সম্পূর্ণ মেটালিক বাক্স হয়ে থাকে, যেটার অভ্যন্তরে মাইক্রোওয়েভ জেনারেট হয় এবং রান্না সম্পূর্ণ হয়। এই মেটালিক বক্সের বাইরে মাইক্রোওয়েভ বেড় হয়ে আসার কোন পথ পায় না, বরং বারবার রিফ্লেক্ট হয়ে খাদ্যে চলে যায়। তাছাড়া মাইক্রোওয়েভ ওভেনে আরেকটি নিরাপত্তা ফিচার রয়েছে, আপনি যদি ওভেনের দরজা খোলেন, তো সাথে সাথে ম্যাগনেট্রন কাজ করা বন্ধ করে দেয়, ফলে কিছুই বাইরে বেরনোর মতো থাকে না।

যদি কোন ত্রুটির কারণেও মাইক্রোওয়েভ বাইরে বেড়িয়ে আসে, তারপরেও এটি আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। হ্যাঁ, ওভেনের ভেতরে এই ওয়েভের অনেক এনার্জি থাকে, কিন্তু যদি এটি ওভেন থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসে, এর এনার্জি কমতে থাকে আর আপনার পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে এর রেডিয়েশন কমে একদম সেলফোনের সমান হয়ে যায়। আর সেলফোন, ওয়াইফাই ইত্যাদি নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন  তৈরি করে, যেটার মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করানোর জন্য যথেষ্ট এনার্জি থাকে না। আমি স্মার্টফোন এবং ওয়াইফাই থেকে ক্ষতি হতে পারে কিনা এই ব্যাপারে লেখা একটি আর্টিকেলে এটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তো এক কথায় বলতে, মাইক্রোওয়েভ ওভেন আপনার স্বাস্থ্যের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ, কিন্তু মনে রাখবেন মাইক্রোওয়েভ বিপদজনক জিনিস, তাই মাইক্রোওয়েভ ওভেনের সাথে বেশি নাড়াচাড়া না করায় ভালো।

শেষ কথা

সকালে উঠলেন আর দেখছেন অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে, এই মুহূর্তে জাদুর মতো ২ মিনিটে সকালের খাবার রান্না শুধু মাইক্রোওয়েভ ওভেনই করতে পারে। যদিও এটা নিয়ে অনেকে ভুল ধারণা করে, যে এতে আপনার ক্যান্সার হতে পারে। কিন্তু আজ আপনি জানলেন, এই ব্যাপার গুলো সত্য নয়। তো আপনার বাসাতে কি মাইক্রোওয়েভ ওভেন রয়েছে? নাকি আপনি এই জাদুর বাক্সটি কিনতে চাচ্ছেন? নিচে কমেন্ট করে আমাদের সবকিছু বিস্তারিত জানান।

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories